ছবি: সংগৃহীত
ছেলে বলল, ‘বাবা, আজ আবার ইংরেজি ক্লাসে মুরগি।’ শিশুশ্রেণিতে পড়া ছেলের মুখে সেদিন এরকম বড়দের বাচন বেশ একটু অবাক করল। কিন্তু বিস্ময়টা চেপে রেখে আসল কথাটা জানার জন্য তাকালাম ওর দিকে। ছেলে বলল—‘স্যার খাতায় আগেই লিখেছিলেন। তবু তোমার কথা শুনে ‘hen’ মানে ‘মুরগি’ লিখে নিয়ে গিয়েছিলাম। স্যার, ‘মুরগি’র ‘গি’ কেটে ‘গী’ করেছেন।’’
ইংরেজি ক্লাসের ‘মুরগি’টা তা হলে ‘মুরগী’ ছিল! স্বস্তি পেলাম, বাচনে ছেলে বয়সের চেয়ে বয়সী হয়ে যায়নি বলে। চিন্তায়ও পড়ে গেলাম আর একটা কারণে। ফার্সি ‘মুর্গ’ শব্দ থেকে বাংলায় আসা শব্দটার বানান ‘মুরগি’ই তো লিখে আসছি বহু দিন। অতৎসম স্ত্রী-কারান্ত শব্দে ঈ আগে দেওয়া হলেও এখন ই দেওয়াই বিধি। সুতরাং ‘hen’ এর বাংলা অর্থের বানান ভুলও লিখি না। তা হলে?
বানান-বিধি এখনও ছেলের শিশুশ্রেণিতে ‘মুরগী’কে ছোঁয়নি এটা অবশ্য খুব বড়সড় ঘটনা নয়। চারদিকে বাংলা বানানের যে দশা চোখে পড়ে, তার তুলনায় বলা যায়, এটা কিছুই নয়। সত্যি বলতে কী, আমাদের ভাষাটা হিন্দি ইংরেজির আগ্রাসনে যতটা সঙ্কটাপন্ন, ভুল বানানের কারণে তার চেয়ে কোনও অংশে কম সঙ্কটাপন্ন বলে মনে হয় না।
বানান শব্দটি এসেছে ‘বর্ণন’ থেকে। বর্ণন কিন্তু শুধু বর্ণ পারম্পর্যের বিবৃতি নয়, বর্ণন একটা মূর্তিও বটে। বর্ণন ঠিক মতো না হলে, বিচ্যুতি ঘটলে, সে-ও তো মূর্তি ভাঙারই শামিল। মাতৃভাষা নিয়ে ভাবতে গেলে এই মূর্তিভাঙার বিষয়টিকে কিন্তু বিবেচনা করা দরকার গুরুত্ব দিয়ে।
কিছু শব্দের বাংলা বানান নিয়ে নানা মত রয়েছে আজও। কিন্তু সমতাও তো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নিত্যব্যবহার্য অধিকাংশ শব্দের বানানে। সেগুলোতে কেন বিচ্যুতি থাকবে?
যাই / যায়, পাই /পায়, কি / কী-এর প্রয়োগ শেখানো হয় শৈশবেই। কিন্তু স্কুলের খাতায়, ফেসবুকের মডার্ন কবিতায়, এমনকি শিক্ষিত জনের মননশীল প্রবন্ধেও ‘যাই’ ‘যায়’ হয়ে বসে থাকে। ‘কী’ ‘কি’-এর পার্থক্যও করা হয় না।
অনেকে বলেন, বাংলা বানানের নানা ফ্যাকড়া, সব জেনে বুঝে ওঠা কঠিন কর্ম এবং সব জানার দরকারও নেই। চিঠি লেখার পাট চুকেছে সেই কবে। ডায়েরি লেখার অভ্যেস বাঙালির কোনও কালে যে ছিল, তা আজ মনেও পড়ে না। এটা ফোনের যুগ। ফেসবুক, হোয়াট্সঅ্যাপে কথার আদানপ্রদান করতে গেলে বাংলা লিপিতেই করতে হবে, এমনও কথা নয়। ‘তুমি কেমন আছ’ তো ‘tumi kemon acho’ দিয়েও বোঝানো যায়।
এর বাইরে আর একদল আছেন, যাঁরা বানান নিয়ে কোনও নিয়মনীতিরই তোয়াক্কা করেন না। এঁদের ভাব-ভাবনা জ্যোতিভূষণ চাকীর সেই ছড়াটার মতো–‘বানান মানেই হল বানানো / বানানে মিথ্যে মাথা ঘামানো, / হ্রস্ব ই, দীর্ঘ ঈ যা আসে তাই সই, /বা নানে যা চার তাই চারশো/সব কিছুই আর্ষ।’
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘স্বর্গের বারান্দা’ গল্পের শিক্ষয়ত্রী বন্দনা ভুল বানানে চিঠি লিখেছিলেন গল্পের নায়ককে। ভুল বানানের যুক্তি দেখিয়েছিলেন, তিনি অঙ্কের টিচার, বাংলা বানান তাঁর ভাল না জানলেও চলে। বাংলা বানানের সমতাবিধান অনেকটা হলেও, সে সব খোঁজ না রেখে, ভুলের ক্ষেত্রে অনেক সময় বন্দনার মতো যুক্তিও শোনা যায়। ফলে ব্যাপারটা অনেক সময় দাঁড়িয়ে যায় অন্য আর এক সমীকরণে। মনে হয় সঠিক বানান লেখার দায় বাংলাভাষায় যাঁরা শিক্ষাদান করেন বা শিক্ষিত হন শুধু যেন তাঁদেরই। আমরা ভুলে যাই, একদা এই বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন বরকতরা। ভাইয়ের রক্তে রাঙানো সেই ভাষায় ভুল করার অধিকার নেই।
কিন্তু শুনছে কে? এ সবের নিট ফল, প্রতিদিন মূর্তিভাঙা। কোথায় নয়?
বিজ্ঞাপন, পোস্টার, সাইনবোর্ড, দেওয়াল লিখন, উৎসব পার্বণের নিমন্ত্রণ-পত্র সর্বত্র। এখন আবার শোনা যাচ্ছে, মাধ্যমিকে বাংলা ও ইংরেজি বাদে অন্য বিষয়ের উত্তরপত্রে বানান ভুল হলে তাতেও দৃষ্টি দেওয়া চলবে না। ভুল বানানের কারণে শিব গড়তে গিয়ে শিবা হলে তাকেই পুজো করতে হবে শিব জ্ঞানে।
বাংলা বানান ঠিকঠাক লেখা তা হলে কি খুবই কঠিন? আমরা আমাদের সেই অভাবী-ছেলেবেলাতেও প্রায় প্রত্যেকে বাড়িতে অন্তত একখানা করে বাংলা অভিধান পেয়েছি। সংশয় হলে উল্টে নিয়েছি সে অভিধান। অভিধানে কোনও শব্দ না পেলে বিরক্ত করেছি কাছের জনেদের। এখন নেটের যুগ। সঠিক বাংলা বানান জানতে সব সময় অভিধানও উল্টোতে হয় না। অথচ এ বাবদে কোনও সময় ব্যয় করতেই যেন নারাজ এখনকার প্রজন্ম!
বানান শেখার ব্যাপারটা একবারে নীরস তাও নয়। এর ভিতরেও কত গল্প রয়েছে। রয়েছে কত মজাদার টোটকা! রবীন্দ্রনাথের কথাই ধরা যাক। শোনা যায় ‘ব্যথা’ বানান শেখাতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ একবার ছাত্রদের মৃদু চিমটি কেটে শুধিয়েছিলেন তাদের অনুভূতি। একেক জন একেক রকম উত্তর দিলে কবি স্মিত হেসে বলেছিলেন-‘তা হলেই দ্যাখ, ব্যথার কোনও আকার নেই।’ ‘আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ’ বইতে রানী চন্দ প্রায় এরকম একটা ঘটনা লিখে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ তখন যা বলেন, রানী চন্দ লিখে নেন খাতায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের তীক্ষ্ণ নজর সে-লেখার দিকে। একদিন ‘শূন্য’ লিখতে গিয়ে ‘ন’র জায়গায় ‘ণ’ লিখে ফেললেন রানীদেবী। রবীন্দ্রনাথ হাসিমাখা চোখে ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে ‘ণ’র মাথাটা চেপে ধরে বললেন-‘একে তো শূন্য, তার আবার অত মাথা উঁচু করা কেন!’
বিশ্বভারতীর অধ্যাপক প্রাবন্ধিক বিশ্বজিৎ রায় শৈশবে কীভাবে বাংলা বানান শিখেছিলেন সে অভিজ্ঞতা পড়েছিলাম তাঁর একটি লেখায়। বেশ মনে ধরেছিল ‘আবিষ্কার’, ‘পুরস্কার’ জাতীয় বানান কীভাবে ঠিক লেখা যায় সে ব্যাপারটা। ‘ইষ্কার’ যোগ হলে ‘ষ’ কিন্তু ‘অস্কার’ যোগ হলে ‘স’। মজার এই টোটকাটা জানা থাকলে আর কী ভুল হবার সম্ভাবনা থাকে পরিষ্কার, পুরস্কার জাতীয় বানান লেখায়!
ছোটবেলায়, স্কুল যাতায়াতের পথে পাড়ার মোড়ে মোড়ে বসে থাকা বয়স্ক অভিভাবকদের অনেকে আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে শুধোতেন সেই বয়সে সহজে ভুল করে ফেলার মতো নানা বাংলা বানান। ‘শ্রীচরণেষু’, ’মনোমোহন’ ‘দ্বন্দ্ব’, আরও এমন সব। বার বার জিজ্ঞাসায় এ সব অনেক প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানাই থাকত। তবু কেউ কোনও বানান না পারলে তাকে ভর্ৎসনা করতে ছাড়তেন না তাঁরা। বানান পারা না-পারা দিয়েই তাঁরা আমাদের শিক্ষার মূল্যায়নও করে ফেলতেন চটজলদি। স্ব-নিযুক্ত সেই ভাষা-পরীক্ষকদের আজ হয়ত ফিরে পাব না। কিন্তু বাংলা বানান নিয়ে এই যথেচ্ছচারের যুগে মনে হয় মূল্যায়নটা আবার ফিরে আসুক। মাতৃভাষাটা ভুল বানানের হাত থেকে রেহাই পাক।
তথ্যঋণ: জ্যোতিভূষণ চাকি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy