বাজেটের দিন অর্থমন্ত্রীর হাতের ব্রিফকেস কিংবা লাল কাপড়ের ফোল্ডার হল বাবুরাম সাপুড়ের ঝাঁপির মতো। নির্মলা সীতারামনের সেই ঝাঁপি থেকে ‘স্টাডি ইন ইন্ডিয়া’ নামে যা বেরিয়ে এল, সেটা বিষধর কালো-ফণাধারী, না কি নেহাতই চোখ-নখহীন দুধভাত-খাওয়া, তা দেখতে মুখিয়ে উঠলাম।
বিদেশি ছাত্রদের এ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে আসার ইতিহাস অবশ্য বেশ পুরনো। প্রাচীন ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সুনাম ছড়িয়েছিল দেশে-বিদেশে। ২৭০০ বছর আগেও তক্ষশীলায় পড়তে আসত বিদেশি ছাত্ররা। আবার হাজার-বারোশো বছর আগে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আসত সুদূর কোরিয়া, জাপান, চিন, তিব্বত, ইন্দোনেশিয়া, পারস্য, এমনকি তুরস্ক থেকে। শিক্ষাগত উৎকর্ষই এ ক্ষেত্রে প্রধান আকর্ষণ ছিল। এখনও যে অল্পবিস্তর বিদেশি ছাত্র এ দেশে পড়তে আসে না, তেমন নয়। বর্তমানে সংখ্যাটা ৪৫ হাজারের মতো। বিদেশে পড়তে যাওয়া পৃথিবীর মোট ছাত্রদের ১%। কিন্তু এদের বেশির ভাগই এসেছে নেপাল, ভুটান, ইরান, ইথিয়োপিয়া, আফগানিস্তান, সুদান, ইরাক বা শ্রীলঙ্কা থেকে।
‘স্টাডি ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্প কিন্তু এক লাফে অনেকটা বাড়িয়ে দেবে ভারতে পড়তে আসা বিদেশি ছাত্রের সংখ্যা। ২০২৩-এর মধ্যে যা হতে পারে ২ লক্ষ। চিহ্নিত করা হয়েছে দেশের ১০০টি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে, আছে আইআইটি, আইআইএম কিংবা আইআইএসইআর-এর মতো প্রতিষ্ঠানও। বছরে ৩০ হাজার বিদেশি ছাত্রকে ভর্তি করা হবে এ সব প্রতিষ্ঠানে। গড়ে তোলা হয়েছে পরিকাঠামো, ব্যবস্থা হয়েছে কিছু স্কলারশিপেরও। প্রথম বছরে ভর্তির আবেদন করেছে ৭০ হাজার বিদেশি ছাত্র।
এই পর্যন্ত চমৎকার। কিন্তু এরা কোথাকার? আবেদনকারীদের মধ্যে ১২ হাজার ইথিয়োপিয়ার, ১১ হাজার নাইজেরিয়ার, প্রায় ৮ হাজার করে আফগানিস্তান আর নেপাল থেকে। এ ছাড়া যথেষ্ট পরিমাণে আবেদনকারী বাংলাদেশ, কেনিয়া, তানজ়ানিয়া, রাওয়ান্ডা, উগান্ডা, ঘানার মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের। প্রকল্পটাই আসলে এই সব দেশের ছাত্রদের ইউরোপ-আমেরিকার থেকে কম খরচে উন্নত মানের শিক্ষার স্বপ্ন বিক্রি করার। উৎকর্ষকে পরিকাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্ত করে।
প্রচেষ্টাটা বেশ। তবু, এটা পরিষ্কার, সার্বিক ভাবে প্রথম বিশ্বের ছাত্রদের আকৃষ্ট করার অবস্থায় আমরা পৌঁছইনি কিছুতেই। উল্টে ফি-বছর দলে দলে ভারতীয় ছাত্র যায় মার্কিন মুলুকে, ইউরোপে, অস্ট্রেলিয়ায়। আগে ভারতীয় ছাত্রদের বিদেশে টেনে নিয়ে যেত শিক্ষার উৎকর্ষই। তাদের ‘সোনার তরী’ এক কালে পাড়ি জমাত ইংল্যান্ডে। ‘অমিত রায়’-এর দল সেখানে ভিড় করত ব্যারিস্টারি পড়তে। ব্রিটিশ কলোনির প্রজাদের পক্ষে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। বিলেত-ফেরত হলে দেশে সামাজিক প্রতিপত্তিও হত বেশ। স্বাধীন ভারতেও ‘কলোনিয়াল হ্যাংওভার’ কিন্তু থেকেই গেল। একটু একটু করে ছাত্রদের বিদেশ-যাত্রার প্রধান অভিমুখ পাল্টে গেল সাত সাগর পারের মার্কিন তটভূমিতে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বহুশত মেধাবী ছাত্র পড়াশোনা ও গবেষণার জন্যে পাড়ি দিল সেখানে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় যারা স্লোগান দিয়েছিল, তাদেরও অনেকেই হল মার্কিন দেশগামী বিমানের যাত্রী।
তার পর গঙ্গা আর হাডসন দুই নদী দিয়েই বয়ে গিয়েছে বহু সহস্র কিউসেক জল। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় এক অর্থমন্ত্রী তাঁর মনমোহিনী ম্যাজিকে ভারতের অর্থনীতির শতাব্দী-প্রাচীন শুষ্কতাপের দৈত্যপুরের দ্বার ভাঙলেন। ঘটে গেল এক নবীন প্রাণের সঞ্চার। একবিংশ শতকে এক নতুন ভারতবর্ষ সঞ্জীবিত হল। গ্লোবাল বিপর্যয়ের অভিঘাতে যখন বিশ্বের তাবড় অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে, ভারতীয় অর্থনীতির বিকাশ সেখানে সামান্য শ্লথ হয় মাত্র। তবু, আজও বিশ্ববিদ্যালয় বা নামজাদা প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে সফল, উজ্জ্বল ছাত্ররা উচ্চশিক্ষার্থে চলেছে মার্কিন মুলুকে।
কিছু ছাত্র অবশ্যই ও-দেশের অত্যন্ত নামজাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিদদের সংস্পর্শে পড়াশোনা আর গবেষণা করতেই যায়। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রদের ক্ষেত্রে সে কথা একেবারেই বলা যাবে না। তারা বিদেশের যে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে নোঙর ফেলে, তার চেয়ে আমাদের দেশের নামজাদা প্রতিষ্ঠানগুলি, যেমন আইআইটি, আইআইএসসি, আইএসআই, টিআইএফআর বা বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বা গবেষণার মান বা পরিকাঠামো খুব একটা পিছনে নয়, হয়তো বা এগিয়েই। তা হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রছাত্রী আমেরিকায় পড়তে যায় কোন অমৃতের সন্ধানে?
একটা কারণ হতে পারে যে, ছাত্র হিসাবে যাওয়াটাই সেই ‘স্বর্গরাজ্যে’ প্রবেশের সহজতম উপায়। ডোনাল্ড ট্রাম্প নিঃসন্দেহে সেটা জানেন। বারাক ওবামাও জানতেন। এটা ঠিকই যে এই ছাত্রদের অনেকেই পড়াশোনা শেষ করে আমেরিকায় ডলার উপার্জনেই আগ্রহী। যারা দেশে ফেরে, তাদেরও অনেকেই পায় যোগ্যতার থেকে বেশি সমাদর, সমাজ-জীবনে, এমনকি অ্যাকাডেমিক দুনিয়াতেও। সত্যিকারের যোগ্যরা তো পায়-ই। আসল কথা, বেশির ভাগ ছাত্রের কাছেই আমেরিকায় পড়তে যাওয়ার প্রধান চালিকাশক্তি হল ডলার, বা ডলার-টাকার বিনিময়মূল্য। এক ডলারে উনসত্তর টাকা না হয়ে উল্টোটা হলে হয়তো আমাদের ছাত্ররা মধ্যমানের বা নিম্নমানের মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে সাত সমুদ্দুর পাড়ি দিত না।
আমাদের দেশ এক অমিত সম্ভাবনার দেশ। আমি বিশ্বাস করি, অর্থনীতির সমৃদ্ধির ছাপ পড়ে জাতির জীবনযাত্রার সর্বত্রই— তার মননে, আচরণে, কৃতিত্বে। অর্থনীতি ও মননের যুগ্ম শ্রীবৃদ্ধি অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে বিদেশে পড়তে যাওয়া ছাত্রের সংখ্যাও কমিয়ে দিতে বাধ্য। ২০১৫-১৬ সালের হিসেবে দেখছি, আমেরিকায় পড়তে যাওয়া বিদেশি ছাত্রদের মধ্যে সংখ্যায় ভারতীয়রা দ্বিতীয়, ১৫.৯%। প্রথম স্থানে চিন, অনেকটা এগিয়ে, ৩১.৫%। নিশ্চয়ই সেটা খানিকটা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অবস্থার উপরেও নির্ভরশীল। যা-ই হোক, সমৃদ্ধ জাপান এ ক্ষেত্রে অনেক পিছনে, মাত্র ১.৮%। মনে রাখতে হবে, ছোট দেশ হলেও জাপানে উচ্চ শিক্ষার বিস্তার কিন্তু কম নয়।
ভারতের ক্ষেত্রে আমি স্বপ্ন দেখি, অচিরেই আমাদের অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নত বিশ্বের ছাত্ররাই দলে দলে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পড়তে আসবে এ দেশে। তাদের রীতিমতো প্রস্তুতি নিয়ে বসতে হবে ‘গ্র্যাজুয়েট রেকর্ড এগজ়ামিনেশনস’ বা জিআরই ধাঁচের পরীক্ষায়। আমরা অবশ্যই সকলকে নিতে পারব না আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে, বেছে বেছে নেব। এই সব উন্নত বিশ্বের ছাত্রদের স্কলারশিপও দেবে ভারত। ভারত রাষ্ট্র বিদেশি ছাত্রদের ভিসা দিতেও করবে বাছবিচার। ঠিক যে আচরণ আজ উন্নত বিদেশি রাষ্ট্র ভারতীয় ছাত্রদের সঙ্গে করে। কিন্তু এটা তো কেবলমাত্র শিক্ষার প্রশ্ন নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং সামাজিক স্থিতির ছবিটাও। তাই আমার স্বপ্নটা আসলে সার্বিক ভাবে এক সমৃদ্ধতর ভারতের চিত্র।
উপকথার গল্প আমার বিলক্ষণ জানা। সেই যে ব্রাহ্মণ চালের গুঁড়ো ভর্তি কলসি নিয়ে যেতে যেতে ঘুমিয়ে পড়ে আর স্বপ্ন দেখে। ভালই জানি, ডিম ফুটে মুরগি হওয়ার আগে মুরগি গুনতে নেই।
কিংবা কে বলতে পারে, হয়তো বা স্বপ্নটাকে বাস্তবে দেখে যাব আমারই জীবদ্দশায়। বাবুরাম সাপুড়ের ঝাঁপি থেকে মুখ বার করা ‘স্টাডি ইন ইন্ডিয়া’কে সে দিন সত্যিই আর দুধ-ভাত খাওয়া নখ-দন্তহীন কিঞ্চিৎ অর্থ উপার্জনের মাধ্যম বলে মনে হবে না।
(ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতার রাশিবিজ্ঞানের অধ্যাপক।)
মতামত ব্যক্তিগত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy