Advertisement
৩০ ডিসেম্বর ২০২৪
ডিসেম্বর ২০২৪
Bengali

নামভূমিকায়

গত অক্টোবর মাসে ধ্রুপদী ভাষার সরকারি স্বীকৃতি মিলেছে। কিন্তু আপন সমাজের বিপুল অশ্রদ্ধা আর ঔদাসীন্য ঘুচবে কি? বছরশেষে প্রশ্ন তুলতে পারে বাংলা ভাষা

নির্মল পাত্র
শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৭:৫৭
Share: Save:

সরকারি ঘোষণা হয়েছিল দেবীপক্ষে। শারদোৎসব শুরু হওয়ার দিন তিনেক আগে জানা গিয়েছিল: কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষা বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। সে-কালের মানুষেরা শুনলে হয়তো অবাকই হতেন, এমন স্বীকৃতি তো দেবেন দেশের বিদ্বৎসমাজ, সরকার নাক গলানোর কে? কিন্তু এ-কালের নিয়ম আলাদা, এখন সবার উপরে রাষ্ট্র সত্য। অতএব অনেক বছর ধরে অনেক সওয়াল চালিয়ে তার সপক্ষে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের জন্য বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে রাজধানীর রাজাধিরাজদের কাছে দরবার চলছিল, শেষ অবধি ফল ফলল। ঠিক কুড়ি বছর আগে প্রথম ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি পেয়েছিল তামিল, তার পরে সংস্কৃত, ক্রমে ক্রমে তালিকা দীর্ঘতর হয়েছে, এ-বার এক সঙ্গে পাঁচটি ভাষা যুক্ত হয়ে দেশের ধ্রুপদী ভাষার সংখ্যা দাঁড়াল এগারো। বাংলা সেই এগারোর মধ্যে এক।

কোনও ভাষা এমন একটি সম্মান পেলে সেই ভাষায় যাঁরা কথা বলেন তাঁদের গর্বিত এবং আনন্দিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি কেউ বলে যে এ-দেশের বঙ্গভাষীদের প্রতিক্রিয়ায় তেমন গর্ব এবং আনন্দ ফুটে উঠতে দেখা গিয়েছে, তা হলে কাক্কেশ্বর সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দেবে: হয়নি, হয়নি, ফেল্। ধ্রুপদী ভাষার খবরে যেটুকু যা কথাবার্তা, তার বেশির ভাগটাই ছিল কেন্দ্র-রাজ্য সওয়াল-জবাব। দু’পক্ষের বাজনদাররাই দাবি করেছেন, এই স্বীকৃতির কৃতিত্ব তাঁদের। দু’চার দিনেই সেই শোরগোল থেমেছে। কিন্তু তার পর? কেবল কলকাতা পুরসভার একটা উদ্যোগের কথা শোনা গিয়েছে বটে, তারা নাকি হুকুম জারি করবে যে শহরে সমস্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে দোকানপাটের নামফলকে বাংলা রাখতেই হবে। তবে না আঁচালে বিশ্বাস নেই। আর, সেটা হল পুরসভার ব্যাপার। কিন্তু যাকে নাগরিক সমাজ বলে? বাংলা এবং বাঙালির সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে যে সমাজের বিস্তর অহঙ্কার বলে কথিত আছে? সেই পরিসরটিতে জারি থাকল গভীর নৈঃশব্দ্য।

উল্টো একটা প্রশ্নও নিশ্চয়ই উঠতে পারে। ধ্রুপদী ভাষার তকমা নিয়ে মাথা ঘামানোর কী আছে? ধ্রুপদী মানে হল— সোজা কথায়— কত দিনের পুরনো, কত প্রাচীন ঐতিহ্য, সেই সব ব্যাপার। কিন্তু ভাষা তো ভাবের বাহন। তা, বাহনের বয়স কত, তার থেকে অনেক বড় কথা হচ্ছে বাহনটি কতটা সজীব এবং সচল। সুতরাং, তার অতীত নিয়ে উচ্ছ্বসিত না হয়ে বরং তার বর্তমান এবং ভবিষ্যতের দিকে মন দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ, তাই নয় কি?

বাংলা ভাষার বর্তমান যদি স্বাস্থ্যবান হত, ভবিষ্যৎ যদি হত উজ্জ্বল, তবে এই প্রশ্নের পরে আর কোনও কথাই থাকত না। কিন্তু মূল সমস্যা সেখানেই। ঘটনা এই যে, বাংলা ধ্রুপদী ভাষার সম্মান পাওয়া নিয়ে যে নীরবতা বিরাজমান, তার পিছনে আছে এক বিপুল ঔদাসীন্য। বাংলা ভাষার প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষীর ঔদাসীন্য। প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্তে, সর্বত্র সেই ঔদাসীন্য নানা ভাবে নিজের বিজ্ঞাপন দিয়ে চলেছে। কি মুখের কথায়, কি লেখার ভাষায়। পরিচ্ছন্ন বাংলা ভাষায় কথা বলার সামর্থ্য দেখতে দেখতে বিরল হয়ে উঠেছে। নাগরিকদের, বিশেষত তরুণতরুণীদের একটা অংশ পারতপক্ষে বাংলা বলেনই না, এবং সেই অংশটা ক্রমশই বাড়ছে। যাঁরা বলেন, তাঁদের কথাতেও ডজনে আঠারোটা হিন্দি বা ইংরেজি শব্দের ছয়লাপ। আর, শব্দ যদি বা বাংলা হয়, বাক্যের ছিরি-ছাঁদে বাংলা ভাষার সুস্থ স্বাভাবিক রীতি উত্তরোত্তর হারিয়ে যাচ্ছে, অন্য ভাষা থেকে নকল করা ভাষাভঙ্গির উৎকট অপপ্রয়োগ চলছে অকাতরে।

লিখিত বাংলাতেও একই অযত্ন এবং অপটুতার ছবি। দোকানপাটের নামে বাংলা অক্ষর দেখা যায় না, সেটা তো ছবির একটা দিক। যেখানে বাংলা দেখা যায়, তা দোকানের নামেই হোক বা নানা ধরনের বিজ্ঞাপনে ও নির্দেশিকাতেই হোক, ষোলো আনা নির্ভুল বানান এবং স্বচ্ছন্দ বাক্য বা শব্দপ্রয়োগের নমুনা খুঁজতে গেলে হয়রান হয়ে যেতে হয়। কথাগুলো অজানা নয়, অচেনা নয়, কিন্তু এই নিয়ে ক’জনের আদৌ কোনও মাথাব্যথা আছে, বলা শক্ত। সবচেয়ে বড় ভয়ের কথা হল, বহু অভিভাবক মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে ছেলেমেয়ে বাংলা ভাল না জানলে কিচ্ছু যায় আসে না, কেন কী (‘কেননা’ বা ‘কারণ’ বা ‘যে-হেতু’ নয়, অগণিত বঙ্গভাষী এখন অকাতরে ‘কেন কী’ বলতে অভ্যস্ত) কেরিয়ারে ওটা কোনও কাজে লাগে না।

ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি এই সর্বব্যাপী অবহেলার অকূল পাথারে পড়েই নিঃশব্দে ডুবে গিয়েছে। আর ঠিক সেই কারণেই ওই স্বীকৃতিকে মনে রাখা দরকার। ভাষা যদি নিজের জোরেই সজীব এবং সচল থাকত, তা হলে একটা সরকারি নির্দেশিকা নিয়ে না ভাবলে কোনও ভাবনা ছিল না। কিন্তু এই আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটি নতুন করে বাংলা ভাষার সঙ্কট নিয়ে সজাগ হওয়ার একটি উপলক্ষ তৈরি করেছে। শিরোপা লাভের বছর শেষ হতে আর তিন দিন। আপন ভাষার প্রতি সামাজিক অসম্মান আর উপেক্ষার বোঝা টেনেই বঙ্গসমাজের ২০২৪ বিদায় নেবে। অন্তত এই দুর্ভাগ্যের কথাটা এক বার স্মরণ করা যাক। আর, আসন্ন নতুন বছরকে সামনে রেখে বঙ্গভাষী মানুষ ও মানুষীরা যদি ঔদাসীন্যের ইতিহাসকে বদলানোর অঙ্গীকার করতে পারেন, তবে সরকারি শিরোপা একটা সার্থকতা খুঁজে পাবে। ধ্রুপদীর গর্ভেই তো নবজাগরণ ঘটতে পারে।

অন্য বিষয়গুলি:

Classical Language language
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy