ছবি: ডিরোজিয়োর সমাধিস্থল (উদ্ধৃতির মধ্যে বানান অপরিবর্তিত)
ডি রোজিয়ো যখন পড়াশোনা করছেন সেই সময়ে বাংলার আরেক জন যুগপুরুষ রাজা রামমোহন রায় দেশীয় কুপ্রথাগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছেন। এক বার তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘আত্মীয় সভা’য় ভারতহিতৈষী ডেভিড হেয়ারের আগমনে রামমোহন হিন্দুদের ধর্মন্ধতা দূর করার জন্য বেদান্ত বিদ্যালয় স্থাপনের সম্পর্কে আলোচনায় ডেভিড হেয়ার তাঁকে সময়োপযোগী প্রয়োজনীয় পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের জন্য একটি বিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব দেন। কারণ, হেয়ার সাহেব বুঝতে পেরেছিলেন ভারতের জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষাই এক মাত্র পথ। এই বিষয়ে তিনি দেওয়ান বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়কে বুঝিয়ে রাজি করিয়েছিলেন। তার পর হেয়ার সাহেব এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি স্যর হাইড ইস্টের এবং বিত্তবান কিছু মানুষের সম্মতি নিয়ে একটি যুগপোযোগী কলেজ স্থাপন হয়। হিন্দু কলেজের প্রথম প্রিন্সিপ্যাল জন কের হিন্দু কলেজে প্রতিষ্ঠার ইতিহাস জানাতে গিয়ে লিখেছেন— ‘‘....ইংরেজি শিক্ষা লাভের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করিবার উদ্দেশ্যে দেশীয় অধিবাসীরা নিজেরাই ১৮১৬ খ্রীষ্টাব্দে হিন্দুকলেজ স্থাপন করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনের কাজে কয়েক জন ইউরোপীয় ভদ্রলোক সক্রিয় উৎসাহ দেখিয়েছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে সার হাইড ইষ্ট ও ডেভিড হেয়ার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।’’
অন্য দিকে, ডিরোজিয়োর মনও ভাগলপুরে বেশি দিন ভাল ছিল না। তাই তিনি কলকাতায় ফিরে আসাটাই মনস্থির করলেন। ফিরে এসে তাঁর সামনে সুযোগ এল হিন্দু কলেজে শিক্ষকতা করার। ১৮২৬ সালের কোনও একটি সময়ে তখন ডিরোজিয়োর বয়স সতেরো, তিনি হিন্দু কলেজে ইতিহাস ও ইংরেজি বিষয় পড়ানোর জন্য চতুর্থ শিক্ষকের পদে যোগদান করেন। শিক্ষক পদে যোগদান কালে তাঁর বয়সের সঙ্গে ছাত্রদের বয়সের মাত্র তিন-চার বছরের তফাত। ফলে, ছাত্রদের সঙ্গে ডিরোজিয়োর সম্পর্ক কখনই প্রাচীন তপোবনের গুরু-শিষ্যের মতো গুরুগম্ভীর হয়নি। তিনি ছাত্রদের সঙ্গে প্রায় বন্ধুদের মতো মিশতেন।
নতুন শিক্ষকের পাণ্ডিত্য, বাগ্মিতা এবং ছাত্রদের যুক্তি-তর্কের মধ্যে দিয়ে সব কিছু গ্রহণ করতে শেখানো, তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া, স্নেহ করা, প্রভৃতি গুণের জন্য অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সকলের প্রিয় হয়ে ওঠেন। পড়ানোর কালে তিনি কোনও কিছুই ছাত্রদের উপর চাপিয়ে দিতেন না, বিচার বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে ভাল-মন্দ সব কিছু বুঝে নিতে বলতেন। এর ফলে কুসংস্কার, রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে যু্ক্তি, সত্য দিয়ে ভাল-মন্দ বিচার করতে শেখার প্রেরণা ছাত্রদের মধ্যে আসে ডিরোজিয়োর শিক্ষাদানের ফলে। তার ফলে ছাত্রকুলের মধ্যে একটি আধুনিক চিন্তাজগৎ গড়ে উঠতে থাকে। রাধানাথ শিকদার লিখেছিলেন, ‘‘ডিরোজিয়োর সামান্য বিদ্যাভিমান থাকলেও তাঁর মতো সহানুভূতিশীল স্নেহপ্রবণ শিক্ষক তখনকার শিক্ষায়তনে দুর্লভ ছিল। কোনও বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার আগে তিনি পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিতেন শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কী। ছাত্রেরা তাতে যে কত লাভবান হত, তা বলা যায় না। কেবল বিদ্যা-শিক্ষা করেই তারা ক্ষান্ত হত না, বাস্তব জীবনে ও সমাজে তার প্রত্যক্ষ প্রয়োগ-প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় তারা চঞ্চল হয়ে উঠত। কোনও শিক্ষক ছাত্রদের মনে এ রকম প্রেরণা জাগাতে পারতেন না।’’
ডিরোজিয়োর মৃত্যুর তিন বছর পর কলকাতায় পড়তে আসা লালবিহারী দে শিক্ষক ডিরোজিয়ো সম্পর্কে তাঁর ছাত্রদের কাছ থেকে যা শুনেছিলেন সেটা শুনে তিনি লিখেছিলেন— ‘‘হিন্দু কলেজের তরুণ ছাত্রেরা বেকন (Bacon), লক (Locke), বার্কলে (Berkeley), হিউম (Hume), রীড (Reid), স্টুয়াট (Stewart) প্রমুখ পাশ্চাত্য দার্শনিকদের শ্রেষ্ঠ রচনার সঙ্গে ঘনিষ্ট পরিচয় লাভ করেন। এই পরিচয়ের ফলে তাঁদের গতানুগতিক চিন্তাধারার এক বৈপ্লবিক আলোড়নের সূত্রপাত হতে থাকে। প্রত্যেক বিষয়ে তারা প্রশ্ন করতে ও তর্ক করতে আরম্ভ করেন। তার ফলে তাঁদের অনেক প্রচলিত বদ্ধমূল ধারণার মূল নড়ে যায়। বহুকালের বাছা বাছা সব আস্তার স্তম্ভ টলমল করে ওঠে। এই নতুন শিক্ষার অপ্রতিদ্বন্দ্বী গুরু ছিলেন ডিরোজিয়ো।’’
এই ভাবে পাঠদানে পাঠ্যপুস্তক বর্জিত আরও নানা প্রশ্ন সামনে আসতে শুরু করলে ডিরোজিয়ো ভাবলেন, পাঠ্যপুস্তক বর্জিত এই সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এবং প্রত্যেকেরই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া দরকার। কিন্তু সেটা শ্রেণিকক্ষে সম্ভব নয়। তাই তিনি এই সকল নতুন প্রশ্ন ও তার উত্তর, তর্ক-বিতর্কের জন্য একটি সভার পরিকল্পনা করেন এবং সেই সভাটি প্রথমে স্থানান্তরিত করেন মানিকতলার শ্রীকৃষ্ণ সিংহের বাগানবাড়িতে। এই নতুন সভার নাম দেওয়া হল ‘অ্যাকাডেমিক আ্যসোসিয়েশন’। এর পর ধীরে ধীরে সেই সভায় আলোচনার বিষয় হল ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরোধিতা, নৈতিক ভণ্ডামি ও নোংরামি, বিচার-বুদ্ধিহীন শাস্ত্র বচন, প্রাণহীন চিরাচরিত আচার অনুষ্ঠান, জাতিভেদ ও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে যুক্তি সহকারে বিরোধিতা করা। নতুন চিন্তার বাহকদের এই সকল আলোচনায় রক্ষণশীলদের ভিত কেঁপে উঠল।
ডিরোজিয়োর ‘আ্যকাডেমিক আ্যসোসিয়েশন’ তো ছিলই। তার সঙ্গে দোসর হয়ে উঠল রাজা রামমোহনের প্রচেষ্টায় সতীদাহ প্রথা রদ আইন, ব্রাহ্মধর্মের প্রতিষ্ঠা এবং খ্রিস্ট্রধর্ম প্রচারের জন্য সস্ত্রীক আলেকজান্ডার ডাফের আগমন। এর ফলে হিন্দু সমাজে ভয়ঙ্কর রকমের গেল-গেল রব উঠল এবং উক্ত সব কিছুর জন্য দোষ গিয়ে পড়ল শিক্ষক ডিরোজিয়োর উপর। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল তিনি পাঠ্যপুস্তক বর্হিভূত পড়াশোনা করিয়ে ছাত্রদের মাথা নষ্ট করছেন, সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করছেন। সুতরাং, হিন্দু কলেজের প্রতিনিধিদের উচিত ডিরোজিয়োর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা।
অবশেষে, হিন্দু কলেজ কর্তৃপক্ষ ২৩ এপ্রিল ১৮৩১ সালে একটি সভা ডাকে। সেখানে শিক্ষক ডিরোজিয়োর পড়ানোর মান যে উন্নত, তাতে বেশি সংখ্যক সভ্য সমর্থন করলেন। তার ফলে আলোচনার মুখ ফিরিয়ে যখন হিন্দুসমাজের ক্ষতি ডিরোজিয়ো করছেন— এই প্রসঙ্গ ওঠে, তখন অনেকেই চুপ হয়ে গেলেন। কারণ যেখানে অন্ধ ধর্মের বিশ্বাস ও মূর্খতা প্রাধান্য পায় সেখানে যুক্তি, জ্ঞান, সত্যের কোনও জয়লাভ হয় না। যেমন ইউরোপে গ্যালিলিওর ক্ষেত্রে হয়েছিল তেমন হল ডিরোজিয়োর ক্ষেত্রে। সভায় ডিরোজিয়োকে কলেজ থেকে পদচ্যুত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল। সেই সংবাদ যখন তিনি উইলসন সাহেবের কাছ থেকে পান, তখন নিজেই নিজের বিরুদ্ধে ওঠা সব মিথ্যা অভিযোগ অস্বীকার করে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দেন। এর কিছু দিন বাদে ডিরোজিয়োর মৃত্যু হলেও তাঁর ছাত্রেরা গুরুর আদর্শকে অনেক দিন মেনে চলেছিল।
ডিরোজিয়ো উনিশ শতকে শিক্ষা ক্ষেত্রে যে নবজাগরণের ঢেউ এনেছিলেন, সেই ঢেউয়ের আঘাতে রক্ষণশীলতার দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেঙে পড়ে। বাঙালি সমাজে যে নতুন আলোর সূচনা করেছিলেন তিনি, তার সুফল বাঙালি যথেষ্ট পরিমাণে পেয়েছিলেন বলেই ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ বাঙালির আর্বিভাবের পথটি মসৃণ হয়েছে। আর বর্তমান সমাজে যে ভাবে উগ্র ধার্মিক আবহের সৃষ্টি হয়েছে, তাতে বর্তমান সমাজে ডিরোজিয়োর মতো অসংখ্য শিক্ষকের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
শান্তিপুর হরিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy