মিলন?: করমর্দন করছেন শি চিনফিং এবং নরেন্দ্র মোদী। রাষ্ট্রপতি ভবন, দিল্লি, সেপ্টেম্বর ২০১৪। ছবি: রমাকান্ত কুশবহ
প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর প্রথম গোয়েন্দা কর্তা ছিলেন ভোলানাথ মল্লিক। চিন আক্রমণের সময় নেহরুর সঙ্গে ছিলেন প্রতি মুহূর্তে। তাঁর লেখা মাই ইয়ারস উইথ নেহরু (১৯৪৮-৬৪) বইটি থেকে জানা যায়, চিন আক্রমণের আগেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বলেন, ‘‘অনেকে জানতে চান, চিনকে আক্রমণ করছি না কেন। আমরা দুই দেশই নানা সমস্যার মধ্যে আছি। সেই সব সমস্যা থেকে আগে বেরনো দরকার আমাদের দু’জনেরই। যাঁরা যুদ্ধ যুদ্ধ করেন তাঁরা ভাবেন যুদ্ধ করাটা খুব সহজ কাজ। যুদ্ধের ক্ষতির দিকটা তাঁরা ভাবেন না।’’ নেহরু এটাও ভাবেননি যে চিন ভারতকে আক্রমণ করবে। মল্লিকবাবুকে তিনি বলেন, ‘‘সুদীর্ঘ হিমালয়ের বরফের রাস্তা দিয়ে ভারত ঢোকা? তা ছাড়া এখন আক্রমণ হলে আর একটা বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনাও আছে।’’ নেহরু ‘মুদ্রারাক্ষস’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বুঝিয়েছিলেন, যুদ্ধের লক্ষ্য কী সেটা স্পষ্ট না হলে আপাত-জয় হলেও লক্ষ্য পূরণ হয় না।
নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথমার্ধে চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিংয়ের সঙ্গে সবরমতী তীরে যে রোম্যান্টিক আখ্যান শুরু করেছিলেন, এখন তার মৃত্যু হয়েছে। মোদী এখন চিন সম্পর্কে তাঁর নীতির পুনর্গঠন করতে চাইছেন। সরকারের যুক্তি হল, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর দেং জিয়াও পিংয়ের নেতৃত্বে সত্তর দশকের শেষভাগ থেকেই ‘চিনা স্বপ্ন’ হল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, এমনকী দক্ষিণ এশিয়ায় চিনের প্রভাব বিস্তার। দেং মনে করেছিলেন, আর্থিক সমৃদ্ধি লাভের পর এ বার ‘ঘর’ থেকে ‘বাহির’-এ যাওয়ার সময় এসেছে।
মোদী মনে করছেন চিনা ড্রাগনের নিঃশ্বাসের ভয় থেকে ভারতকে মুক্ত হতে হবে। সে দিন বিজেপির এক বলিউড-প্রেমী নেতা হিন্দি ছবির একটা গল্প শোনালেন। সঞ্জীব কুমার বিদ্যা সিনহাকে বিয়ে করেছেন। বন্ধু বলেছে, প্রথম রাতেই বিল্লি মারতে হয়। না হলে স্ত্রী নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। বন্ধুর পরামর্শ মেনে সঞ্জীব কুমার এটা চাই-সেটা চাই করে স্ত্রী-কে পাগল করে দেন। সপ্তম দিনে তটস্থ স্ত্রীকে সঞ্জীব বলেন, ‘দো মিনিট মে গরম পানি চাহিয়ে, বরনা’... আর মুখ ঝামটা দিয়ে ঘুরে দাঁড়ান বিদ্যা, ‘বরনা বরনা বরনা! বরনা কেয়া?’ সঙ্গে সঙ্গে সঞ্জীব কুমার মিইয়ে গিয়ে বলেন, ‘কুছ নহি। ঠান্ডা পানি সে হি নাহা লুঙ্গা।’ নরেন্দ্র মোদীর মতে, ভারত যদি ঘুরে দাঁড়ায়, চিন মুখে যতই হুংকার দিক, যুদ্ধ করার সাহস পাবে না, বরং ভারতকে সমঝে চলবে।
এর পিছনে একটি হিসেব আছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির হিসেব, অর্থাৎ নির্বাচনী অংক। মনে রাখবেন, নরেন্দ্র মোদী ভোটের আগে অরুণাচল প্রদেশে গিয়ে চিনের অনুপ্রবেশ নিয়ে হুংকার দিয়েছিলেন। ভোটে বিপুল জয়ের পরেও এক দিনের জন্যও তিনি নির্বাচনী প্রচারের মানসিকতা থেকে সরেননি। ফলে ঘরোয়া রাজনীতি এ সরকারে কূটনীতির বৃহৎ প্রেক্ষাপটকে সংকুচিত করেছে।
ভারতের নীতির এই রূপান্তর সম্পর্কে চিনের দৃষ্টিভঙ্গি কী? চিন-ভারত মিডিয়া ফোরাম তৈরি হয়েছিল ইউপিএ আমলে, তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদের উদ্যোগে। তখন চিনা মিডিয়া প্রতিনিধি দল দিল্লিতে আসে। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় ভারতীয় মিডিয়া প্রতিনিধি দলকে চিন আমন্ত্রণ জানায়। কয়েক জন সাংবাদিক বেজিং-সাংহাইয়ে ক’দিন থেকে, কথা বলে বুঝেছিলাম, ওঁদের চিন্তায় ভারত-মার্কিন সাম্প্রতিক অক্ষ নিয়ে একটা শঙ্কা আছে। চিনের মনোবাসনা, ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে চিনের ‘প্রকৃত’ বন্ধু হোক। ক’দিন আগেও দিল্লিতে চিনের এক কূটনীতিক বলছিলেন, আমরা প্রতিযোগী হতে পারি, কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সত্যিকারের ‘শবিক’ হয়ে উঠতে চাই। আসলে চিন চায়, এই অঞ্চলে তারা নেতা হবে, আমরা হব তার সহযোগী ‘ভ্রাতাশ্রী’। কিন্তু ভারতের বিদেশ নীতির আদর্শ হল সমদূরত্ব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিন, উভয়ের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রাখা। সে ক্ষেত্রে দুই বৃহৎ দেশই, ভারতের সঙ্গে অন্য পক্ষের সম্পর্ক ভাল বলে, তাকে বেশি ‘কূটনৈতিক দর’ও দেবে।
’৬২ সালের যুদ্ধের পর প্রথম রাজীব গাঁধীই ’৮৮ সালে চিনে গিয়ে বরফ গলিয়েছিলেন। ’৮৬ সালে বিদেশ মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে নটবর সিংহ চিন সফরের ব্যাপারে রাজীবের মতামত জানতে চান। নটবর তাঁর মাই চায়না ডায়রি-তে (১৯৫৬-৮৮) লিখেছেন, রাজীব বলেছিলেন, ‘‘’৬২ সালের কোনও হ্যাংআপ নেই আমার। চিন যাব। প্রস্তুতি নিন।’’ সে দিনের প্রধানমন্ত্রীর যুগ্মসচিব রণেন সেন সেই ঐতিহাসিক সফরের অন্যতম স্থপতি ছিলেন। ৩৪ বছর পর অটলবিহারী বাজপেয়ী ২০০৩ সালে আবার চিন গেলেন। আরএসএস তথা সংঘ-পরিবারের ভাষায় ‘বিশ্বাসঘাতক’ ‘শত্রুরাষ্ট্র’ চিনে। শুধু গেলেন না, তিনি সীমান্ত সমস্যার স্থায়ী সমাধানের স্বার্থেই নতুন করে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করলেন বিশেষ প্রতিনিধি নিয়োগের মাধ্যমে। বাজপেয়ীর সফরে যৌথ বিবৃতিতে আবার বলা হয়, সিকিমের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে চিন প্রশ্ন করবে না, আর ভারত তিব্বতকে চিনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে মেনে নেবে। বাজপেয়ীর প্রধান সেনাপতি, তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্র ‘থানায় দারোগা’ ছিলেন না। সরকারের প্রতিনিধি উপ-প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরকারের শেষ দিন পর্যন্ত সীমান্ত ‘পোস্ট’গুলি নিয়ে সুগভীর আলোচনা চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কখনও কেরলের সমুদ্রতটে কখনও হিমাচলে হিমালয়ের কোলে। অন্য দিকে দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক চলেছে। বাণিজ্য ঘাটতি আর ‘ডাম্পিং’ নিয়ে বাজপেয়ী থেকে মনমোহন জমানা— চিনের সঙ্গে ঝগড়াও করেছে ভারত। কূটনীতি চলেছে নরমে গরমে। কূটনীতির নিজস্ব ব্যাকরণে।
কিন্তু আজ মোদী সরকার ‘চিন সম্পর্কে আমাদের ভারতীয় ভীতির সংস্কৃতি’ বদলাতে রণহুংকার দিচ্ছেন? নিঃশব্দ কূটনীতির পথে হাঁটার জটিলতা থাকতে পারে, কিন্তু সেটাই কি ঠিক পথ নয়? ভুটানের ছোট্ট একটা জমি নিয়ে চিন যে অনমনীয় মনোভাব নিল তাতেই আমাদের পেশি আস্ফালন আপাতত সর্বদলীয় বৈঠকে কূটনৈতিক ঐকমত্যের রাস্তায় উপনীত। মনে আছে, ব্রজেশ মিশ্র থেকে এম কে নারায়ণন, কেউ সমুদ্রবন্দরে চিনা কোম্পানিকে পরিকাঠামোগত কাজের অনুমতি দেননি। চিন এ কাজ পেতে এতটাই মরিয়া ছিল যে দিল্লিতে চিনা রাষ্ট্রদূত মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে নৈশভোজ খাইয়ে অনুরোধ করেছিলেন যাতে তিনি মনমোহনকে এ বিষয়ে রাজি করান। মনমোহন আর বুদ্ধবাবুর সম্পর্ক তখন মধুর। প্রকাশ কারাটও ছিলেন নৈশভোজে। বুদ্ধবাবু সাফ সাফ জানিয়ে দেন, জাতীয় নিরাপত্তা বা বেসরকারি কোম্পানির ব্যবসার মতো ব্যাপারে তিনি মাথা গলান না। বুদ্ধবাবু পরে ঘনিষ্ঠ এক পার্টি কর্মীকে বলেছিলেন, ‘‘আমি কমিউনিস্ট, কিন্তু ভারতের মাটিতে চিনের পতাকা তোলাটা আমার কাজ নয়।’’
বাজপেয়ী, মনমোহন, বুদ্ধদেব, দেশের বহু নেতাই নিজেদের মতো করে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী কর্মসূচি নিয়ে চিনের সঙ্গে কূটনৈতিক বিতর্ক চালিয়েছেন। তাই বলে বিদেশ নীতির নানা স্তরকে অস্বীকার করে চিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জিগির তোলা কি বিশাল কূটনৈতিক মুর্খামি নয়? কার্গিল যুদ্ধের সময় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ এক বার বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের চেয়ে চিন বড় শত্রু।’ অসন্তুষ্ট প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী জর্জকে ডেকে বোঝান, এই সময়ে দুটি ‘ফ্রন্ট’ উন্মুক্ত করা মূর্খামি। ভুটানের ছোট্ট একটা ক্ষতকে খুঁচিয়ে বিষিয়ে দেওয়াও একই রকমের রাজনৈতিক অবিমৃশ্যকারিতা।
এখনও সময় আছে, মোদীর উচিত দেশের স্বার্থে রাজীব-বাজপেয়ীর সুকৌশলী দ্বিমুখী কূটনীতিতেই ফিরে আসা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy