Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Chadwick Boseman

মৃত্যুতে রাজকাহিনি ফুরোয় না

স্বল্পজীবন ও অকালপ্রয়াণে বুঝি তার প্রমাণই রেখে গেলেন চ্যাডউইক।

চিরশ্রী মজুমদার
শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

আফ্রিকার লেক ভিক্টোরিয়ার কাছাকাছি যে ঘন জঙ্গল, সেখানে এক অদৃশ্য দেওয়াল আছে। সেটি ভেদ করতে জানলে ওয়াকান্ডা-য় পৌঁছনো যায়। বহির্বিশ্বের কাছে লুকানো অত্যাধুনিক এই দেশের রাজা টি’চালা। তিনিই সুপারহিরো ব্ল্যাক প্যান্থার। মার্ভেল সিনেমা-বিশ্বে তাঁর আবির্ভাব ক্যাপ্টেন আমেরিকা: সিভিল ওয়ার সিনেমায়। রহস্যে ঘেরা তাঁর নিনাদ: ‘‘আমাদের সংস্কৃতিতে মৃত্যু সমাপ্তি নয়।’’ তখনই তাঁর স্বদেশকে জানবার তাগিদ বেড়ে যায়। তৃষ্ণা মেটে ব্ল্যাক প্যান্থার ফিল্মে। আর টি’চালা রূপে মনে চিরতরে গেঁথে বসেন অভিনেতা চ্যাডউইক বোসম্যান। অনুরাগীদের বিশ্বাস জন্মায়, চ্যাডউইকই রক্ষক, তিনিই ব্ল্যাক প্যান্থার।

স্বল্পজীবন ও অকালপ্রয়াণে বুঝি তার প্রমাণই রেখে গেলেন চ্যাডউইক। রাজকীয়তা, গ্রেস, ক্যারিশমা ছিল তাঁর সহজাত। অসাধারণ কণ্ঠস্বর। যখনই কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতির কোনও ‘আইকন’-কে পর্দায় ফোটানোর প্রয়োজন পড়েছে, ডাক পড়েছে চ্যাডউইকের। এ ভাবেই গত সাত বছরে ‘ব্ল্যাক পপ কালচার’-এর যুবরাজ হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

হাইস্কুলে পড়ার সময় থেকেই বোঝা গিয়েছিল, ফিল্ম-থিয়েটারের রাস্তাটাই চ্যাড-এর ভবিতব্য। কিন্তু সেই সিংহাসনের পথে বছরের পর বছর নিহিত জাতিবিদ্বেষের কাঁটা বিছিয়েছে হলিউড। ২০১৩-য় আফ্রো-আমেরিকান বেসবল খেলোয়াড় জ্যাকি রবিনসনের বায়োপিক ৪২-এ চ্যাড সেই দশ বছরের প্রতিরোধ ও লাঞ্ছনাকে ঘণ্টা দুয়েকেই গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর পেশিশক্তি আর ফিটনেস দেখে রটে গিয়েছিল, বোসম্যান সুপারহিউম্যান!

৪২-এর সুপারহিরোইজ়ম, মার্শাল-এর মগজাস্ত্র এবং গেট অন আপ-এর সংবেদন: এই সব দেখেশুনে ব্ল্যাক প্যান্থার চরিত্রের ‘আলফা-মানব’ নির্বাচনে এক মুহূর্তও লাগেনি। ২০১৮-র এই ব্লকবাস্টারে চোখ ছানাবড়া করা প্রযুক্তির সঙ্গেই ছিল চোখধাঁধানো আফ্রিকান সাফারি। ধোঁয়াটে জলপ্রপাতের পাশে শিকারের মুখোশ পরে মাসাই-সোয়াহিলি ছন্দে শরীর দোলায় জনজাতি। এম’বাকু, ওকোয়ে, নাকিয়া’দের দাপটে শোণিত উদ্দাম হয়। ব্ল্যাক প্যান্থারকে (ছবিতে) দেখামাত্র বুকে হাত রেখে অভিবাদন জানাতে ইচ্ছে করে। শ্রেষ্ঠ পুরস্কার মঞ্চে মার্ভেল সাধারণত বিফল। সেই কুলীনবৃত্ত থেকেও সম্ভ্রম ছিনিয়ে আনেন আফ্রিকার রাজা!

কৃষ্ণাঙ্গ জীবনচর্যার ইতিহাসে ‘ব্ল্যাক প্যান্থার বিপ্লব’ এক বিরাট সন্ধিক্ষণ। সিনেমাটির পরিচালক, কলাকুশলীদের সিংহভাগই অসিতবর্ণ। সে সময় কৃষ্ণাঙ্গদের সুযোগ দিতে হলিউডের অনীহা নিয়ে বিক্ষোভ চলছে। ‘অস্কার ইজ় সো হোয়াইট’ অভিযোগের তিরে অ্যাকাডেমি পুরস্কারের মর্যাদা ছিন্নভিন্ন। ঠিক তখনই ব্ল্যাক প্যান্থারের এমনধারা কর্তৃত্ব-কায়েম শুধুই ‘পলিটিকালি কারেক্ট’ থাকার প্রয়াস নয়। এই মহাখ্যানকে কুর্নিশ বিনা উপায় ছিল না। ঔপনিবেশিকতা ও পিতৃতন্ত্রের রূপকল্পটাকেই তো পরিহাসে পরিণত করেছিলেন পরিচালক রায়ান কুগলারের দলবল। প্রথম বিশ্বের সীমাবদ্ধতাগুলি করুণার চোখে দেখে ওয়াকান্ডা। আবার, তাদের পুরুষসিংহকে রক্ষা করেন অপরাজেয় মহিলা যোদ্ধারা! রাজার বোন শূরি বিজ্ঞানে ও স্মার্টনেসে খোদ আয়রনম্যান-কে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা ধরেন।

কৃষ্ণাঙ্গরা জাতীয় পোশাক পরে ফিল্মটি দেখতে এসেছিলেন। নিজের বর্ণের জৌলুস দেখে সগৌরবে টি’চালা-র মূর্তি আঁকড়ে ধরছিল কৃষ্ণাঙ্গ শৈশব। এই উন্মাদনা দেখে অশ্বেতাঙ্গদের জাতিগত স্বকীয়তায় মার্ভেল গুরুত্ব দিতে আরম্ভ করে। অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম-এ টি’চালার ভূমিকা বাড়ে। ব্ল্যাক প্যান্থার পরবর্তী পর্ব নিয়ে পরিকল্পনা শুরু হয়। এই আমূল পরিবর্তনেরও নায়ক ছিলেন চ্যাডউইক।

সুপারহিরোর ওই স্যুটের ভিতরে রোগযুদ্ধকে আড়ালে রেখেছিলেন ওয়াকান্ডানদের মতোই গোপনীয়তায় বিশ্বাসী চ্যাড। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ যূথবদ্ধ অভ্যুত্থান হয়ে ওঠার আগে থেকেই তার ভার বইছিলেন রাজপুত্র। কৃষ্ণাঙ্গ কিংবদন্তিদের জন্মদিনে উৎসব উদ্‌যাপন করতেন চ্যাডউইক। সম্মাননামঞ্চে কৃষ্ণকায় জীবনের অভিনবত্ব ব্যাখ্যা করতেন। আজ, আন্দোলনের এমন সঙ্গিন মুহূর্তে স্বয়ং যুবরাজ কী ভাবে নিদ্রা যেতে পারেন? তাঁর সাম্রাজ্যবিস্তারের এই তো মাহেন্দ্রক্ষণ। মার্ভেল সুপারহিরোদের নেতৃত্বে এগিয়ে আসছেন ব্ল্যাক প্যান্থার। শেক্সপিয়রের চরিত্রগুলিতে চ্যাডকে ভাবছেন চিত্রনির্মাতারা।

তাঁর শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ডা ফাইভ ব্লাডস-এ বিখ্যাত উক্তি ছিল, ‘‘উই ডোন্ট ডাই। উই মাল্টিপ্লাই।’’ হয়তো তাই। শরীরে মাটিচাপা পড়েছে। আর তাঁর আত্মা, উত্তরাধিকার, শক্তি শতগুণ হয়ে মিশে গিয়েছে কালো মানুষদের অসীম প্রতাপে।

মার্ভেল-ভক্তরাও বিশ্বাস করে না, ২৮ অগস্ট তিনি প্রয়াত হয়েছেন। কিলমঙ্গার যাঁকে খাদে ফেলেও মারতে পারেনি, থ্যানোস যাঁর অস্তিত্ব মুছে দিতে পারেনি, ক্যানসার রোগ তাঁর কী করবে? হৃদয়াকৃতি ভেষজের স্পর্শ পেলেই তো উঠে দাঁড়াবেন তিনি! সম্ভবত, তাই-ই হয়েছে ওয়াকান্ডা নামক সেই এল ডোরাডো-র দেশে। ব্ল্যাক প্যান্থার সেই অদৃশ্য দেওয়ালের ও পার থেকেই এ পারের সীমাহীন অজ্ঞানতা দেখে নিশ্চুপে হাসছেন। সেখানে তো যেতে পারব না আমরা। শুধু বুকে হাত রেখে বলতে পারব— ‘ওয়াকান্ডা ফরএভার!!!’

অন্য বিষয়গুলি:

Chadwick Boseman Black Panther Black Lives Matter
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy