২০০৭ এএফসি এশিয়ান কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইরাক। তখন মার্কিন সেনাবাহিনী সে দেশ দখলে মরিয়া, প্রবল লড়াই চলছে, তার ওপর গৃহযুদ্ধ। দলের জয়ের পর ইরাকি মিডফিল্ডার আহমেদ মানাজিদ বলেন, যদি তিনি দেশের হয়ে ফুটবল না খেলতেন, তা হলে নিজের ফল্লুজাহ শহরে গিয়ে মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতেন। ও দিকে, ইরাকের জয়ের কৃতিত্বের ভাগীদার হওয়ার চেষ্টায় রাজনৈতিক মঞ্চে ইরাকের সাফল্য সম্পর্কে সাতকাহন করে বলতে শুরু করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জুনিয়র জর্জ ডব্লিউ বুশও। যদিও তাঁর সমালোচনায় মুখর হয় ফুটবল-বিশ্ব। ইরাকের ব্রাজিলীয় কোচ হোরভান ভিয়েইরা বলেন, ‘এটা শুধু ফুটবলের ব্যাপার নয়, কোনও টিমের ব্যাপার নয়, মানবসভ্যতার ব্যাপার।’ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পক্ষে এশিয়ার সেরা ফুটবল টুর্নামেন্ট জেতা যে কত বড় ঐক্যের ছবি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই জয় নিয়ে সঙ্কীর্ণ রাজনীতি করা ব্যক্তি যে আসলে দুষ্টু লোক, তা-ও কি বলার অপেক্ষা রাখে?
এবং, মার্কিন ফুটবলে তখন যদি মেগান র্যাপিনোর (ছবিতে) মতো কেউ থাকতেন, কে জানে, হয়তো বুশকেও তাঁর জাঁদরেল উত্তরসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো এ সব কথা মুখের ওপরেই বলেই দিতেন।
মার্কিন মহিলা ফুটবল দলের গড় বেতন পুরুষ দলের চেয়ে প্রাথমিক স্তরে ৩০ হাজার টাকা কম। অথচ মেয়েরা বিশ্বের সেরা ষোলোয়, ছেলেরা নেই। টিভি রেটিংয়ে চার বছর ধরে এগিয়ে মেয়েরা। সেই ক্ষোভে গত মার্চ মাসে আমেরিকান ফুটবল ফেডারেশনের বিরুদ্ধে লিঙ্গবৈষম্যের মামলা করেন মেয়েরা। দেশবাসী চমকে যায়, কেননা মাস কয়েকের মধ্যেই যে বিশ্বকাপ! তবু একবগ্গা মেয়েরা দুই যুদ্ধের প্রস্তুতিই চালাতে থাকেন। জয়ীও হন। অধিনায়কের মতোই সে সবের নেতৃত্ব দেন মেগান।
মেগান কে? তিন বছর আগে পুলিশি অত্যাচার ও জাতিবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে জাতীয় সঙ্গীত চলাকালীন হাঁটু মুড়ে বসে পড়া ফুটবল অধিনায়ক তিনি। বক্তব্য ছিল, ‘এই রাষ্ট্র তার নাগরিকদের উপর যে অত্যাচার করছে, তাতে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।’ দাঁড়ানোর জন্য আইন পাশ করেও মেগানকে ঠেকানো যায়নি। এই বিশ্বকাপে জাতীয় সঙ্গীতের সময় চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি, বুকের ওপর হাতও রাখেননি। ট্রাম্প ব্যঙ্গ করেছিলেন: ‘এর মধ্যে প্রতিবাদ কোথায়!’ মেগানের প্রতিবাদ কঠোরতর— ‘কাপ জিতলেও হোয়াইট হাউসে যাব না।’ কোয়ার্টার ফাইনালে দলকে জিতিয়ে ‘যাব না’ আরও দৃঢ় হয়। প্রেসিডেন্টের কটাক্ষ: ‘আগে তো জিতুন!’ মেগান বলেন, ‘না জিতলেও যাব না।’ শেষ অবধি জেতেন। এবং যান না। ট্রাম্পকে অবশ্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে শুভেচ্ছা জানাতেই হয়। মেগান ঘোষণা করেন, ‘আমি গভীর ভাবে আমেরিকান।’ তিরের লক্ষ্য স্পষ্ট।
মেগান কেন এমন? তাঁর নিজের যুক্তি তিনটে। প্রথমত, জন্ম থেকেই তিনি নাকি কিছুটা উদ্ধত! সাফ কথা: খেলা যদি বিনোদন হয়, তা হলে এত কথা বলার কী আছে? তাই তিনি ট্রাম্প-সহ সব নিন্দুককে বোঝাতে চেয়েছেন, ফুটবলারদের থেকে জয়ের আনন্দ কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। মাঠে তিনি খেলতে এসেছেন, পছন্দ হলে হাততালি দিন। দ্বিতীয়ত, ফাইনালে জেতার পরে বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করেন মেগান। সমকামী ফুটবলারের এই ভালবাসার উদ্যাপন এলজিবিটি আন্দোলনের ‘বিবৃতি’ হয়ে দাঁড়ায়। মেগান যুক্তি দেন, এত বড় মঞ্চ পেলে নিজের মতাদর্শকে তুলে ধরতেই হবে। সমকামী হিসেবে বড় হয়ে ওঠাই তো তাঁর জীবনকে এই খাতে বইয়েছে। জীবনে যে ভাবে বড় হয়ে উঠেছেন, ক্ষমতার গালে চড় মেরে হলেও, সে ভাবেই বাঁচবেন। তৃতীয়ত, প্রেসিডেন্টকে মুখের ওপর জবাব দিতে না পারলে অসংখ্য মানুষের প্রতি অবিচার করা হয় বলে মনে করেন মেগান। যে শিশুরা সীমান্তে বন্দি হয়ে আছে, বা আমেরিকায় ঢুকতে গিয়ে মারা যাচ্ছে, তাদের প্রতি অন্যায় যখন প্রেসিডেন্টকে বিব্রত করে না, তখন মেগানই বা হোয়াইট হাউসে গিয়ে প্রেসিডেন্টকে বিব্রত করেন কেন!
উপদেশ এসেছে— ‘খেলা নিয়ে থাকুন।’ কিন্তু ‘শুধু-খেলা’র মতো অলীক কিছু হয় নাকি? মেগানের জবাব: ‘এত বড় জাতীয় মঞ্চ পেলে তার মাধ্যমে মানুষকে একতাবদ্ধ করার চেষ্টা আমি করবই।’ সবাইকে বামপন্থী করা তাঁর লক্ষ্য নয়, কিন্তু আলাপে তো বসতে পারেন সকলেই। তাঁর বার্তা, প্রত্যেক মানুষের দায়িত্ব সমাজকে আরও সুন্দর করে গড়ে তোলা, যে যতটুকু পারে। তাঁর লক্ষ্য, নাগরিকেরা আত্মশক্তিতে বিশ্বাস রেখে নিজেদের পরিবার ও সমাজ ও দেশ চালানোয় আরও সক্রিয় হন। স্লোগান তোলেন: ‘ইটস টাইম টু কাম টুগেদার’।
‘অ্যাথলিট অ্যাক্টিভিজ়ম’ কথাটা অপরিচিত নয়। ১৯৮৬’র বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিল দিয়েগো মারাদোনার দল। বিশ্ব জুড়ে হইচই। কিন্তু ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’র চেয়েও আর্জেন্তিনীয়দের কাছে মধুর হয়ে উঠেছিল ফকল্যান্ড যুদ্ধের প্রতিশোধ।
কূটনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি— ক্ষমতার অমোঘ স্তম্ভগুলোকে এক সঙ্গে নড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে একমাত্র খেলার। ট্রাম্পরা মানুষকে টুকরো করেন, আর মেগানরা প্রাণপণে জোড়েন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy