ছাত্র বিক্ষোভ।
দিনরাত প্রখর বুদ্ধিমানের সঙ্গে থাকিলে বুদ্ধি লোপ পায়। ছুরিতে অবিশ্রাম শান পড়িলে ছুরি ক্রমেই সূক্ষ্ম হইয়া অন্তর্ধান করে। একটা মোটা বাট কেবল অবশিষ্ট থাকে।’— রবীন্দ্রনাথের এই কথাগুলো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ভেবে দেখতে পারে।
কারণ, প্রতিবাদী লোকজন দুই প্রকার: বর্ণময় আর বর্ণহীন। বর্ণময় মানে, উচ্চবর্ণ; তারা সমাজ-সংসারের নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকে, ব্যক্ত অব্যক্ত নানা ক্ষমতার ভাগিদারও হয়। তারা ভদ্রলোক, বিদ্যাবোঝাই। সেই বিদ্যা থেকে যে বুদ্ধি উৎপন্ন হয় তাতেও বোঝাই, তাই তারা প্রখর বুদ্ধিমান। কিছু ব্যতিক্রমের কথা বাদ দিলে তারা সাধারণত শাসকের প্রিয় হয় বা অন্তত প্রকাশ্যে অপ্রিয় হতে চায় না। ভদ্রলোকেরা কখনও বিদ্রোহ করে না, তবে আন্দোলন করে, প্রতিবাদী আন্দোলন। তার নানা ধরন, ধর্না, অবস্থান, প্ল্যাকার্ড, অনশন, মিছিল, এমনকি ঘেরাও। সবই গণতন্ত্রের কাঠামোর সঙ্গে মানানসই, তবে রাস্তার দু’পাশে দর্শক অপরিহার্য। আন্দোলন আর প্রতিবাদের ভাষা মাঝে-মধ্যে একটু কর্কশ হয়ে যেতে পারে, তবে যত যা-ই হোক তার একটা নিয়মশৃঙ্খলা থাকতেই হবে, মানে একটা ছক— শাসকের চেনা ছক, পাবলিকেরও।
বর্ণহীন লোকজন আন্দোলন করে না; ছোটলোকের দল, তাই বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহের ডিসিপ্লিন থাকে না, কোনও অমোঘ তাড়না থাকে, স্বতঃস্ফূর্ততাও। হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে যাওয়া জনজীবন সেই তাড়নার জোগান দেয়। যেমন, সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ, তিতুমির, নকশাল বিদ্রোহ। তাতে কিছু ভদ্রলোক শামিল হতেও পারে। অনেকে ভাবে, নকশাল বিদ্রোহ ছাত্র-যুবাদের বিদ্রোহ; অথচ তা যে মূলত কৃষক বিদ্রোহ বা আসলে নেহাতই ছোটলোকদের বিদ্রোহ সে কথা তারা ভুলে যায়। জঙ্গলে আর পাহাড়ে দর্শক নেই, তাই ছত্তীসগঢ়ের আদিবাসীরা আন্দোলন করে না, বিদ্রোহ করে। সব বিদ্রোহ সফল হয় না, তাৎক্ষণিক সাফল্য বিদ্রোহের নিয়তিতে নেই; তাদের তাৎপর্য ভবিষ্যতের গর্ভে। কিন্তু সব প্রতিবাদী আন্দোলনও কি সফল হয়? রাষ্ট্র বিদ্রোহকে ভয় পায়, কিন্তু আন্দোলনকে না; এমনকি, খুব নরম স্বভাবের না-হলে রাষ্ট্র নতি স্বীকারও করে না, বরং প্যাঁচ কষার সুযোগ পায়।
ভদ্রলোকেরা সুবিধাভোগী শ্রেণি, রাষ্ট্রই তাদের সুবিধা দেয়। সুলতানি আমলে ব্রাহ্মণরা ছিল অমনই সুবিধাভোগী; যেমন, অন্য অনেক অ-মুসলমানকে জিজিয়া কর দিতে হলেও ব্রাহ্মণদের তা দিতে হয়নি। কিন্তু ফিরোজ শাহ তুঘলক যখন তাদেরও জিজিয়া করের আওতায় আনতে চাইল তখন তারা প্রতিবাদী আন্দোলন করল, এমনকি আত্মাহুতির হুমকিও দিয়েছিল। কারণ তারা যে উচ্চবর্ণ, কাউকে কর দেওয়ার অভ্যেস তাদের নেই। কিন্তু সুলতান যখন তাতেও নরম হল না তখন নিচু বর্ণের হিন্দুরাই ব্রাহ্মণদের হয়ে জিজিয়া কর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ব্রাহ্মণরা খুশি হয়ে আন্দোলন তুলে নিল। সুলতানও খুশি হয়ে পাবলিকের করের বোঝা কমিয়ে দিল। ফিরোজ শাহ যে প্রজাবৎসল ছিল তা সকলের জানা। কিন্তু আমাদের সরকারের
অমন বাৎসল্য নেই। তাই তারা কর্পোরেটদের কর কমিয়ে অন্যত্র তা বাড়িয়ে দেয়। আজকের কর্পোরেটরা ব্রাহ্মণ, বাকি সকলে নিজেরা যা-ই ভাবুন, আসলে ছোটলোক।
ভদ্রলোক বুদ্ধিজীবীরাও নিজেদের এখনও ব্রাহ্মণই ভাবে। ছোটলোকরা যত কাল এই বুদ্ধিমানদের পরামর্শ মেনে চলবে, তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হবে, তত কাল তাদের বুদ্ধিও লোপ পেতেই থাকবে। এ কথা রাষ্ট্র জানে। তাই সে বুদ্ধিপ্রণোদিত আন্দোলন নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয় না। সে জানে, বুদ্ধিচাতুরি থেকে বুদ্ধিবৈকল্যে পৌঁছে যাওয়া কিছু সময়ের অপেক্ষামাত্র। কিন্তু রাষ্ট্র ছাত্রদের ভয় পায়, কেননা ছাত্ররা বিদ্রোহী হতে চায়, ওটা রক্তের অতলস্পর্শী গুণ। তাদের ‘সিডিশাস’ বলতেও রাষ্ট্রের আটকায় না। বুদ্ধিজীবীরা তখন সিডিশাস-এর বানান আর সংবিধানসম্মত মানে নিয়ে তর্ক করে। ছাত্ররা অবশ্য কথায় কথায় বিদ্রোহী হয় না, প্রতিবাদীও হয়, ওটাও রক্তেরই গুণ। অবশ্য অতি-বুদ্ধিমান ছাত্ররা বিদ্রোহ বা প্রতিবাদ কোনওটাই করে না। বড় হয়ে তারা বুদ্ধিজীবী হয়, ণত্ব-ষত্বের বিধান দেয়। তাদের বুদ্ধি যেমন গুপ্ত তেমনই পোক্ত। তাই রাষ্ট্রের হয়ে তারাও ছাত্রদের বলে, ক্রোধ সংবরণ করো।
বিদ্রোহী ছাত্ররা বুদ্ধিদীপ্ত বটে, কিন্তু তারা বুদ্ধিজীবী নয়। মানে, সহজ জিনিসকে শক্ত করে তোলার মতো সূক্ষ্ম বুদ্ধি তাদের গজিয়ে ওঠেনি। তারা বুকের টান থেকে আন্দোলন করে, বিদ্রোহও করে। বিদ্রোহে না থাক, তাদের আন্দোলনেও নিয়মশৃঙ্খলা থাকে, কিন্তু একই সঙ্গে থাকে প্রতিস্পর্ধী ভাব। রাষ্ট্র ওই প্রতিস্পর্ধাকে ভয় পায়, কেননা সেখানে চালাকির সুযোগ কম, দরদস্তুরের পাঁয়তারা কষার অবকাশ কম। দুনিয়ার সর্বত্রই ছাত্র আন্দোলনের বা বিদ্রোহের ইতিহাস অমনই। সেই আন্দোলন দেখতে পথের দু’পাশে দর্শকের ভিড় হয়ে যাবে অমন প্রত্যাশা তারা করে না। মিডিয়া তাদেরকে দেখায়, তাদের কথা শোনায়, কিন্তু সেটা মিডিয়ার দায়। তার মানে, এক অর্থে তারা ছোটলোক; অন্তত ব্রাহ্মণ তো নয়ই। তাই তাদের জাত হারানোর ভয় নেই। তাদের বুদ্ধি এখনও যে লোপ পায়নি সেটা সুখের কথা; তাই রাষ্ট্রের সাম্প্রতিক চেহারা আর কার্যকলাপ তাদেরকে বিদ্রোহী, প্রতিবাদী করে তুলেছে।
কিন্তু এই প্রতিবাদের ধরন নিয়ে সম্প্রতি নানান কথা উঠেছে। ভদ্রলোক, বুদ্ধিমানরা ছাত্রদের ব্যবহারে কতটা ঠিক আর ভুল তার মাপজোক চালাচ্ছে। কতটা আবেগ গ্রহণযোগ্য, ঠিক কোন আচরণ ব্যাকরণসম্মত ছিল না, কতটা হেনস্থা গণতান্ত্রিক ইত্যাদি নিয়ে অনেকেই সরব। কিন্তু ছাত্ররা যদি ভাবে যে, জনজীবনে একটা কুৎসিত পরিমণ্ডল আগতপ্রায়, তাই তার বিরুদ্ধে এক্ষুনি বিদ্রোহ করা দরকার তা হলে তারা কী করবে? রক্তগুণের বিচারে তারা যে এখনও বর্ণহীন, ছোটলোক; তাই তাদের বিদ্রোহ যে ভদ্রলোক রচিত ছকের বাইরে যাবে এতে অবাক হওয়ার মতো কী আছে? কেউ কেউ বিস্তর বুদ্ধিমান, তাই উপদেশ দিয়েছে, ফাঁদে নাকি পা দিতে নেই। ঠিক কথা! তবে ছাত্ররা এ বার নিশ্চয়ই ভাববে, ফাঁদটা কিসের, চর্বিতচর্বণ রাজনীতির, না কি রাষ্ট্রীয় পীড়নের। তারা ভাবতে পারে, প্রথমটা বিষবৎ ত্যাজ্য। আর দ্বিতীয়টা তো ইতিহাসপ্রসিদ্ধ।
এই যে ছাত্ররা বার বার আন্দোলনের ‘শর্ত’গুলোকে বুড়ো আঙুল দেখায়, তারা যে সময়মতো হর্ন বাজিয়ে ‘ব্রেক’ কষতে পারে না, সমাজতত্ত্বে কি তার হদিস আছে? জীববিজ্ঞানে অবশ্য একটা হদিস মিলতে পারে। আমরা শিখেছি, আমাদের শরীরটা তো কোষ দিয়ে তৈরি; সেই কোষের দুটো প্রধান উপাদান, ‘সাইটোপ্লাজ়ম’ আর ‘নিউক্লিয়াস’। কোষের মধ্যে নিউক্লিয়াসই নাকি কর্পোরেট, ভদ্রলোক। আর সাইটোপ্লাজ়ম হল অধিবাসীবৃন্দের বাসস্থান। সেই অধিবাসীরা নিউক্লিয়াসের নির্দেশেই চলে, তারা আসলে ছোটলোক। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাও অমনই, একটা আঁটসাঁট কেন্দ্র আর চার পাশে আলুথালু রাজ্যবৃন্দ। কিন্তু নতুন শতকের নতুন জীববিজ্ঞান জানাচ্ছে, কোষের মধ্যে আমাদের রাষ্ট্রের গঠন আর কর্মকাণ্ডের ছবি দেখা জীববিজ্ঞানীদের বহু পুরনো বাতিক। দেখার ভঙ্গিমা পাল্টে দিলে বোঝা যায়, কোষের মধ্যে কেন্দ্র বলে কিছু নেই, কোনও প্রভু নেই, ভৃত্যও নেই; কোষের যাবতীয় উপাদান নিজের মহিমায় ভাস্বর।
কেউ কেউ আরও জানাচ্ছে, আমাদের জীবনের যাবতীয় ‘চিত্রনাট্য’ বিধৃত হয়ে আছে নিউক্লিয়াসে না, সাইটোপ্লাজ়মে। মানে, ছোটলোকদের হাতেই কোষভুবনের ভার। আধুনিক ছাত্রদল বোধ হয় তাদের সহজ বুদ্ধি খাটিয়ে সেই হদিসটা পেয়ে গিয়েছে, তাই তারা কেন্দ্রকে বরদাস্ত করে না, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে রেয়াত করে না, বাতিকগ্রস্ত আন্দোলনের ছক ভেঙে নিজেদের মতো বিদ্রোহ করে। নতুন ভঙ্গিতে ভাবা তো তাদেরই ধর্ম, তারা যে প্রশ্নপ্রবণ। কিন্তু সব প্রশ্নের চটজলদি উত্তর থাকে না; তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়, গবেষণা চালু রাখতে হয়। সেই গবেষণায় তারা স্বভাবের নিয়মে প্রখর বুদ্ধিমানদের হয়তো এড়িয়েই চলবে, কেননা শুধু ছুরির বাঁট হাতে নিয়ে আন্দোলনের আস্ফালন অতি ক্ষণস্থায়ী। এই অবসরে তারা শরৎচন্দ্রের কথাগুলোও মনে রাখতে পারে, ‘অকপট সহজ বুদ্ধিই সংসারে পরম এবং চরম বুদ্ধি। ইহার উপরে তো কেহই নাই।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy