স্বাধীনতার পর নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় সংবিধানে কাশ্মীর সম্পর্কে যুক্ত হয় বিতর্কিত ও বহুচর্চিত ৩৭০ ধারা। তারপর পাকিস্তানে শাসক বদলেছে ঘন ঘন। কিন্তু তাদের কাশ্মীর নীতির ধারাবাহিকতার কোনও বদল হয়নি। ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৯৯-এ কার্গিল যুদ্ধ-সহ পর পর তিনটি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হয়নি। গত কয়েক দশকে বহু জওয়ান ও সাধারণ মানুষের তাজা রক্তে সিক্ত হয়েছে ভূস্বর্গ কাশ্মীর। উরি-পাঠানকোট-পুলওয়ামা— একের পর এক জঙ্গি হামলা ও পাকিস্তানি সেনার গোলায় প্রাণ হারিয়েছেন ভারতীয় জওয়ান ও সাধারণ কাশ্মীরি নাগরিক।
নব্বইয়ের দশকে ‘গুল গুলশান গুলফাম’ সিরিয়ালের মধ্যে দিয়েই অসাধারণ কাশ্মীরের সাধারণ জীবনযাত্রার যাপনকথা ভারতের আমআদমির হৃদ্কুঞ্জে প্রবেশ করে। সাদা-কালোর টিভির যুগে পাতাঝরার মরসুমে চিনার পাতার রং কতটা মায়াবি, পীরপঞ্জালের বরফ কতটা শুভ্র, ডাল লেকের জল হৃদয়ের মতো গভীর কি না, এ সব বোঝা না গেলেও এক আবেগ আর আবেশে জড়িয়ে রাখত মোহময়ী কাশ্মীর। ঝিলমের তীরে, ডাল লেকের শিকারায় কাশ্মীরের প্রিয় বাদ্যযন্ত্র সন্তুরের আওয়াজ থেমে গিয়েছে অনেক দিনই। তার বদলে এখন মর্টার-গ্রেনেড বা বুলেটের আওয়াজটাই দস্তুর। ঝিলমের স্বচ্ছ জলে অযাচিত রক্তের ধারা।
আমির খুসরুর অনিন্দ্যসুন্দর ভূস্বর্গ কাশ্মীর ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্বে ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত। ১৯৪৭ থেকে আজ পর্যন্ত সিন্ধু দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। তবুও শ্বেতশুভ্র পীরপাঞ্জালে ঘেরা সুন্দরী কাশ্মীরের মৃত্যু উপত্যকায় রক্তের হোলি বন্ধ হচ্ছে না। বাংলার জেলাকেও ছুঁয়ে গেল সেই মৃত্যুমিছিল।
প্রতি দিনের মতো দিনের শেষে কাতরাসুর গ্রামের আপেল বাগিচায় দিনমজুরের কাজ করে ভাড়া বাড়িতে ফিরেছিলেন জহিরুদ্দিনেরা। সারা দিন অক্লান্ত খাটুনির পর ঘরে ফিরে সবাই ব্যাগে জামাকাপড় গোছাচ্ছিলেন। পর দিন সকালে কাশ্মীর ছেড়ে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার কথা। ঘর ফেরার আনন্দে সবাই আড্ডায় মশগুল। আচমকাই দরজায় ধাক্কা। ভয়ে ওঁরা সিঁটিয়ে গিয়েছিলেন। কিছু বোঝার আগেই মুখঢাকা সশস্ত্র জঙ্গিরা ছ’জনকে টানতে টানতে বাড়ি থেকে বার করে ২০০ মিটার দূরে নিয়ে যায়। সেখানেই সারি দিয়ে দাঁড় করিয়ে পর পর গুলি। রক্তাক্ত অবস্থায় ঘটনাস্থলে লুটিয়ে পড়েন পাঁচ পরিযায়ী শ্রমিক নইমুদ্দিন শেখ (৩২), কামরুদ্দিন শেখ (৩৪), রফিকুল শেখ (২২), মুরসেলিম শেখ (৩৬)ও রফিক শেখ (৩২)। ভাঙা কলের জলে মিশে রাস্তায় তখন লাল রক্তের স্রোত। শীতকাতুর রাতের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে তাঁদের আর্তনাদ কুলগ্রামের পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে অনুরণিত হতে থাকল কিছু ক্ষণ। আহত জহিরুদ্দিন শেখ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কোনওমতে জঙ্গিদের হাত থেকে পালিয়ে একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন। এখন তিনি শ্রীনগরে শ্রী মহারাজা হরি সিং হসপিটাল-এ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।
এই ধরনের ভয়ঙ্কর নারকীয় হত্যালীলা রুহ্ কাঁপিয়ে দিয়েছে আপামর ভারতবাসীর। মৃত শ্রমিকেরা সকলেই মুর্শিদাবাদের বাহালনগর গ্রামের হতদরিদ্র-সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে মোরগ্রাম পেরোলেই রাস্তার ঠিক পাশেই সাগরদিঘি থানার বাহালনগর গ্রাম। কিছুটা গেলেই বীরভূম। এক লহমায় রাতারাতি বাহালনগর সংবাদের শিরোনামে।
গ্রামে কর্মসংস্থানের আকাল। তাই ভাগ্যের অন্বেষণে গ্রাম ছেড়ে তাঁরা পাড়ি দিয়েছিলেন সুদূর দক্ষিণ কাশ্মীরের আপেল বাগানে। আপেল মরসুম শেষে ওঁদের দেশের বাড়িতে রওনা দেওয়ার কথা ছিল। রওনাও দিয়েছেন— তবে কফিনে শায়িত হয়ে। প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার পেরিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই কুয়াশা ভেদ করে মৃদু ঠান্ডায় যে গ্রামে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া নিথর দেহ এসে পৌঁছেছে, সেই বাহালনগরে এখন শোকের ছায়া। আনাচে-কানাচেতে চাপা কান্না।
তাঁদের মরদেহের সঙ্গে এসেছে চরম অনিশ্চয়তা, আশঙ্কা পরিবারগুলির জন্য। শোকের গ্রামে অরন্ধন। হাঁড়ি চড়েনি কোনও বাড়িতে। দিনের শেষে, সন্ধ্যা নামার আগে পাঁচ দিনমজুর যখন বাহালনগরের মাটিতে চিরবিদায় নিয়েছে কবরে, তখনও শোকার্ত গ্রামের প্রতিটি ছিন্নভিন্ন আঙিনার এক সুরে উচ্চারিত একটিই আকুল আবেদন— নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি চাই। ভূস্বর্গে ফিরে আসুক শান্তির বারিধারা।
ফোনে মেয়ে সুহানার সঙ্গে কথা হয়েছিল মুরসেলিমের। কাশ্মীর থেকে নতুন জামা কিনে আনবেন বলে জানান। সেই শেষ। কিছুতেই যেন ঘোর কাটছে না বছর কুড়ির মারিয়া বিবির। মাটির দাওয়ায় বসে বুক চাপড়ে কেঁদেই চলেছেন। জঙ্গিরা কেড়ে নিয়েছে তাঁর স্বামী রফিকুলকে। উঠোনের একপাশে মেয়ে রহিমাকে আঁকড়ে, পরনের শাড়ির খুঁটটা দাঁতে চেপে কান্না চাপার চেষ্টা করছেন মৃত কামরুদ্দিনের স্ত্রী রওশনা। রহিমার কিডনির অসুখ। মেয়ের চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে ঘরছাড়া হয়েছিলেন কামরুদ্দিন। জঙ্গিরা তাঁকে পৃথিবীছাড়া করল।
পুলওয়ামায় মর্মান্তিক ঘটনার শোকের রেশ চোখে নিয়ে দেশের মানুষ চাইছিলেন জবরদস্ত একটা জবাব। তারই ফলশ্রুতি বালাকোটে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। দেশপ্রেমের জিগির তুলে উপর্যুপরি দ্বিতীয় বার বিপুল জনাদেশ নিয়ে মোদী-২ সরকার দিল্লির মসনদে। মসনদে আসীন হয়েই মোদী সেনাপতি অমিত শাহকে সঙ্গী করে গত ৫ আগস্ট লোকসভায় সংবিধানের বিতর্কিত ৩৭০ ধারা বিলোপ করেন। কাশ্মীর থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের পর এখনও পর্যন্ত জঙ্গিহামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৩ জন নিরীহ নাগরিক।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, মৃত ব্যক্তিরা সকলেই অ-কাশ্মীরি। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের মতে, ১৯৮৯ সালের পর এই প্রথম বাইরের শ্রমিকেরা এ ভাবে জঙ্গি আক্রমণের মুখে পড়লেন। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, গত এক বছরে কাশ্মীরে সেনা ঘাঁটির নিরাপত্তা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে, সেখানে হামলা চালানো কঠিন। জঙ্গিরা তাই অপেক্ষাকৃত সহজ লক্ষ্য বেছে নিয়েছে। উপত্যকার অর্থনীতিকেও নিশানা করেছে। ভিন্রাজ্যের শ্রমিকেরা সেখানে কাজ করতে না পারলে গোটা দেশকে বার্তা দেওয়া যাবে। ভিন্রাজ্যের ট্রাক-চালক, ব্যবসায়ীরা না গেলে উপত্যকায় অর্থনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে। এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, কাশ্মীরে জঙ্গিবাদ ধর্মভিত্তিক বা জাতিভিত্তিক নয়। পাকিস্তানের মদতে এই হিংসালীলা পুষ্ট।
আতঙ্কে ঘরে ফিরছেন কাশ্মীরে কর্মরত বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকেরা। আবার, তাঁদের রুজি-রোজগারে সেই অনিশ্চয়তার দিনযাপন। যতই ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৩ সদস্যদের এনে মোদী সরকার কাশ্মীর সম্পর্কে ভাল ছবি প্রচারের চেষ্টা করুক না কেন, ভারত বনাম পাকিস্তান, যুদ্ধ বনাম সংলাপ, কাশ্মীরিয়ত বনাম ইসলাম কিংবা পাথর বনাম বুলেট সংঘাতে জর্জরিত কাশ্মীর সেই তিমিরেই। এর মধ্যে বাংলার পাঁচ শ্রমিকের নৃশংস হত্যালীলা নিঃসন্দেহে জটিল প্রশ্নের সামনে ভারত সরকারকে দাঁড় করিয়েছে।
শিকারপুর উচ্চ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy