অনুজ শর্মা। —ফাইল চিত্র
বাঙালির প্রিয় চর্চাগুলির অন্যতম হল, যে কোনও বিষয়ে আগের সঙ্গে তুলনা টানা। সেই চর্চায় ইদানীং যোগ হয়েছে; ‘‘এ বছর কি আগের বছরের তুলনায় কালীপুজো ও দেওয়ালিতে কম শব্দদূষণ হল?’’ শুনলে মনে হয় ভেন্টিলেটরে থাকা রোগীর ভালমন্দ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে! ঘটনা হল, কালীপুজো ও দেওয়ালির রাতে শব্দদূষণ আক্ষরিক অর্থেই সাধারণ মানুষকে ‘ভেন্টিলেটর’-এ দেওয়ার অবস্থায় পৌঁঁছেছে। দেওয়ালিতে কলকাতার গড় শব্দমাত্রা রাত ১০টা থেকে ১২টার মধ্যে এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যা আবাসিক অঞ্চলে অনুমোদিত সর্বোচ্চ সীমার থেকে প্রায় ২০ ডেসিবেল বেশি— যেখানে প্রতি ১০ ডেসিবেল শব্দ বৃদ্ধি কানের পর্দায় প্রায় দ্বিগুণ চাপ তৈরি করে। পাশাপাশি বায়ুদূষণ পরিস্থিতি এমন ব্র্যাডম্যানীয় রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছিল যা ভাঙার ক্ষমতা কারও নেই!
দেওয়ালি কালীপুজোর রাতে দূষণ পর্ষদ ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাদের প্ল্যাটফর্ম সবুজ মঞ্চ মিলিত ভাবে আড়াইশোর ওপর অভিযোগ পেয়েছিল নিয়ম ভেঙে শব্দবাজি, মাইক বা ডিজে বাজানোর, যাদের অধিকাংশকেই অভিযোগ না বলে আর্তনাদ বলা ভাল। যেমন ধরুন বাগবাজারের ৭৫ বছর বয়স্ক সেই মানুষটি, কালীপুজোর আগের দিন থেকে যিনি ক্রমাগত নানান জায়গায় অভিযোগ করছেন এলাকায় মাইকের আওয়াজ নিয়ে, যে সমস্যা মেটাতে প্রশাসনের পাঁচ মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা নয়; কিন্তু ৭২ ঘণ্টা ধরে অভিযোগ আসা সত্ত্বেও তার সুরাহা হল না, বারবার দেশের আইন ও সুপ্রিম কোর্টের রায় ভাঙলেও এক জনকেও গ্রেফতার করা হল না, নিদেনপক্ষে মাইক বক্স হেফাজতে নেওয়া হল না। এমন উদাহরণের শেষ নেই।
২০১৮ সালের সুপ্রিম কোর্টের রায় স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে অনুমোদিত বাজি শুধুমাত্র রাত ৮টা থেকে ১০টা অবধি ফাটানো যাবে। তাই কৌতূহল ছিল, এ বার কি রাত ১০টার পর আওয়াজ কমবে? বাস্তবে দেখা গেল কলকাতা আছে কলকাতাতেই, ১০টার পরেই আওয়াজ ঊর্ধ্বমুখী হল। তফাত হল, অন্যান্য বারের তুলনায় এ বছর মাইকের তাণ্ডব বেড়ে যাওয়া। এটা মানতে হবে, অন্যান্য বারের তুলনায় শহর কলকাতায় ও অন্যান্য জেলায় বাজির দাপটে আক্রান্ত অঞ্চল কমেছে; কিন্তু বাঙ্গুর, লেকটাউন, বেহালা, টালিগঞ্জ, রিজেন্ট পার্ক, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের মতো মার্কামারা অঞ্চলে শব্দদূষণ হয়েছে প্রায় আগের মতোই। আগের মতোই মূল নিয়ম ভাঙা ঘটেছে বহুতল ও বস্তি অঞ্চলে।
প্রশ্ন হল, এ বছর প্রশাসন, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বেশ খানিকটা সদিচ্ছা দেখালেও শেষ পর্যন্ত শব্দযুদ্ধে পিছু হটতে হল কেন? কালীপুজোর রাতে অনেক ক্ষেত্রেই পর্ষদ রাস্তায় নেমেছে, চেষ্টা করেছে দূষণ থামানোর, কিন্তু সেই চেষ্টা যথেষ্ট নয়, যদি না প্রশাসন ও সমাজের অন্যান্য অংশ এগিয়ে আসে। শব্দ আইন বলছে শব্দদূষণ থামানোর মূল দায়িত্ব পুলিশের; আর দেওয়ালির রাতে তাঁদের অধিকাংশের ভূমিকা ছিল যেন খানিকটা ‘থামাতে পারি কিন্তু কেন থামাব’ গোছের। কোনও রকমে বিশেষ হেলদোল না ঘটিয়ে (পড়ুন, যতটা সম্ভব শব্দ-দোষীদের আড়াল করে) দিনটা কাটিয়ে দেওয়া! তাই পরিবেশবিদরা যখন অন্যান্য বছরের মতো বিধান শিশু হাসপাতালের অবস্থা দেখতে গেলেন, পুলিশ কর্মীরা ব্যস্ত রইলেন তাঁদের আটকাতে— চার পাশ থেকে অজস্র বোম ফাটানো অপরাধীদের ধরতে নয়! প্রতি বারের মতো রামকৃষ্ণ মিশন হাসপাতালের পিছনে লকার মাঠে রাত একটা অবধি অবাধে বোমাবাজি চলল, টালিগঞ্জ থানার এক জন পুলিশকর্মীও চোখে পড়ল না।
আসলে এটা নতুন কথা নয় যে পুলিশ তখনই পুরোপুরি কাজ করবে যখন সে রাজনৈতিক বার্তা পাবে। বলতে দ্বিধা নেই গত দেওয়ালিতে শব্দদূষণ থামাতে তেমন কোনও রাজনৈতিক বার্তা ছিল না, না সরকারে থাকা দলের, না বিরোধীদের; বরং স্থানীয় ভাবে রাজনৈতিক বার্তা উল্টোটাই ছিল, যে— এক দিন বই তো নয়, দামাল ছেলেরা একটু আনন্দ করলে করুক না! সঙ্গে যোগ হয়েছিল রাজনীতিতে ধর্মের হিসাব (বিজেপি আবার এটা নিয়ে মাঠে নেমে পড়বে না তো, যে, কেন অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে এত নিয়ম মানানো হয় না!) এবং, অবশ্যই, আর্থিক ও সামাজিক প্রতিপত্তিশালী এক শ্রেণির ভোটারদের মন রাখার চেষ্টা। আর, অধিকাংশ পুলিশ যে হেতু শব্দ আইন ভাঙাকে আসলে আইন ভাঙা বলে মনে করে না, তাই অবস্থার আরও অবনতি হল। পুলিশ কমিশনার স্বয়ং শব্দ আইন ভাঙা নিয়ে ফেসবুকে প্রশ্ন তুললেন, কিন্তু তাঁর কাজ তো প্রশ্ন তোলা নয়, বরং উত্তর দেওয়া! রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে কী ভাবে শব্দদূষণকে বাক্সবন্দি করা যায়, তার প্রমাণ মুম্বই, যেখানে এ বার দেওয়ালির রাতে গত ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম দূষণ হয়েছে। প্রশাসনের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবী সমাজের একটা বড় অংশের ভূমিকাও প্রশ্নের মুখে। তাঁরা পৃথিবীর যাবতীয় বিষয়ে মুখ খুললেও এ ব্যাপারে স্পিকটি নট— কি বামঘেঁষা, কি অন্যপন্থীরা। তবে কি তাঁরাও শব্দ তাণ্ডবকে বিশেষ অপরাধ বলে মনে করেন না?
কিন্তু এত অঙ্ক কষতে গিয়ে এ শহরে কেউ মনে রাখলেন না যে, এক কালে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে মডেল বলে চিহ্নিত ছিল কলকাতা। আর সে-ই আজ দেশের শব্দ-রাজধানী, যার আক্রমণ থেকে রেহাই নেই ধনী দরিদ্র বাঙালি অবাঙালি হিন্দু মুসলমান কারওরই। পাশাপাশি, তথ্য বলছে, বায়ুদূষণের কারণে এ শহর দেশের ক্যানসার রাজধানীও বটে। কেউ মনে রাখলেন না, প্রায় দু’দশক আগেই সমীক্ষা জানিয়েছিল যে, কলকাতার প্রায় পঁচানব্বই শতাংশ মানুষ শব্দবাজি চান না, যে অনুপাত এত দিনে বেড়েছে বই কমেনি। এঁদের কোনও মূল্য নেই?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy