Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

লাঞ্ছনার তন্ত্র 

তিন তো সংখ্যামাত্র। আক্রমণ নামিয়া আসিয়াছে বহু জনের উপর। কিন্তু শিক্ষকদের আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি গুরুতর এই কারণেই, তাহা সমাজের চূড়ান্ত অবক্ষয়কে হাটের মাঝে আনিয়া ফেলিয়াছে। সুস্থ গণতন্ত্রের শর্ত বাক্‌স্বাধীনতা— বহু স্বরের, এমনকি বিরুদ্ধ স্বরেরও অবাধ প্রকাশ— এই উদগ্র জনতা তাহা ভুলিয়াছে।

ঘটনার এই ছবি ছড়িয়ে পড়েছে টুইটারে।

ঘটনার এই ছবি ছড়িয়ে পড়েছে টুইটারে।

শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

সন্দীপ ওয়াথার, চিত্রদীপ সোম, পাপড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়। ইঁহারা প্রত্যেকেই শিক্ষক, এবং যুদ্ধপ্রিয় দেশপ্রেমিকদের দ্বারা আক্রান্ত। কর্নাটকের বিজয়পুরায় বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষক সন্দীপ ফেসবুকে কাশ্মীর ও যুদ্ধ-পরিস্থিতি প্রসঙ্গে পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মন্তব্যের প্রশংসা করিয়াছিলেন। বনগাঁর স্কুলশিক্ষক চিত্রদীপ ফেসবুকে লিখিয়াছিলেন, পুলওয়ামায় নিহত সেনাদের শহিদ বলিতে তাঁহার আপত্তি আছে। গুয়াহাটির কলেজ-শিক্ষক পাপড়ি সেনাদের উপর আক্রমণের নিন্দা করিয়াও প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন, কাশ্মীর উপত্যকায় নারী ও শিশুদিগের উপর সেনাদের বর্বর আচরণের কোনও বিহিত হইবে না কি? দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হইতে এই সকল মতামত, কিন্তু সব ক্ষেত্রেই ফল মিলিয়াছে হাতেনাতে। দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক আখ্যা এ কালে যথেষ্ট নহে, সোশ্যাল মিডিয়ায় আক্ষরিক অর্থে মুণ্ডপাতের রব উঠিয়াছে। সঙ্গে হুমকি: গণপ্রহার ও ধর্ষণ। ক্রোধান্ধ মানুষের কথায় কান দিবেন কি না তাহা ভাবিতে ভাবিতেই তাঁহারা দেখিয়াছেন, উন্মত্ত জনতা তাঁহাদের কর্মক্ষেত্রে বা গৃহদ্বারে উপস্থিত। দক্ষিণপন্থী ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা কলেজের কক্ষ হইতে শিক্ষককে টানিয়া আনিয়া নতজানু হইয়া ক্ষমাপ্রার্থনা করাইয়াছে, ঘটনার ভিডিয়ো তুলিয়া উল্লাসে মাতিয়াছে। কাহারও বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হইয়াছে, আগাম অন্তর্বর্তী জামিন লইতে কাঠখড় পুড়াইতে হইয়াছে বিস্তর। আক্রমণ হইয়াছে বাড়িতেও, ভীত শিক্ষক অন্যত্র পলাইয়া, পরে ক্লাসে আসিয়া স্তম্ভিত হইয়া দেখিয়াছেন, তিনি চাকুরি হইতে বরখাস্ত।

তিন তো সংখ্যামাত্র। আক্রমণ নামিয়া আসিয়াছে বহু জনের উপর। কিন্তু শিক্ষকদের আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি গুরুতর এই কারণেই, তাহা সমাজের চূড়ান্ত অবক্ষয়কে হাটের মাঝে আনিয়া ফেলিয়াছে। সুস্থ গণতন্ত্রের শর্ত বাক্‌স্বাধীনতা— বহু স্বরের, এমনকি বিরুদ্ধ স্বরেরও অবাধ প্রকাশ— এই উদগ্র জনতা তাহা ভুলিয়াছে। ইহাদের মতে দেশপ্রেমের সংজ্ঞা যুদ্ধ-জিগির, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি, প্রতিবেশী দেশের মানুষের প্রতি সুতীব্র জিঘাংসা। ইহা ভিন্ন অপর কোনও মত নাই, থাকিতেই পারে না। আক্রান্ত শিক্ষকদের ‘অপরাধ’, তাঁহারা নিজস্ব মতামত প্রকাশ করিয়াছিলেন। ‘মতামত’-এ মত ও অমত দুই-ই আছে, প্রকৃত শিক্ষকের কাজ মতের পাশাপাশি অমতটিকেও উপস্থাপিত করা। তাহা যদি সমাজের সিংহভাগের পছন্দ না-ও হয়, তথাপি গলা টিপিয়া ধরিয়া তাহাকে হতশ্বাস করিবার অধিকার কাহারও নাই। অথচ তাহাই হইল।

লাঞ্ছনা কি শুধু শিক্ষকেরই হইল? যে ছাত্রেরা এই ঘটনা বা তাহার ভাইরাল ভিডিয়োর সাক্ষী থাকিল, এই লাঞ্ছনা তাহাদেরও। শিক্ষার্থী যখন শিক্ষকের অপমান চাক্ষুষ করে, তাহার আস্থা ও মনোবল ভাঙিয়া চুরমার হইয়া যায়। সে বুঝিতে পারে, যে মানুষটি ভিন্ন মত ভিন্ন স্বরকে সম্মুখে তুলিয়া ধরিয়া আমার চিত্তের উদ্বোধনে ব্যাপৃত ছিলেন, তিনিও যখন এই রূপ অবমানিত হইতেছেন, তাহা হইলে আমাদের আর আশ্রয় দিবার কেহ নাই। দিগ্‌ভ্রষ্ট ‘সংখ্যাগুরু’ যাহাকে সত্য বলিয়া মনে করিতেছে তাহা যে আসলে খণ্ডসত্য, এই কথা যিনি বুঝাইয়া দিতে পারিতেন, তাঁহাকে মূক ও পঙ্গু করিবার ব্যবস্থা করিলে গণতন্ত্রের বাকি থাকে কী।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy