ছুটিতে, উৎসবের দিনে, বাঙালি কী খায়? ভাত-মাংস। কাজটা কি ভাল? না না, নিরামিষ খাওয়ার সওয়াল এটা নয়। ক্যালরির হিসেব গুনে জীবনটা দুর্বিষহ করে তোলাও উদ্দেশ্য নয়। কথাটা হল, এক কিলোগ্রাম ধান হতে লাগে ৩৪০০ লিটার জল। সেখানে এক কিলোগ্রাম গম তৈরি হতে লাগে ১৩০০ লিটার জল। ভুট্টা, বাজরার মতো ফসল ফলাতে আরও কম জল লাগে। আর এক কিলোগ্রাম মাংস হতে ১৫,৫০০ লিটার জল লাগে। থালার পাশে যাতে জলভরা গেলাসটি থাকে, খাদ্যশস্য কিংবা পশুখাদ্যের জোগান ধরে রাখতে যদি হয়, তবে খাওয়ার পাতে বসেও ভাবতে হবে, কতটা জল গিয়েছে এই খাবার উৎপন্ন করতে। কথাটা যদি বিশ্বাস না হয়, মনে করুন কয়েক সপ্তাহ আগে তেষ্টার জলের জন্য চেন্নাইবাসীদের লম্বা লাইন।
ভারতে চাষের পঁচাশি শতাংশ ভূগর্ভস্থ জলস্তরের উপর নির্ভরশীল। কৃষিতে ভূগর্ভস্থ জলের অতি-ব্যবহারের ফলে পঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের পশ্চিম দিকে ভূগর্ভস্থ জলের প্রথম স্তর আগামী পনেরো বছরে ফুরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর একটা কারণ, যে সব অঞ্চলে চির কাল গম, ভুট্টা, বাজরা-জাতীয় কম পিপাসু ফসলের চাষ হত, সেখানে এখন ধান ও আখের চাষ হচ্ছে।
জলের অভাবের জন্য খাদ্যের অভাব দেখা দিতে পারে বিশ্বজুড়ে, বলছে একটি সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন। রাষ্ট্রপুঞ্জ বাহান্নটি দেশের একশো আট জন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে গড়েছিল জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক উপদেষ্টামণ্ডলী। ৮ অগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনে তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এই প্রথম পৃথিবীর প্রধান খাদ্য উৎপাদক দেশগুলিতে একসঙ্গে জলাভাব হতে চলেছে। ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে। কোপ পড়বে গরিবের উপরেই বেশি। তবে এই প্রতিবেদনের অন্যতম প্রণেতা, নাসা-র সিন্থিয়া রোজ়েনৎজ়োয়াইগ বলছেন যে, এখনই সব দেশ পূর্ণ উদ্যমে সচেষ্ট হলে জলসঙ্কট রোখা যেতে পারে।
তার কয়েকটা দীর্ঘমেয়াদি উপায় রয়েছে, যেমন গাছ লাগানো। একটা-দুটো নয়, এক লক্ষ কোটি গাছ। গ্রিনহাউস গ্যাস কমিয়ে বায়ুমণ্ডলের তাপ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে তার চাইতে কমে হবে না। আর দরকার জীবাশ্ম-জ্বালানির বদলে বিকল্প শক্তির (সৌর, বায়ু, সমুদ্রতরঙ্গ, পারমাণবিক) ব্যবহার। বাতাস থেকে যন্ত্র দিয়ে কার্বন ডাইঅক্সাইড নিষ্কাশনও করা যেতে পারে। কিন্তু গাছ রাতারাতি বড় হয় না। বিদ্যুতে অপ্রচলিত শক্তি ব্যবহার করতে আজ থেকে প্রাণপণ চেষ্টা করলেও কাজ হতে সময় লাগবে। অথচ ভারত-সহ সতেরোটি দেশে জলসঙ্কট এখনই শুরু হয়ে গিয়েছে। অনেকে মনে করেন, ভারতের হাতে পাঁচ বছরের বেশি সময় নেই। যে কাজগুলো এখনই করলে জলসমস্যা খানিকটা মিটতে পারে, সেগুলি হল জলের সঞ্চয়, অপচয় থামানো, জলসৃজন ও ন্যায্য জলবণ্টন।
পৃথিবীতে নোনাজলই বেশি। মিষ্টি জল মাত্র দুই শতাংশ, তারও বেশিটা দুই মেরুতে বরফ হয়ে আছে। স্রেফ ০.৫ শতাংশ ব্যবহারের যোগ্য। বিশ্ব-উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রের জল বাড়ছে, মিষ্টি জলের অনুপাত কমছে। ভারতের মিষ্টি জলের ছিয়াশি শতাংশ আসে বৃষ্টি থেকে, বাকিটা তুষারপাত থেকে। বছরে ত্রিশ-চল্লিশ দিন ভাল বৃষ্টি হয়, সেই দিনগুলির সংখ্যাও কমছে। নির্ভরতা বাড়ছে ভূগর্ভের জলের উপর। বর্ষায় নদীর জল দুই পাশের জমিকে প্লাবিত করে, সেই জল চুঁইয়ে ভূগর্ভের জলস্তরে সঞ্চিত হয়। বড় গাছের শিকড়গুলি ভূগর্ভস্থ জলস্তরে জলসঞ্চয়ে সাহায্য করে। এই জলস্তরগুলিই এখন ভারতের প্রাণবারি। নদীর দু’ধারের জলাভূমি ও প্লাবন-সমতলে বাড়ি নির্মাণ ভূগর্ভে যেতে দেয় না জলকে। তাই ‘কী খাব’, এ প্রশ্ন যেমন করতে হবে, তেমনই ভাবতে হবে, ‘কোথায় থাকব’। জলের পথরোধ করে, বন কেটে যে নির্মাণ, তাকে বর্জন করতে হবে। আর দরকার বাড়িতে জলের নল ও হাইড্র্যান্টের স্বাস্থ্যপরীক্ষা। তাদের ছিদ্র সারাতে পারলে প্রতি দিন লক্ষ লক্ষ লিটার জল বাঁচে।
নতুন প্রযুক্তিও কাজে লাগাতে হবে। সমুদ্রের জল নুনমুক্ত করে মিষ্টি জল বানাতে পারলে অভাব অনেকটাই মেটে। ভারত-সহ কিছু কিছু দেশে আরম্ভ হয়েছে। কিন্তু ভারতের নুনমুক্তির কেন্দ্রগুলিতে যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়, তা কয়লা, ডিজেল বা গ্যাস পুড়িয়ে তৈরি। তা থেকে নিঃসৃত গ্যাস বায়ুমণ্ডলের তাপ বাড়ায়। ইজ়রায়েল সৌরশক্তিতে জলের কারখানা চালায়। ভারত পারে না কেন?
এ ছাড়াও, পেরুর পার্বত্য অঞ্চলে স্বল্পব্যয়ে কুয়াশা-ধরা জাল থেকে পানীয় জল মিলছে। লিমা অঞ্চলে এক-একটি জালে দিনে দু’শো থেকে চারশো লিটার জল তৈরি হয়। ভারতের কুয়াশা-বহুল পার্বত্য অঞ্চলগুলিতেও এ ভাবে জলসৃজন হতে পারে। ইজ়রায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে যন্ত্রের সাহায্যে হাওয়া থেকে জল আহরণ করা হচ্ছে। উষ্ণায়নের ফলে বায়ুর আর্দ্রতা বেড়ে গিয়েছে, তাকে কাজে লাগিয়ে পানীয় জল সংগ্রহ করা যায়।
জলসমস্যা সমাধানের প্রকল্পগুলি সবই ব্যয়সাপেক্ষ। পানীয় জলের জোগান বজায় রেখে যাওয়ার আর্থিক চাপ বহন করতে হবে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল নগরবাসীদের, যাতে গরিবরাও জল পান। আন্দাজ করা যায়, এ নিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হওয়া সময়ের অপেক্ষা। এখন থেকে এ নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে কথাবার্তা শুরু করা চাই।
আইনস্টাইন কলেজ অব মেডিসিন, নিউ ইয়র্ক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy