স্বামী বিবেকানন্দ। ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকার আর্কাইভ থেকে
একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকে পদার্পণ করেছি আমরা। স্বাধীনতা লাভের পরেও অনেকটা সময় পার হয়েছে। অথচ দেশের সমস্যা ক্রমশ যেন জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘মানব উন্নয়ন সূচক’-এ ১৮৯টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১২৯তম। গত বারের তুলনায় সামান্য ভাল। যদিও অভিযোগ, অভাব, দারিদ্র, দুর্নীতি, অন্যায়ের চিত্র চারপাশে বড়ই প্রকট। দোসর, রাজনৈতিক উত্তাপ।
সমাজের প্রতিটি স্তরে যে ভাবে দুর্নীতি ছেয়ে গিয়েছে, তা কারও অজানা নয়। পাল্টা দিয়ে চলেছে ধর্ম-বিদ্বেষের রাজনীতি। স্বামী বিবেকানন্দ এই সমস্যা প্রসঙ্গে আগেই সতর্ক করেছিলেন—“ধর্মের সংহতি-স্থাপনই ভবিষ্যৎ ভারত গড়িবার প্রথম সোপান। সেই মূল ঐক্যের দিকে লক্ষ্য রাখিয়া নিজেদের এবং জাতির কল্যাণের জন্য পরস্পরের সর্ববিধ মতভেদ ও অকিঞ্চিৎকর কলহ আমাদের বর্জন করিবার সময় আসিয়াছে। বহু দিকে বিকীর্ণ আধ্যাত্মিক শক্তিসমূহের সম্মিলন দ্বারাই ভারতে জাতীয় ঐক্যের প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে।” বিবেকানন্দ কথিত এই ধর্মের সঙ্গে প্রচলিত সম্প্রদায়গত ধর্মের কোনও যোগ নেই। যোগ একমাত্র হৃদয়ে। অনেকেই আবার বিবেকানন্দের এই ‘জাতি’ শব্দটিকে সঙ্কীর্ণ অর্থে ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু তিনি নিজেই বলেছেন, “অন্যান্য দেশের সমস্যাসমূহ অপেক্ষা এদেশের সমস্যা জটিলতর, গুরুতর। জাতির অবান্তর বিভাগ, ধর্ম, ভাষা, শাসনপ্রণালী—এই সমুদয় লইয়াই একটি জাতি গঠিত।” ফলে সম্প্রদায়গত ধর্মের নামে যে জাতি সৃষ্টির কথা বর্তমানে প্রচলিত, তা যে নিছক একটি ভ্রম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এখানেই চলে ‘আমরা-ওরা’-র রাজনীতি, যার শিকার সাধারণ মানুষ।
পোশাকি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি বর্তমান ভারতের রাজনীতির অঙ্গ হয়ে উঠেছে। অথচ ধর্মকে সরিয়ে রাজনীতিকে গুরুত্ব দিয়ে কোনও দিনই জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা পায়নি, পেতে পারে না। বিবেকানন্দ স্পষ্ট বলেছেন, “রাজনীতিক বা সামরিক শ্রেষ্ঠতা কোন কালে আমাদের জাতীয় জীবনের উদ্দেশ্য নহে—কখনও ছিলও না, আর জানিয়া রাখুন, কখনও হইবেও না।” তবে রাজনীতিক বা সামাজিক—সব বিষয়ে সাফল্যলাভের মূল ভিত্তি যে মানুষের সততা, সে কথাও বারবার উল্লেখ করেছেন তিনি। তাঁর কাছে এই সততা বা মনুষ্যত্ববোধই মানব ধর্ম। আপন চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনেই এই ধর্মের পালন করা যায়। এ কারণেই তিনি আবার বলেছেন, “আমরা মানবজাতিকে সেই স্থানে লইয়া যাইতে চাই—যেখানে বেদও নাই, বাইবেলও নাই, কোরাণও নাই; অথচ বেদ, বাইবেল ও কোরাণের সমন্বয় দ্বারাই ইহা করিতে হইবে!”
স্বামী বিবেকানন্দের জন্মের দেড়শো বছর অনেক দিন আগেই অতিক্রান্ত। অথচ এখনও তাঁর চিন্তা-চেতনার, ভাবনার প্রসার সে ভাবে হয়নি। গাঁধী যে ভাবে ‘সর্বোদয়’ ভাবনার মাধ্যমে সমাজের সার্বিক উন্নয়নের কথা ভেবেছিলেন, কার্ল মাক্স ভেবেছিলেন ‘সাম্যবাদ’ সমাজব্যবস্থার কথা, স্বামী বিবেকানন্দও তেমন সার্বিক উন্নয়নের কথা ভেবেছিলেন। তবে তাঁর পরিকল্পনায় মাত্রা পেয়েছিল ব্যক্তি-চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন। আর তা সম্ভব জনসাধারণকে শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে। ১৮৯৪ সালের ২০ জুন আমেরিকা থেকে হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লেখা চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন, “জনসাধারণকে শিক্ষিত করা এবং তাহাদিগকে উন্নত করাই জাতীয় জীবন-গঠনের পন্থা।” এই প্রসঙ্গেই স্বামী শুদ্ধানন্দকে লেখা ১৮৯৭ সালের একটি চিঠির কথা উল্লেখ করা যায়, যেখানে বিবেকানন্দ লিখেছেন, “জনসাধারণকে যদি আত্মনির্ভরশীল হতে শেখানো না যায়, তবে জগতের সমগ্র ঐশ্বর্য ভারতের একটি ক্ষুদ্র গ্রামের পক্ষেও পর্যাপ্ত সাহায্য হবে না।”
অথচ ভারতের উন্নয়নের পরিকল্পনায় জনসাধারণকে শিক্ষিত করার প্রাবল্য যেন ক্রমশ কমে আসছে। স্বার্থান্বেষী মানুষের পদচারণা দিকে দিকে। ভারতীয় গণতন্ত্র নামক সিস্টেমের প্রতি স্তরে এই সব মানুষের সীমাহীন লোভ ও স্বার্থ রাষ্ট্রকে প্রতি মুহূর্তে বিপর্যস্ত করে তুলছে। প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্রগুলিতে তো নারী ও দাসদের নাগরিকত্বই ছিল না, কেবল কিছু পুরুষ রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। ১৮৯৪ সালে নিউজিল্যাণ্ডে নারীদের নাগরিক অধিকার প্রদান শুরু হয়। এখনও বেশ কিছু দেশে নারীরা পূর্ণাঙ্গ নাগরিক অধিকারও পাননি। ফলে গণতন্ত্রের নামান্তর হয়ে উঠেছে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। এখনকার প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে সাধারণ নাগরিক ভোটদানের সময়টুকু ছাড়া বাকি সময়ে উপেক্ষিতই রয়ে যায়। ফলে বাড়তে থাকে রাজনৈতিক অনীহা, ক্ষোভ, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপপ্রয়োগের মতো বিষয়গুলি। বিবেকানন্দের চিন্তাচেতনায় এই সমস্যার নিরসনের উল্লেখ মেলে। ১৮৯৭ সালে মাদ্রাজে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “...এখন লোকদের নিজেদেরই সমাজের সংস্কার, উন্নতি প্রভৃতির চেষ্টা করতে হবে। সুতরাং যতদিন না লোকে শিক্ষিত হয়ে নিজেদের অভাব বোঝে, আর নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে প্রস্তুত ও সমর্থ হয়, ততদিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। ... নূতন প্রণালী হলো নিজেদের দ্বারা নিজেদের উন্নতি-সাধন।”
দেশের সার্বিক উন্নতিতে বিবেকানন্দ কথিত এ সব প্রাথমিক জ্ঞান ও পরিকল্পনাগুলি অত্যাবশ্যক। ব্যক্তিচরিত্রের বিকাশের মধ্য দিয়েই সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতি সম্ভব। কারণ, তা না হলে এই পরিকল্পনার বাস্তব ও পরিপূর্ণ রূপায়ণ অসম্ভব। যে নৈরাজ্যের বাতাবরণে দেশের গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে, তা ভেঙে ফেলতে জাতীয় জীবনে আত্মশক্তি ও সততার প্রয়োজন। বিবেকানন্দের শিক্ষাভাবনায় ব্যক্তির সেই সততা তথা মানুষ হওয়ার পদ্ধতির পরিচয় মেলে। অনেক পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলেও তাঁর কথামতো ‘আগামী পঞ্চাশ বৎসর আমাদের গরীয়সী ভারতমাতাই আমাদের আরাধ্য দেবতা’ হলে রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নতি সম্ভব।
তথ্যসূত্র: স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (দশম খণ্ড)
লেখক সহশিক্ষক, সিমলাপাল মদনমোহন উচ্চ বিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy