Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪

বিবিধের মাঝে

এক দিক দিয়া এই ছবি ভারতের রাজনীতির একটি নূতন গতিপথের ইঙ্গিত দেয়। অন্তর্লীন সংঘাত সত্ত্বেও যে বহু দল এক জায়গায় আসিতে পারিল, তাহা বুঝাইয়া দেয়, জোট-রাজনীতির দিক দিয়া ভারতীয় রাজনীতি এখন পূর্বাপেক্ষা অনেক প্রত্যয়ী, দৃঢ়মনস্ক।

শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:৪৪
Share: Save:

উনিশে জানুয়ারি ব্রিগেড সমাবেশ কতখানি সফল, পূর্ণ ভাবে তাহা বোঝা যাইবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে। বিরোধীরা সত্যই এক জায়গায় আসিতে পারিলেন কি না, তাহা স্পষ্ট হইবে সেই সময়। তবে রাজনীতির ক্ষেত্রে ভিতরকার ছবির মতো বাহিরের প্রকাশ্য ছবিটির গুরুত্বও যথেষ্ট। সেই প্রকাশ্য ছবির দিক দিয়া সেই দিনকার সমাবেশের সাফল্য প্রশ্নাতীত। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সাফল্যের একক কৃতিত্ব দাবি করিতে পারেন। এতগুলি রাজ্য হইতে এত দলের নেতা যে সমাবেশে উপস্থিত হইলেন, তাহাকে ঐতিহাসিক বলা যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লাগাতার উদ্যোগ ছাড়া ইহা সম্ভব হইত না। বিরোধী নেতারাও জনে জনে পশ্চিমবঙ্গের নেত্রীকে এই স্বীকৃতি দিয়া গিয়াছেন। অবশ্যই, কাজটি সুকঠিন ছিল। এই নেতারা সকলেই বিজেপি-বিরুদ্ধতায় মুখর হইতে পারেন, কিন্তু তাঁহাদের নিজেদের মধ্যেও বহু রকমের স্বার্থসংঘাত আছে— পরস্পরকে রাজনৈতিক জমি ছাড়িবার ক্ষেত্রে আপত্তি, এমনকি শত্রুতাও। ভারতের মতো দেশে ইহাই স্বাভাবিক। কেন্দ্রের পরিপ্রেক্ষিতে যাহা স্বাভাবিক জোট, রাজ্য স্তরের রাজনীতির আয়নায় দেখিলে তাহাই হয়তো অস্বাভাবিক। উত্তরপ্রদেশের মায়াবতী ও অখিলেশ যদি-বা আপাতত সন্ধিস্থাপন করিয়া থাকেন, আপ ও কংগ্রেস যে এক মঞ্চে আসিতে বিরাট উৎসাহ দেখাইবে, তেমন ভরসা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত করা যায় না। সুতরাং, সন্দেহ নাই, সেই দিন মঞ্চের উপর বিরোধী নেতাদের সম্মিলিত ছবিটি বড় মাপের ছবি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নিশ্চয় এই ছবি স্বস্তিতে রাখিতেছে না।

এক দিক দিয়া এই ছবি ভারতের রাজনীতির একটি নূতন গতিপথের ইঙ্গিত দেয়। অন্তর্লীন সংঘাত সত্ত্বেও যে বহু দল এক জায়গায় আসিতে পারিল, তাহা বুঝাইয়া দেয়, জোট-রাজনীতির দিক দিয়া ভারতীয় রাজনীতি এখন পূর্বাপেক্ষা অনেক প্রত্যয়ী, দৃঢ়মনস্ক। আগে দুইটি দলের জোট হইলে তাহার শর্তগুলি প্রকাশ্য হইত, জমির ভাগাভাগিও স্পষ্ট হইত। বর্তমান পরিস্থিতি কিন্তু আলাদা। এখানে দুই পক্ষের জোটের শর্তগুলি অনেক সময়ই প্রকাশ্য নহে, ভাগাভাগিও নিশ্চিত নহে। তবুও, সার্বিক ভাবে একটি বোঝাপড়া থাকিতেছে। দৃষ্টান্ত: উত্তরপ্রদেশ। এক দিকে কংগ্রেস ও অন্য দিকে সমাজবাদী পার্টি-বহুজন সমাজ পার্টির অক্ষের মধ্যে বোঝাপড়ার ধরনটি বিজেপিকে ধন্দে ফেলিবার মতোই। এই জোট প্রচ্ছন্ন জোট, প্রকাশ্য আসন বাটোয়ারার জোট নহে। ফলে ইহার বিপরীতে যিনি বা যাঁহারা, তাঁহাদেরও এই প্রচ্ছন্ন বোঝাপড়া বিষয়ে খানিকটা অনুমানের ভিত্তিতেই শিবির গোছাইতে হইতেছে।

গত কয়েক বৎসরে নরেন্দ্র মোদীর ভারত যে কাণ্ডকারখানা দেখিতেছে, তাহাতে জোট রাজনীতির এই বিবর্তনটি স্বাভাবিক। বিজেপি শাসনে সংবিধান, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার উপর ক্রমাগত কুঠারাঘাত আসিয়াছে, দেশের আকৃতিপ্রকৃতি পাল্টাইবার উপক্রম হইয়াছে। সংখ্যালঘু ও দলিত সম্প্রদায় লাগাতার আক্রমণ ও অত্যাচারের সম্মুখীন হইয়াছে। সুতরাং, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর খাতিরেই রাজনৈতিক দলগুলি খানিক ‘বড়’ হইয়া উঠিবে, এমন প্রত্যাশা ছিল। নিজেদের ছোটখাটো স্বার্থ-সংঘাত পাশে সরাইয়া, প্রয়োজনে কিছুটা জমি ছাড়িয়াও, গণতন্ত্রের বড় কাঠামোটি রক্ষার জন্য বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করিবে, এমন ভাবা হইতেছিল। এখনও অবধি বিরোধী জোটের চিত্রে সেই প্রত্যাশা পূরণেরই সন্ধান। শনিবার দুপুরে ব্রিগেড-মঞ্চে হাতে হাত ধরা ভারতীয় রাজনীতির কুশীলবদের যে ঐতিহাসিক সম্মিলনচিত্র দেখা গেল, তাহাতে সেই প্রত্যাশিত উত্তরণের ইঙ্গিত। এখন, সেই ইঙ্গিত কতটা মৌহূর্তিক কিংবা সাময়িক, ইহাই আসল প্রশ্ন। স্বার্থের ক্ষুদ্র মেঘ আসিয়া বৃহৎ সন্ধিটি যাহাতে ঢাকিয়া না দেয়, জোটের কান্ডারিদের এই বার সেই দিকে মন দেওয়া উচিত।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE