জমিতে দাউ দাউ করে জ্বলছে খড়।
বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরেই দেশ জুড়ে দিল্লি খবরের শিরোনামে। না, এক্ষেত্রে কোনও আকস্মিক রাজনৈতিক পালাবদল নয়, অন্য বছরগুলির মতোই শীতের শুরুতে বায়ু দূষণের তীব্র মাত্রা আতঙ্কিত করে তুলেছে দিল্লিবাসীদের। সারাদেশের আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে বিশ্ব উষ্ণায়ন, বায়ু দূষণের জন্য গাছ কাটা বা কলকারখানার ধোঁয়ার থেকেও বেশি নজরে আসছে ধানের খড় পোড়ানো|
আশঙ্কার কারণও যথার্থ। বিঘার পর বিঘা জমিতে দাউ দাউ করে খড় জ্বলছে। ভারতের উত্তরাঞ্চলের বিশ লাখের বেশি কৃষক প্রতি শীতের শুরুতে প্রায় আশি হাজার বর্গকিলোমিটার চাষের জমির খড় পুড়িয়ে দেন। তার ওজন ১.৬-২.০ কোটি টন। কারণ ধান কেটে নেওয়ার পর তিন সপ্তাহের মধ্যেই গম চাষের জন্য মাটি তৈরি করতে হবে। পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের অধিকাংশ কৃষক ধান-গম কাটার ক্ষেত্রে হারভেস্টার যন্ত্র ব্যবহার করেন। এই যন্ত্র ফসলের দানাটুকু সংগ্রহ করে গাছকে টুকরো টুকরো করে দেয়, ফলে খড় বলে কোনও ব্যাপারই থাকে না। জমিতে পড়ে থাকা টুকরোগুলো অন্য কোনও কাজেও আসে না। তাই জমিতেই সেগুলো ফেলে রেখে দেন জমির মালিকেরা। কারণ ওই খড় তুলে নিয়ে যেতেও মজুর লাগে। তাতে অতিরিক্ত খরচ হয়। তাই স্রেফ আগুন ধরিয়ে দেওয়াই কৃষকদের কাছে সহজ পথ। এর ফলে দিল্লিতে বাতাসের গুণমান সূচক একিউআই-এর মাত্রা কোথাও ৫০০, তো কোথাও তা ৯০০ ছুঁয়েছে। যেখানে এই মাত্রা ২০১ এর বেশি হলেই তাকে ‘খারাপ’ বলে ধরা হয়।
আমাদের রাজ্যের পরিস্থিতিটা ঠিক কেমন? পরিবেশ গবেষণা সংস্থাগুলি বলছে, বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের মহানগর ও শহরতলিগুলির বাতাস যথেষ্ট দূষিত। চলতি সপ্তাহে কলকাতার ফুসফুস, ভিক্টোরিয়া ও ময়দান চত্বরেও একিউআই-এর মাত্রা দাঁড়িয়েছে ১৮৪। এমনকী, নগরতলি অঞ্চল, হাওড়ার ঘুশুড়িতেও এই মাত্রা ২৬২। শ্বাসনালী, ফুসফুসের ক্যানসার, হাঁপানির মতো সমস্যায় ভুগতে শুরু করেছেন অনেকে। একদিকে জমা জল এবং জলদূষণের ফলে ডেঙ্গি মারণব্যাধির আকার নিয়েছে। অন্যদিকে দিল্লির মতো এ রাজ্যেও সুস্থভাবে শ্বাস না নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা সবার মনেই প্রভাব ফেলছে। স্বভাবতই বর্তমান পরিস্থিতিতে এই রাজ্যেও ধানের খড় পোড়ানোকেই দূষণের অন্যতম কারণ হিসাবে মনে করা হচ্ছে। পরিবেশবিদ ও রাজ্যের তরফে সচেতনতা তৈরিতে প্রচার চালানো হচ্ছে। মাঠে খড় পোড়ানোর চিহ্ন দেখে তার ভিত্তিতে জমির মালিককে নোটিশ ধরানো ও জরিমানা ধার্য করার নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন, রাজ্যের পরিস্থিতি কতটা আশঙ্কাজনক? এর উত্তর খুব সহজে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, দূষণ ও উষ্ণায়নের যথেষ্ট জটিল বিষয়। তাই প্রশাসন ও অর্থনীতির প্রভাব থেকে আলাদা করে শুধুমাত্র গ্রাম্য মোড়কে উত্তর খুঁজতে গেলে চলবে না। স্থান-কাল ভেদে সমস্যার প্রকৃতি ও ব্যাপ্তি আলাদা। তাই সমাধান বা উত্তর পেতে হলে এই বিষয়গুলিকে বিচার করতে হবে।
একটু বিশদে যাওয়া যাক। পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বছর প্রায় ৪ কোটি টন ওজনের ধান-গমের খড় উৎপন্ন হয়। পরিমাণের হিসেবে পঞ্জাব-উত্তরপ্রদেশের পরেই। গ্রামীণ জীবনে খড়ের চাহিদা দীর্ঘ দিনের এবং ধানচাসিরা ফসলের মতই খড়-তুষ কেও লভ্যাংশের হিসাবে রাখতেন। গবাদি খাদ্য হিসাবে খড় একটি অন্যতম প্রধান উপাদান। এ ছাড়াও গ্রামাঞ্চলে কেউ কেউ খড়ের ছাউনি করেন, জ্বালানি হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। তবে বিশ বছর আগেও খড়ের ব্যবহার যত ছিল, এখন কিন্তু তা অনেকটাই কমে গিয়েছে। কাঁচা টাকার যুগে প্রতিটা বাড়িতে গবাদিপালনের প্রবণতা কমেছে। ট্রাক্টর আসায় চাষ বা বহনকাজে বলদ-গরুর ব্যবহার নেই আর। দুগ্ধ উৎপাদনের জন্য সবুজ ফসল পুষ্টিকর গোখাদ্য হিসাবে জনপ্রিয় হচ্ছে। খড়ের চাহিদাও কমেছে। অন্যদিকে গত কয়েক বছর ধরেই একশো দিনের কাজ-সহ সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের জেরেও গ্রামীণ কৃষিতে শ্রমিকের আকাল দেখা দিয়েছে। জমি থেকে ধান কাটা, আঁটি বেঁধে নিয়ে যাওয়া, ধান ঝাড়া—এই পুরো প্রক্রিয়ার জন্য মজুরের উপর নির্ভর করতে হয়। কাজগুলি সময়সাপেক্ষ এবং ঝক্কির। খরচের পরিমাণও বেশি। এই কারণেই উত্তর ভারতের মতো এ রাজ্যেও হারভেস্টার মেশিন কৃষকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। এত তাঁদের খরচ অনেক কমছে। গ্রামীণ কৃষকদের তাঁদের রুটিরুজির প্রশ্ন পরিবেশ সচেতনতার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হারভেস্টার মেশিন তার সহায়ক।
কিন্তু তা সত্ত্বেও এই রাজ্যে উত্তর-ভারতের মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে না, তার একটা কারণ দক্ষিণের সামুদ্রিক বাতাস। তবে প্রধান কারণ, কৃষিজমির মাপ। ভূমিসংস্কারের পর এখানকার অধিকাংশই কৃষকই ছোট চাষি, মাঝারি চাষি বা ভাগচাষী। তাঁদের এক-লপ্তে জমির পরিমাণও এক একরেরও অনেক কম। ফলে তাঁরা চাইলেও চাষের কাজে উন্নত ভারী যন্ত্রপাতি নামাতে পারছেন না বা কিনতে পারছেন না। সমবায়ভিত্তিক কৃষিযন্ত্রপাতি ভাড়া দেওয়ার মতো পরিকাঠামোও এখনও সেইভাবে গড়ে ওঠেনি। ধান-সহ যে কোনও ফসলের উৎপাদন এখানে শ্রমনির্ভর। একদিকে পরিবেশের প্রশ্নে যা অনেকটাই স্বস্তির কারণ, অন্যদিকে কৃষকের লাভের প্রশ্নে হয়তো কিছুটা হতাশাজনক।
সমীক্ষা জানাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে দানা ফসলের অংশ পোড়ানোর হার বছরে ১৮-৩৫ লক্ষ টন, যা উৎপাদনের থেকে অনেক কম। জমিতে আগুন জ্বালালে জমির উর্বরতার প্রয়োজনীয় জৈব পদার্থ-সহ ভৌত গুণগুলো নষ্ট হয়ে যায়। মাটির উপরিভাগে কিছু উপকারী জীবাণু থাকে সেগুলো নষ্ট হয়। এছাড়া খড় বা নাড়া পোড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তাতে উপস্থিত প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান নষ্ট হয়ে যায়। ফলে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার বাড়ে। পরিবেশ সচেতনতার দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে কৃষককে উর্বরশীলতার গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হলে ভবিষ্যতে সমস্যা কম হবে।
এই রাজ্যে, জমিতে আগুন জ্বালানোটার চেয়েও বড় সমস্যা খড় নষ্ট করা। খড়কে ব্যবহারযোগ্য করতে পারলে গ্রামীণ কৃষি আরও অর্থকরী হয়ে উঠতে পারে। বাড়িতে গবাদির সংখ্যা বাড়ানোতে জোর দিতে হবে। গোখাদ্যের পাশাপাশি খামারসার, গোবর বা কেঁচোসারের ব্যবহার বাড়াতেও কৃষকদের আগ্রহী করে তোলার প্রয়োজন। এছাড়াও খড়ে মাশরুম চাষ জনপ্রিয় করে তোলা যেতে পারে। খড় থেকে তৈরি একপ্রকার জ্বালানিকে বলা হয় ব্রিকেট। ধান কাটার পর জমিতে পড়ে থাকা নাড়া এবং খড় সরকারী উদ্যোগে সংগ্রহ করে ব্রিকেট কারখানা তৈরির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এই ব্যাপারে কৃষকদের অবগত করার পাশাপাশি বিভিন্ন স্বনির্ভর গোষ্ঠী, ফার্মার্স প্রডিউসার ক্লাব ও গ্রামীণ কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক, নাবার্ড-কে এগিয়ে আসতে হবে। চাষের প্রতিটা ধাপেই কৃষকের আয় বাড়ানো ও বিকল্প কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে কাজে লাগানো যেতে পারে। এই সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে সদিচ্ছা, আর গ্রামীণ পরিকাঠামোর উন্নতির উপর।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy