গত ২৫ বছরে এডস-এর প্রতিষেধক টিকা বেরোল না, ডেঙ্গির টিকা বেরোল না। এ সবই তো আরএনএ ভাইরাস। অথচ বিশ্ব জুড়ে গবেষকরা এবং তাঁদের গবেষণায় লগ্নিকারী সংস্থাগুলো স্থির নিশ্চিত, অনতিবিলম্বে করোনা প্রতিষেধক টিকা বেরোচ্ছে। কেউ কেউ তো আবার দিনক্ষণও ঠিক করে ফেলেছেন!’ মেডিক্যাল কলেজের এক অনুজ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হাসতে হাসতেই বলেছিলেন কথাগুলো। তখনও রুশ টিকার প্রহসনটি ঘটেনি। মনে হল, সত্যিই করোনা অতিমারি নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতে যা চলছে, তাতে ‘বিজ্ঞান কিঞ্চিৎ কম পড়িয়াছে’— আমাদের দেশে যেমন, গোটা দুনিয়াতেই তেমন। কয়েকটা উদাহরণ দিই।
প্রথমত, লকডাউন। কোভিড-১৯’এর সূচনাপর্ব থেকেই পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে করোনা অতিমারি মোকাবিলায় মডেলিংভিত্তিক মৃত্যু ও রোগ সংক্রমণের সম্ভাবনা মেনে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এই মডেলনির্ভর অতিমারি-মোকাবিলার হাতিয়ার লকডাউন। লকডাউনের ফলাফল অত্যন্ত বিতর্কিত। লকডাউন যত দীর্ঘায়িত হয়েছে, ততই করোনা সংক্রমণ বেড়েছে। প্রথমে দাবি করা হল, তিন সপ্তাহে করোনা উধাও হবে। তার পরে বলা হল, মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহের পর করোনামুক্ত হবে দুনিয়া। এর পর কখনও জুলাই, কখনও সেপ্টেম্বর মাসে শীর্ষ সংক্রমণ হারে পৌঁছনোর ভবিষ্যদ্বাণীর ঘোষণা হল। কিছু ভবিষ্যদ্বাণী ইতিমধ্যে মেলেনি, বাকিগুলোর সম্বন্ধেও খুব আশাবাদী হওয়ার কারণ দেখছি না।
বহু দেশ লকডাউনের পথে হাঁটেনি। কিন্তু তাদের অবস্থা বেশি খারাপ, বলা যাবে না। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার বিবিধ ঘোষণায় একটা জিনিস পরিষ্কার— মডেলিং-এর পদ্ধতি এ ক্ষেত্রে বিশেষ নির্ভরযোগ্য হচ্ছে না। রোগবিস্তার বুঝতে কোথাও নিশ্চয় সমস্যা হচ্ছে। করোনার রোগবিস্তার সংক্রান্ত গবেষণায় তথ্যের অস্পষ্টতা ও কারচুপিও নজরে এসেছে। বিজ্ঞান যদি সত্যের পূজারি হয়, তা হলে বিজ্ঞানচর্চায় মিথ্যা আর অর্ধসত্যের কী প্রয়োজন?
অর্ধসত্যের এই খেলা সর্বত্র। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক দিল্লিতে যে ‘সেরোপ্রিভালেন্স’-এর সমীক্ষা চালিয়েছে, তার ফলাফল এবং পদ্ধতি সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা গবেষক মহলে এখনও সম্পন্ন হয়নি। অথচ ওই ফলাফল দেখিয়েই কোনও কোনও মহল থেকে ভারতে করোনার গোষ্ঠী সংক্রমণের তত্ত্ব খারিজ করা হচ্ছে। এ ভাবে বিজ্ঞান চর্চা হয় না।
বিজ্ঞান গবেষণার মূল নীতি হল ‘তথ্য থেকে সত্যে’ পৌঁছনো। যদি করোনা নিয়ে যথাযথ তথ্য না মেলে, তবে তার যথার্থ মোকাবিলা কী ভাবে সম্ভব? সম্প্রতি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ভারতের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশের উপরে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়ছে। সেখানে কোভিড ডেটা রিপোর্টিং স্কোর বা ‘সিডিআরএস’ বলে একটি সূচকের কথা বলা হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কোভিড সংক্রান্ত তথ্যের লব্ধতা, সহজলভ্যতা এবং তথ্যের বহুবিধতা ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে মাপা হয়েছে স্কোর। শূন্য থেকে এক-এর মধ্যে থাকবে এই স্কোরের মান। বিভিন্ন রাজ্যের যে ফলাফল পাওয়া গেল, তা ‘রোমাঞ্চকর’। উত্তরপ্রদেশ ও বিহার পেয়েছে শূন্য। সব থেকে ভাল ফল কর্নাটকের, পেয়েছে ০.৬১। দেশের গড় স্কোর ০.২৬, পশ্চিমবঙ্গ পেয়েছে ০.৩৫। এ যদি কোভিড সংক্রান্ত রোগবিস্তার তথ্যের হাল হয়, তা হলে এর ভিত্তিতে বিজ্ঞানচর্চা কেমন হবে?
শারীরিক দূরত্ব এবং লকডাউন নীতির পাশাপাশি করোনা মোকাবিলায় আর একটি পদ্ধতির কথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং কিছু বিশেষজ্ঞ ধারাবাহিক ভাবে বলেছেন— তা হল ‘টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট’ আর ‘কনট্যাক্ট ট্রেসিং’। অর্থাৎ যত বেশি সম্ভব রোগ নির্ণয় পরীক্ষা ও সংক্রমণের উৎস শনাক্তকরণ এবং রোগীকে আলাদা করা। এটি একটি অতিপরিচিত পদ্ধতি। কিন্তু অতিমারির বা মহামারির সমগ্র পর্যায় জুড়ে এই পদ্ধতি সমান ফল দিতে পারে না। তীর থেকে মাঝসমুদ্রে যাওয়ার বা ফেরার পথে নৌকা চালানোর পদ্ধতি আর মাঝসমুদ্রে নৌকা বাইবার পদ্ধতি এক না। ঠিক তেমনই মহামারির শুরু এবং শেষের পর্বে এই নীতি বিশেষ ফলপ্রসূ হয়।
কিন্তু যখন রোগীর সংখ্যা বিপুল হারে বেড়ে চলেছে, তখন বিশ্বজুড়ে এই নীতির ফল কী দাঁড়িয়েছে? ২৫ জুলাই ২০২০-র তথ্যে দেখা যাচ্ছে প্রতি দশ লক্ষ জনসংখ্যাপিছু সব থেকে কম পরীক্ষা করা দু’টি দেশ জাপান এবং শ্রীলঙ্কায় মৃত্যুহার সর্বনিম্ন। পরীক্ষা কম, তাই রোগীর হার কম— এ যুক্তিতে তথ্যটি খারিজ করা যাবে না, কারণ অতিমারি যদি থাকে তা হলে সে দেশে ইনফ্লুয়েঞ্জা জাতীয় রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তো বাড়বেই, তাকে কোভিড বলুন আর না-ই বলুন। প্রসঙ্গত একটা কথা মনে করিয়ে দিই— ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা একমাত্র শ্রীলঙ্কাতে রয়েছে। বিজ্ঞানমনস্কতা থাকলে শ্রীলঙ্কার রোগ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা জরুরি।
অতিমারির শুরু থেকেই বিজ্ঞানীমহলে একটি কথা ভীষণ ভাবে প্রচারিত হয়েছে যে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটির অভাবেই করোনা অতিমারির এই বাড়বাড়ন্ত। বাস্তবটা একেবারেই আলাদা। আসলে কোভিড রোগী তার দেহের শত্রু ভাইরাসের মোকাবিলায় যে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তার ধাক্কাতেই সে মারা যায়। ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলে ‘হাইপার ইমিউন, হাইপার ইনফ্লামেটরি রেসপন্স’। সুতরাং করোনা মোকাবিলায় প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে যে সব ওষুধ এবং খাদ্য বাজারজাত করার প্রতিযোগিতা চলছে তার বৈজ্ঞানিক সারবত্তা বিশেষ নেই। লক্ষণীয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মানবদেহে ইমিউনিটির অভাবের কথা বলল, অথচ কোভিড-১৯’এর রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষায় পুরনো অ্যান্টিবডি (সার্স-১) নির্ধারণের নীতিকেই কাজে লাগানো হল। আরও দেখা গেল, চিনে যে সব অঞ্চলে সার্স-১ মহামারি হয়েছে, সে সব এলাকায় কোভিড মহামারির অভিঘাত কম। অর্থাৎ আমাদের শরীরে একটা প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে, এবং মানবদেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা সার্স-১ এবং কোভিড-১৯’কে কাছাকাছি বলে চিনতে পারে। সম্ভবত একের সংক্রমণ অপরের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারবে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী জন ইয়োনিডিস দেখালেন, মানবদেহে কোভিড-১৯’এর প্রতিরোধক্ষমতা যা ভাবা হয়েছিল, তার থেকে অনেক বেশি। অতএব প্রতিরোধহীনতার তত্ত্ব থেকে করোনার মোকাবিলার ফলাফল ব্যর্থ হতে বাধ্য।
করোনা অতিমারির শুরুর দিনগুলোতে আমরা ভেবেছিলাম, ধারাভির মতো বস্তিগুলোতে এক বার করোনা ঢুকলে তা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু দেখা গেল, মহারাষ্ট্রের করোনা অতিমারির মধ্যে ধারাভির ফল সব থেকে ভাল। এতটাই ভাল যে, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রশংসা আদায় করে নিয়েছে। কলকাতার বস্তিগুলোতে যেখানে শারীরিক দূরত্ব রাখা খুবই কঠিন, সেখানে করোনার প্রাদুর্ভাব শহরের তথাকথিত অভিজাত এলাকার থেকে বেশি বলে জানা নেই। সল্টলেকের লাগোয়া শ্রমজীবী ঘিঞ্জি বসবাসের এলাকায় করোনার প্রাদুর্ভাব সল্টলেকের ফাঁকা ফাঁকা আবাসনের থেকে বেশি, এমন তথ্য আমাদের হাতে আসেনি। তা হলে কী দাঁড়াল? যে বিজ্ঞানের তত্ত্বে ভর করে আমরা এগোতে চাইছি, সেখানে আরও বেশি বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সমাবেশ দরকার।
যত দিন যাচ্ছে, তত করোনার রোগবিস্তার ও মোকাবিলায় নতুন নতুন দিক উঠে আসছে। বৈজ্ঞানিক চর্চায় এদের অনেকগুলোই উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। ভারতের মতো জনবহুল দেশে এই বিপুল সংক্রামক কিন্তু কম মারণক্ষমতাসম্পন্ন রোগের ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় পরীক্ষার পিছনে খরচ না করে জীবনরক্ষার দিকে মনোনিবেশ করা যুক্তিযুক্ত। সে ক্ষেত্রে ইনফ্লুয়েঞ্জা জাতীয় রোগাক্রান্ত জনগণের উপর ব্যাপক সমীক্ষা করে তাদের মধ্যেকার ঝুঁকিসম্পন্ন রোগীদের বাছাই করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে আমরা ভীতিনির্ভর করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে জীবনদায়ী চিকিৎসাব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হতে পারব। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রমাত্রেই জানেন, প্রতি বছর বহু বিশেষ ভাবে রুগ্ণ মানুষকে ইনফ্লুয়েঞ্জার বিশেষ স্ট্রেন অনুসারে টিকা দেওয়া হয়। করোনার যে টিকা তৈরির চেষ্টা চলছে, সেখানে সার্স-১ ও অন্য সর্দি জ্বরের বিটা করোনাভাইরাস শরীরে ঢুকলে তার প্রতিরোধ ব্যবস্থার সঙ্গে সাদৃশ্য বুঝে এগোনোর চেষ্টা চলছে। ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকার অভিজ্ঞতা গবেষকদের সাহায্য করছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণক্ষমতা যে হেতু বেশি আর মারণক্ষমতা কম, তাই মৃত্যুভয় আর রোগভীতির বাতাবরণ বজায় থাকলে করোনা চিকিৎসার ব্যবসা অনেক দূর এগোবে, এটুকু হলফ করে বলা যায়।
চিকিৎসাবিজ্ঞান আর জনস্বাস্থ্যের উন্নতি অবশ্য আলাদা কথা।
শল্য চিকিৎসক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy