Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

বোকা প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই

জনসংখ্যার দিক থেকে আমরা তুলনা করতে পারি চিনের সঙ্গে। দেখা যাচ্ছে, ওই দেশে বছরে প্রতিটি নাগরিকের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি খরচের পরিমাণ হচ্ছে এক লক্ষ নব্বই হাজার টাকা। অর্থাৎ, আমাদের ন’গুণ।

জয়দীপ বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৯ ০০:৫৬
Share: Save:

অর্থশাস্ত্র ট্রাপিজ়ের খেলার মতো। এই খেলায় সে-ই জিতবে, যে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য আনতে পারবে। খেলার শর্ত, মাঝে কোনও রেফারি থাকা চলবে না। এমন অদ্ভুত নিয়মের পিছনে যুক্তি কী? রেফারি এলেই খেলা ভন্ডুল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়, কারণ প্রায়শই দেখা গিয়েছে, রেফারিরা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েন।

বহু যুগ ধরে অর্থবিজ্ঞানীরা মূলত একটি বিষয়ই যাচাই করে চলেছেন— চাহিদা ও জোগান নিজেরা কতটা বলশালী, কুশলী ও স্বাধীন শক্তি। দাবি করা হয়ে থাকে যে, চাহিদা ও জোগানকে যদি স্বয়ম্ভু শক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়, যদি সরকার বা অন্য কোনও তৃতীয় পক্ষ রেফারি হিসেবে মাঠে না ঢোকেন, তা হলে এরা নিজেরাই খেলতে খেলতে এক ধরনের স্বল্পমেয়াদি ভারসাম্য তৈরি করতে সক্ষম।

গৌরচন্দ্রিকাটি দরকারি মনে হল মোদী ২.০ ভার্শনের প্রথম বাজেটে চোখ বুলোতে গিয়ে। বাজেট আসলে ভারসাম্যের খেলা। এই ভারসাম্য নানা ধরনের। গ্রাম-শহর, কৃষি-শিল্প, ধনী-গরিব, যুবা-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ, বর্তমান-ভবিষ্যৎ এবং অবশ্যই চাহিদা-জোগানের মতো বিপরীতমুখী শক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই অর্থমন্ত্রীর কাজ। তাঁর হাতিয়ার হল উপার্জন ও খরচ। এ বারের বাজেটে মোট খরচের প্রস্তাবিত বহর ২৭.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা। এ দেশের জনসংখ্যা মোটামুটি ১৩০ কোটি। তা হলে গড়পড়তা প্রত্যেকের জন্য খরচ ধরা হয়েছে একুশ হাজার টাকার সামান্য বেশি। প্রশ্ন হল, এই অঙ্কটি বড় না ছোট? উত্তর খোঁজার দুটো রাস্তা। এক, অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করা। দুই, আগে এ দেশের বাজেটে এই অঙ্কটি কেমন ছিল, তা পরখ করে দেখা।

জনসংখ্যার দিক থেকে আমরা তুলনা করতে পারি চিনের সঙ্গে। দেখা যাচ্ছে, ওই দেশে বছরে প্রতিটি নাগরিকের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি খরচের পরিমাণ হচ্ছে এক লক্ষ নব্বই হাজার টাকা। অর্থাৎ, আমাদের ন’গুণ। অন্য ভাবে, যদি গত বছর বাজেট বরাদ্দের বহর কেমন ছিল তা দেখি, তা হলে পাচ্ছি, ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে খরচের স্থূল লক্ষ্যমাত্রা।

কিন্তু এই দুটো কেজো তথ্য থেকে বাজেটের ভাল-মন্দ বিচার করা সম্ভব নয়। কারণ, আমাদের জানতে হবে ওই ২৭.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা কোথায় এবং কী উদ্দেশ্যে ব্যয় করা হবে। গত বৃহস্পতিবার নর্থ ব্লক থেকে যখন আর্থিক সমীক্ষা বেরলো, আমরা জানতে পারলাম যে সরকারের প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, আগামী পাঁচ বছরে ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনকে দ্বিগুণ করে পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছে দেওয়া। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এক ট্রিলিয়ন হচ্ছে ভারতীয় হিসেবে এক লক্ষ কোটি। এই লক্ষ্যমাত্রা ছুঁলে কী কী হতে পারে? এর জবাব খুব সহজ নয়। দেশের আয় বাড়লে দেশবাসীর আয় বাড়ে, দারিদ্র কমে আসে— এটা যেমন সত্য, তেমন আয় বাড়লেই যে দারিদ্র, অপুষ্টি, ক্ষুধা ও অসাম্য কমে আসবে, সে নিশ্চয়তাও দেওয়া যায় না। তবে, এগুলো কমাতে গেলে আয় বৃদ্ধি আবশ্যক।

মোদ্দা কথা, পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার জিডিপি-র লক্ষ্য এক সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গিরই পরিচায়ক। কিন্তু কী ভাবে আমরা এই মাইলফলক ছুঁতে পারব? অর্থমন্ত্রী বলছেন, প্রতি বছর গড়ে ৮ শতাংশ হারে বিকাশ হলেই তা সম্ভব। আর এই ৮ শতাংশ বছরপ্রতি বৃদ্ধির জন্য চাই গড়ে ৩৫ শতাংশ হারে বিনিয়োগ। লগ্নি করবে কে? উত্তর— দেশের লগ্নিকারীরা করবেন। বিদেশিরাও আসবেন।

ধরা যাক, এখন আমাদের বার্ষিক জিডিপি ১০০ ডলার। সেটাকে আগামী বছর ১০৮ ডলারে (যদি ৮ শতাংশ বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হয়) নিতে হলে এই বছরই ৩৫ ডলার লগ্নি করতে হবে। তার মানে এই ৩৫ ডলারের প্রায় পুরোটাই প্রথমত সঞ্চয় করতে হবে। তাতে কনজ়াম্পশন বা উপভোগ কমে যাবে। আগামী বছর ১০৮ ডলার মূল্যের পণ্য ও পরিষেবা বিক্রি করতে হবে। সঞ্চয় বাড়লে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাচ্ছে। কৃষ্ণমূর্তি সুব্রহ্মণ্যন এবং নির্মলা সীতারামন বলছেন, কুছ পরোয়া নেই, আমরা কিছু মাল বিদেশে বিক্রি করে দেব।

তা বেশ। কিন্তু এখন আমরা সমপরিমাণ পণ্য-পরিষেবা বিদেশে বিক্রি করতে পারছি না কেন? চলতি খাতায় ঘাটতি কেন তিন শতাংশ ছুঁই ছুঁই করছে? বোকা প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই!

গত সাড়ে চার দশকে সর্বাধিক হয়েছে বেকারত্ব। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাই বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ। অর্থমন্ত্রক মনে করছে, সঞ্চয়-বিনিয়োগ-রফতানির ত্রিফলা দিয়ে আট শতাংশের ‘আস্কিং রেট’ ছুঁতে বিশেষ বেগ পেতে হবে না। কিন্তু বেকারত্ব-আয়হীনতা-চাহিদার ঘাটতি-মন্থর উৎপাদনের যে দুষ্টচক্রটি নিয়ত কাজ করছে, তার কী হবে?

বাজেট জুড়ে যা যা করার প্রতিশ্রুতি মিলেছে, সবই জোগান বাড়ানোর দাওয়াই। কিন্তু চাহিদা বাড়বে কী ভাবে, তার কোনও হদিশ পাওয়া গেল না বাজেট বক্তৃতার ছেষট্টিটি পাতায়। অন্য সংশয়ও রয়েছে। গত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, শুধু জনপ্রিয়তার জোরে আর্থিক বিকাশ হাসিল করা যায় না। আশঙ্কা থেকেই যায়, যদি ওই আট শতাংশ প্রথম দু’বছর অধরা থাকে, তা হলে তো ‘স্লগ ওভার’-এ ‘আস্কিং রেট’ দাঁড়াবে দশ শতাংশের বেশি। যে দেশে শ্রমশক্তির পাঁচ শতাংশও দক্ষ নয় এবং কর্মহীনতার হার সাত শতাংশ, সেই দেশে শুধু বিহেভিয়ারাল অর্থনীতি দিয়ে কি উৎপাদন নিশ্চিত করা যাবে? রিচার্ড থেলার কী বলবেন জানি না। আমাদের প্রধান আর্থিক পরামর্শদাতার শেষ ভরসা কিন্তু সেই থেলারের ঠেলা-ই!

শিলচরে কাছাড় কলেজে অর্থনীতির শিক্ষক

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy