নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
গত মে মাসে বিপুল ভোটে পুনর্নির্বাচিত হইয়া আসিবার কিছু পরই, দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রিত্বে অভিষিক্ত হইতে প্রস্তুত নরেন্দ্র মোদী একটি উল্লেখযোগ্য মন্তব্য করিয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন, ভারতে অতঃপর দুইটি মাত্র ‘জাত’ থাকিবে। প্রথমটি, দরিদ্র জাত। দ্বিতীয়টি, যাহারা দরিদ্র নহে, এবং যাহাদের প্রথম কর্তব্য এই দেশ হইতে দারিদ্র দূর করা— সেই জাত। তাঁহার কথা শুনিয়া সে দিনও ভারতীয় সমাজের এক বিশাল অংশ অলক্ষ্যে চোখের জল ফেলিয়াছিল, সম্ভবত আজও ফেলিতেছে। কেননা এই একটি মন্তব্যই প্রাঞ্জল ভাবে বুঝাইয়া দেয় যে ভারতের বর্তমান নেতারা হয় সমাজের বাস্তবকে চিনেন না জানেন না, নতুবা চিনিয়া জানিয়াও তাঁহারা সেই বাস্তব লইয়া মাথা ঘামাইতে আদৌ ইচ্ছুক নহেন। যে দেশে তথাকথিত নিম্নজাতের মানুষ দেখেন, ঘোর গ্রীষ্মে ঘরের তৃষ্ণার্ত শিশুটির গ্রামের পানীয় জলের কল হইতে জল পান করিবার অধিকার নাই, কিংবা বিদ্যালয়ে রান্নার ভার বহন করিতে গিয়া দেখেন, কেন নিচু জাতের হাতে তৈরি খাবার খাইতে হইবে সেই ক্ষোভে উচ্চ জাতের লোকেরা বিদ্যালয়ে শিশু প্রেরণ বন্ধ করিয়া দিতেছেন, কিংবা ভালবাসিয়া বিবাহ করিয়া দেখেন, ক্রোধোন্মত্ত সমাজ ‘অপরাধ’-এর শোধ তুলিতে রে-রে করিয়া তাড়িয়া আসিতেছে— সেখানে এ হেন বাস্তবকে দেশের নেতারা শুধুমাত্র ‘দারিদ্র’ দিয়া ব্যাখ্যা করিতে পারেন না। এমনও মনে হওয়া সম্ভব যে, এই অবস্থান আসলে এক ভয়ঙ্কর বাস্তবকে অস্বীকার করিয়া তাহাকে চালু রাখিবার প্রয়াসমাত্র। গত সপ্তাহ হইতে উত্তরপ্রদেশের বিজেপি বিধায়কের কন্যা ও তাঁহার সদ্য-বিবাহিত নিম্নজাত-পরিচয়ের স্বামীকে লইয়া যে কুনাট্য চলিতেছে, তাহাতে আর এক বার এই প্রশ্নটিই সামনে আসিতেছে। পরিস্থিতি এমনই যে সোমবার ইলাহাবাদ হাইকোর্ট ওই দম্পতির জন্য পুলিশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করিতে নির্দেশ দিয়াছে। নির্দেশ সত্ত্বেও আদালত চত্বরেই নববিবাহিত দম্পতির উপর চড়াও হইয়া প্রহার করিতে গিয়াছেন বহু মানুষ, যাঁহাদের মধ্যে ছিলেন আইনজীবীরাও। জানিতে ইচ্ছা হয়, এই ঘটনা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার সহকর্মীদের মনোভাব কী প্রকার। বিধায়ক রাজেশ কুমার মিশ্রের কন্যা সাক্ষী যখন ভিডিয়ো-বার্তায় বিবাহ মানিয়া লইবার জন্য পিতার প্রতি সাশ্রুনয়ন মিনতি করেন, জানিতে ইচ্ছা হয়, লখনউ ও দিল্লির বিজেপি প্রশাসকরা এ বিষয়ে ঠিক কী ভূমিকা পালন করিতেছেন। দারিদ্র দূরীকরণের কাজ না-হয় যথাসময়ে হইবে। আপাতত কি মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ও প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজেদের দলের কর্মী, সমর্থক ও নেতাদের নির্দেশ দিতে পারেন, দুই বয়ঃপ্রাপ্ত নাগরিকের বিবাহিত জীবনে বাধা সৃষ্টি না করিতে? বিবাহের ‘অপরাধ’-এ দম্পতিকে আক্রমণ না করিতে?
বাস্তবিক, গত কয়েক বৎসরে উত্তরপ্রদেশ-সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে জাতভিত্তিক অশান্তি বাড়িবার চিহ্ন দেখা গিয়াছে। ইহার পিছনে হিন্দুত্ববাদের রাজনীতির কোনও সক্রিয় ভূমিকা আছে কি না, বলা মুশকিল। কিন্তু অন্তত সেই অশান্তি কমাইবার বা থামাইবার চেষ্টা যে হিন্দুত্ববাদী নেতারা করেন নাই, ইহা নিশ্চিত। ভোটের ফলাফল যেমনই হউক, গত কয়েক বৎসরে দলিত বনাম উচ্চ জাতের সংঘাতের পিছনে জাত-রাজনীতির তীব্রতা টের পাওয়া কঠিন ছিল না। বুঝিতে অসুবিধা নাই, এই সব সংঘাত ও অশান্তির অনেকগুলিই কেবল প্রশাসনিক সদিচ্ছা দিয়া মিটাইয়া ফেলা সম্ভব ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা যাঁহাদের কাজ, তাঁহারা যদি জাত-ধর্ম-নিরপেক্ষ ভাবে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে নিজেদের কাজ করিতেন, তবে অনেক সঙ্কটই বেশি দূর গড়াইতে পারিত না। ফলে প্রধানমন্ত্রীর ‘জাত লইয়া খেলা’ বন্ধ করিবার আশ্বাস যোগী আদিত্যনাথের রাজ্য হইতেই কার্যকর হইতে পারে। তখনই বোঝা যাইবে, ভারতীয় নাগরিকের আশ্বস্ত হইবার অবকাশ আছে কি না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy