মত প্রকাশের স্বাধীনতা নামক একটি অধিকার ভারতীয় সংবিধান নাগরিককে দিয়া রাখিয়াছে। সংবিধানের সব কথা সম্ভবত রাষ্ট্রের পছন্দ নয়। তাই অনেক সময় ব্যক্তির সেই অধিকার কাড়িয়া লওয়ার বা খর্ব করার চেষ্টা চলিতে থাকে। ব্যক্তির যৌন পছন্দের অধিকার তথা সমকামিতার অধিকার খর্ব করার বিধি এমনই একটি আয়োজন। ভারতীয় রাষ্ট্রাচালকরা যে এখন সেই আয়োজনেই ব্যাপৃত, তাহার প্রমাণ মিলিল রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদে। সম্প্রতি সংস্থার সমকামী কর্মচারীদের জন্য চাকুরির সমান সুযোগসুবিধা মঞ্জুর করার মহাসচিবের নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করিয়া রাশিয়ার আনা প্রস্তাবে যে ভোটাভুটি হয়, তাহাতে ভারতের ভোট গিয়াছে রুশ প্রস্তাবের পক্ষে, অর্থাৎ সমকামী কর্মচারীদের সমান সুযোগসুবিধা প্রাপ্তির বিরুদ্ধে। সৌভাগ্যবশত প্রস্তাবটি বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাস্ত হয়। কিন্তু কথা হইল: রাষ্ট্রপুঞ্জে কর্মরত সমকামী দম্পতিদের সমানাধিকারের বিরুদ্ধে কাহাদের সহিত এক পঙ্িক্ততে দাঁড়াইয়া ভারত ভোট দিয়াছে? তালিকাটি চমকপ্রদ। পাকিস্তান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, ওমান, কাতার, কুয়ায়েত, মিশর, ইরাক, ইরান, জর্ডন। এই ইসলামি রাষ্ট্রগুলির সহিত এক সুরে ভারতীয় প্রতিনিধি সমকামীদের বিরুদ্ধে সওয়াল করিয়াছেন। এ ব্যাপারে শরিয়তি বিধান নিয়ন্ত্রিত ওই সব ইসলামি রাষ্ট্রের সহিত গলা মিলাইতে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের কোনও অসুবিধা হয় নাই।
অথচ প্রশ্নটি কিন্তু সমকামিতা সমর্থন বা বিরোধিতার ছিল না, ছিল সাম্য ও সমানাধিকারের, যাহা শেষ বিচারে মানবাধিকারেরই প্রশ্ন। এমন একটি প্রশ্নে নয়াদিল্লির অবস্থান যে ইসলামি ও শরিয়তি মতাদর্শ নিয়ন্ত্রিত মুসলিম রাষ্ট্রগুলির সহিত একাকার হইয়া গেল, তাহাতে স্পষ্ট সামাজিক প্রগতির প্রশ্নে ভারত অনগ্রসর, পশ্চাৎপদ, প্রতিক্রিয়াশীল, মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণার নিগড়েই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। প্রাগ্রসর পাশ্চাত্য, এমনকী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নবোদিত অর্থনৈতিক শক্তিগুলির সঙ্গেও পাল্লা দিবার মতো আধুনিক আয়ুধ তাহার ভাণ্ডারে মজুত নাই। ২০০৯ সালে দিল্লির একটি আদালত ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ অনুচ্ছেদের সংশোধন সাপেক্ষে সমকামিতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধের তালিকা হইতে নির্বাসিত করে। দেশের কোটি-কোটি সমকামীর উচ্ছ্বাসের লগ্ন অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয় নাই। গত বছরই সুপ্রিম কোর্ট ৩৭৭ ধারা বহাল রাখিয়া সমকামিতা বিষয়ে রাষ্ট্রীয় অবস্থান পরিবর্তনের ভার দেশের আইনসভার উপরেই ন্যস্ত করে। সেই আইনসভায় যাঁহাদের গরিষ্ঠতা, তাঁহারা সমকামিতাকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অবক্ষয়ী অনুসরণ বলিয়া গণ্য করেন। এ জন্যই তাঁহাদের প্রতিনিধি রাষ্ট্রপুঞ্জে আনীত রুশ প্রস্তাবটি সমর্থন করিলেন।
দুইটি বিষয় স্পষ্ট। এক, ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি ও যৌনতার ইতিহাস যাহাই বলুক, ইতিহাস-অজ্ঞ শাসক গোষ্ঠী সমকামিতা বিষয়ে রক্ষণশীলতার ধ্বজাটি ছাড়িতে রাজি নহে। ভারতীয় সমাজ এবং রাষ্ট্র ব্যক্তির পছন্দের স্বাধীনতাকে ভয় পায়। এই স্বাধীনতা যেহেতু সমাজের বাঁধিয়া দেওয়া ছক ও ছাঁচের বাহিরে, তাই ইহার অনুশীলনে সমাজ বিদ্রোহ ও উপপ্লবের লক্ষণ খুঁজিয়া পায়, যাহা স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে। দুই, সমকামিতা কিংবা অনুরূপ যৌন পছন্দের স্বাধীনতা বা অধিকার আদায়ের সমর্থন দিতে যাহারা অরাজি, ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও মানবাধিকার লইয়া বড়-বড় কথা আন্তর্জাতিক মঞ্চে শুনাইবার অভ্যাস তাহাদের ত্যাগ করা উচিত। অথচ এই অভ্যাস ভারতীয় কূটনীতিকদের চিরকালই প্রবল। দেশকে হাস্যাস্পদ না করিয়া জাতীয় নীতি-নির্ধারকরা স্পষ্ট বাছিয়া লউন: অধিকারের আলো না কি অনধিকারের অন্ধকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy