আজাদি! দিল্লিতে জেএনইউ-এর উপর অাক্রমণের প্রতিবাদে মুম্বইয়ে গেটওয়ে অব ইন্ডিয়ার সামনে জমায়েত, ৬ জানুয়ারি। পিিটআই
প্রতিবাদ করার অধিকার এই দেশে প্রত্যেকের: সেই অধিকার দিতেই হবে। কথাটা আমরা শাসককে মনে করিয়ে দিচ্ছি।— কেন্দ্রীয় সরকারকে কয়েক দিন আগে চিঠিতে লিখেছিল আইআইটি-বেঙ্গালুরুর ছাত্র-শিক্ষক মিলিয়ে ১৭২ জন। সিএএ-র বিরুদ্ধে, দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইউনিভার্সিটিতে ভয়ঙ্কর পুলিশি তাণ্ডবের পর, দেশের দিকে দিকে, এমনকি মুম্বই বেঙ্গালুরুর মতো এলিট শহরে ছাত্রবিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার সময় লেখা এই চিঠি। হয়তো তখনও বুঝতে পারা যায়নি যে, আজ আর ছাত্রদের প্রতিবাদী মিছিলে যাওয়ার দরকার নেই, তাদের ঘরেই শাসকের নির্মম অত্যাচার নেমে আসতে চলেছে, কেবল তারা ছাত্র বলেই। রাতের অন্ধকারে, অপ্রস্তুত অবস্থায়, ক্যাম্পাসের আশ্রয়ে, হস্টেলের নিশ্চিন্ততার মধ্যে তাদের মারতে মারতে রক্তাক্ত করে দেওয়া হবে। জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতে যে দলবল রবিবার চড়াও হয়েছিল, তাদের হাতে কেবল লাঠি ছিল না, সুতীক্ষ্ণ অস্ত্রও ছিল, যাতে বেদম মারে থেঁতলে দেওয়া যায় নিরস্ত্র ছাত্র ও শিক্ষকদের। যাতে প্রাণসংশয় নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় তারা। যাতে ফিরতি পথে হোয়াটসঅ্যাপে এন্তার ফুর্তি বিনিময় করা যায় নিজেদের মধ্যে— ‘‘উই হ্যাড সো মাচ ফান অ্যাট জেএনইউ, মজা আ গয়্যা। উন শালো কো দেশদ্রোহীয়ো কো মারকে...’’
ঠিক এমনই হওয়ার কথা। অথরিটারিয়ান বা কর্তৃত্ববাদী শাসককে দেখাতেই হবে যে, উল্টো কথা বললে মুখ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য পশুবল যথেষ্ট, যুক্তিবলের দরকার নেই। ঠিক এই ঘটনা বার বার ঘটেছে পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে। চিন দেশে। পাকিস্তানে। আমাদের মনে থাকার কথা, মাত্র কিছু কাল আগে ঠিক এই ভাবে ছাত্রসমাজ আর নাগরিক মিছিলের উপর সাংঘাতিক অত্যাচার করে প্রতিবাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে স্বৈরতন্ত্রী শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছে তুরস্কে। কেবল লাঠি ছোরা নয়, ফাইটার জেট থেকে পার্লামেন্টের উপর বোমা ফেলার ঘটনাও দেখা গিয়েছে গণতন্ত্রী সমাজের উপর, প্রেসিডেন্ট তাইপ এর্দোয়ান জাঁকিয়ে বসেছেন আরও বেশি করে। সেটাই এখন ভারতে ঘটছে। না হলে হঠাৎ এক দল গুন্ডাকে জেএনইউ-এর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে এমন একটা নাটকীয় পর্ব তৈরি করার কোনও দরকার ছিল কি?
দরকার একটাই। অত্যাচার কতখানি নির্মম হতে পারে, তার একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করা। প্রচারমাধ্যম তাতে সাহায্য করবে অবশ্যই। টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে সন্ধেবেলা সপরিবার এই দৃশ্য দেখা হবে, ভয়ে শিউরে উঠবে বাচ্চারা, এমনি যদি আমাদের স্কুল-কলেজেও হয়? ভেতরে ভেতরে গুটিয়ে যাবেন এক ধরনের বড়রা, একটু সামলেসুমলে থাকতে হবে ভেবে। অন্য ধরনের বড়রা মনে মনে লাফাবেন, এ বার সময় এসেছে, আছো যেথা যত সেকুলার আমির-ওমরা, আর যত বেটা হোমরা চোমরা, সকলের মজা দেখিয়ে দেওয়া যাবে এ বার— ‘উই উইল হ্যাভ সো মাচ ফান ফ্রম নাও অন’...
অন্তত এটাই কল্পনা ও পরিকল্পনা। তবে একটা সন্দেহের ব্যাপার থেকে যাচ্ছে এখানে। পরিকল্পনাকারীদের মনোবাঞ্ছা ঠিকঠাক পূর্ণ হবে কি? ছাত্রেরা মার খেলেই ভারতীয় নাগরিকেরা গুটিয়ে যাবেন কি? স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। স্বাধীন ভারতে এমন ঘটনা ঘটেনি এক বারও— এমনকি পরাধীন ভারতেও এই সময়ের তুল্য কোনও সময় মনে করা মুশকিল, ইরফান হাবিবের মতো ইতিহাসবিদেরা বলছেন। তাই ভবিষ্যৎ কোন দিকে চলেছে, আগে থেকে আন্দাজ করার উপায় নেই। ঘটনার গতিপ্রকৃতি দেখে যেটুকু মনে হয়, প্রবল দমননীতি দিয়ে, ভয় দেখিয়ে, টাকা ছড়িয়ে, শাহ-মোদী জমানা যে ভাবে কাজ করতে অভ্যস্ত, তাতে কাশ্মীরের তিনশো সত্তর ধারা তোলা থেকে রামমন্দির তৈরি অবধি ম্যানেজ করা গেলেও, নাগরিকত্বের প্রশ্নে কিন্তু সমাজকে সেই চরম নীরবতার অতল গহ্বরে ঠেলে দেওয়া যায়নি। রাজনীতিবিদেরা চুপ করে থাকলেও, প্রচারমাধ্যমের একটা বিরাট অংশ পোষ মেনে গেলেও, যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে মুসলিমদের উপর নির্যাতন বেশ কাজে এলেও,— ছাত্রেরা আর সাধারণ মানুষ কিন্তু ফুঁসে উঠেছে। তাই, ছাত্রদের শিক্ষা দেবার জন্য জামিয়া মিলিয়া এবং আলিগড়ের দমনপর্ব চলল। তাতেও ভয় পাওয়ানো গেল না। বরং দাউদাউ করে বেড়ে গেল আগুন। আরও দলে দলে পথে নেমে এল মানুষ, আসতেই থাকল। আইআইটি বেঙ্গালুরুর চিঠি দেখিয়ে দিল, পুলিশের মার খেয়েও উল্টো বার্তা দিতে ছাত্রেরা কতখানি উৎসুক। শাসক বুঝল যে, বিরোধী দল-টল উঠে গিয়ে সমস্যা এখন ছাত্রদের নিয়েই, তারাই লোক খেপানোর নেতা। ফলে তৈরি হল জেএনইউ ব্লুপ্রিন্ট। যে ভাবে সপ্তাহখানেক আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হুঙ্কার দিয়েছিলেন ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং’কে আচ্ছা শিক্ষা দেবেন তাঁরা, ঠিক তেমনি করেই।
এ বার প্রশ্ন— জামিয়া মিলিয়ার মডেল কাজ করেনি। জেএনইউ মডেল করবে কি?
বেশি আশাবাদী হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যা-ই হোক না কেন, ইরান তুরস্ক পাকিস্তান কিংবা চিনের সঙ্গে তো ভারতের একটা বড় তফাত আছেই। সেটা গণতন্ত্রের আকারে প্রকারে, বিস্তারে গভীরতায়। এই রাষ্ট্রগুলির প্রত্যেকেরই গভীরে চারিয়ে আছে কর্তৃত্ববাদের ইতিহাস, এমনকি সামরিক শাসনের কড়াপাক। ভারত কিন্তু খুব আলাদা। বর্তমান ভারতীয় যুবসমাজ ইতিমধ্যেই তিন প্রজন্মের নাগরিক অধিকার ভোগ-করে-আসা মন নিয়ে মোদী ও শাহকে দেখছে। কিছু অন্য রকম কি আশা করা যায় না, এই সম্মেলক অভিজ্ঞতার পর? এই যে শাহিনবাগে স্নায়ু-অসাড়-করা শীত অগ্রাহ্য করে দিল্লির রাস্তায় বসে আছেন মহিলারা, এই স্তরের প্রতিবাদ কি বেশি দেখা যায় কোনও দেশেই? ভয় না-পাওয়ার মতো লোক এত বেশি সংখ্যক হলে ভয় দেখানোর কলকব্জা কত দূর কাজ করবে? রাজ্যে রাজ্যে কেমন অভিঘাত উঠবে? অশান্তি সংঘর্ষ আরও কত দূর এগোনো যাবে? কত মানুষকে মারবে শাসক? কত জনকে জেলে পুরবে?
ছাত্রদের উপর ভরসা করেই তাই আজ গণতন্ত্র বাঁচানোর আন্দোলন, মানুষ বাঁচানোর আন্দোলন।
না, আনন্দের কথা নয়। এই ভার ছাত্রদের উপর পড়ার কথা ছিল না। তাদের এই দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল না। কিন্তু যে দেশে গণতন্ত্রকে নিকেশ করে স্বৈরতন্ত্র নেমে আসছে দ্রুত বেগে, আর বিরোধী রাজনীতি বলতে সামান্যই অবশিষ্ট আছে, সেখানে সর্বজনের হিতে এই দায় তাদের না নিয়ে উপায় কি? তারা তো ‘অধ্যয়নং তপঃ’ জেনেই পড়াশোনা করতে গিয়েছিল। পড়াশোনার জন্যই চোখকান খোলা রেখেছিল। মানুষের প্রতি সংবেদনশীল হতে শিখেছিল। এ জন্য যদি তাদের আজ রক্ত ঝরিয়ে দাম দিতে হয়, তা-ই হোক তবে। ইজ়রায়েলের মতো দেশে ছাত্রছাত্রীরা তো এই ভাবেই পড়াশোনা করে। দেশ বাঁচানোর জন্য বছর দুয়েক বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়, তার পর পড়াশোনা করে। আজ ভারতও নেমে পড়েছে দেশ-বাঁচানোর যুদ্ধে। ছাত্রছাত্রীরাই ভরসা! উপায় কী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy