ছবি: সংগৃহীত
ধুত্তোর! সুশান্ত সিংহ রাজপুতের জন্য ন্যায়বিচার আদায় করা যে এই মুহূর্তে প্রায়রিটি লিস্টেই আসে না, এই সহজ কথাটা যদি দেড় ঘণ্টায় কারও মাথায় না ঢোকে, তা হলে আমি নাচার।’ মোবাইলটাকে টেবিলের ওপর প্রায় আছড়ে ফেলে সূর্য। প্রায় ছ’মাস পরে গোপালের চায়ের দোকানে আড্ডা বসেছে। চার জনই হাজির। টুকটাক আড্ডা চলছিল, কিন্তু সূর্যর মন পড়ে ছিল মোবাইলে।
‘ঘরে থেকে থেকে একেবারে খেপচুরিয়াস হয়ে গেছিস যে।’ সূর্যর মেজাজ দেখে ফুট কাটেন শিবুদা।
‘আর বলবেন না, কী কুক্ষণে যে ছোকরার ফেসবুক ওয়ালে সুশান্তের ছবি দেখে কমেন্ট করতে গেছিলাম!’ এক মিনিটেই সূর্যর মেজাজের পারদ নেমেছে অনেকখানি। ‘দেড় ঘণ্টা ধরে কথা বলে একটা যুক্তিও ওকে বোঝাতে পারলাম না। মনে হচ্ছিল যেন দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছি।’
‘সত্যিই কি একটা দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলি না?’ প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েই শিবুদা থামলেন। গোপাল চায়ের কাপ নিয়ে এসেছে, তার মুখ মাস্কে ঢাকা, নাকটা বাইরে। শিবুদা কটমট করে তাকিয়ে হাতের ইশারা করলেন, গোপালও মাস্ক টেনে নিল নাকের ওপরে। চায়ে চুমুক দিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন শিবুদা। তার পর বললেন, ‘দেওয়ালই বটে। অলঙ্ঘ্য দেওয়াল। জেলখানার সেলের— সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের প্রত্যেককে আটকে রেখেছে কুঠুরিতে। সলিটারি কনফাইনমেন্ট নয়, কুঠুরিতে অবিকল আমার মতো আরও অনেকে আছে। ইকো চেম্বার, যেখানে আমি যা বলি, প্রত্যেকে সেটার প্রতিধ্বনি করে— প্রত্যেকে যা বলে, আমি তার প্রতিধ্বনি করি। বাইরের আওয়াজ ভিতরে ঢুকতে পারে না। প্রশ্নটা হল, সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যুর মতো একটা ব্যাপার, যার আঁচ আমার-তোর জীবনে পড়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই— তাতেও মানুষ এই রকম কুঠুরিতে ঢুকে পড়ছে কেন?’
শিবুদা আড়মোড়া ভাঙলেন। বাড়ি থেকে না বেরিয়ে শরীরের কলকবজায় জং পড়ে গিয়েছে। তপেশ আজ এক রকম জোর করেই ধরে এনেছে গোপালের দোকানে। সবাই চুপ করে আছে দেখে তিনি ফের কথার খেই ধরে নেন। ‘সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের রক্তে ঢুকে পড়েছে, আর সেই সঙ্গে কুঠুরিতে থাকার অভ্যাসটাও। ফেসবুকের কাছে আমরা সবাই তথ্য। আমাদের পছন্দ-অপছন্দ, ভয়-ভালবাসা-আনন্দ-ঘৃণা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা দিয়ে সুপারকম্পিউটার আমাদের ডিজিটাল মূর্তি গড়ে রাখে। প্রোফাইলিং। তার পর, অ্যালগরিদম তোর প্রোফাইল বুঝে তোকে পাঠাতে থাকবে একের পর এক ভিডিয়ো, খবর, ব্লগ, ভ্লগ; যাদের সঙ্গে তোর মতামত মেলে, তাদের পোস্ট। তাদের পোস্টে তুই লাইক দিবি, তারা তোর পোস্টে লাইক দেবে— সব মিলিয়ে, প্রতিটা কুঠুরি এক একটা কুয়ো হয়ে ওঠে, আর আমরা সেই কুয়োর ব্যাঙ। যাদের কাছে, ওই কুয়োটাই দুনিয়া। ফলে, যখনই কুয়োর বাইরের কেউ কোনও কথা বলতে চায়, সেটা ভিন্গ্রহের প্রাণীর কথার মতো শোনায়, অর্থহীন এবং বিপজ্জনক।’
‘২০১৬ সালে ট্রাম্পের ক্যাম্পেনের কর্ণধার স্টিভ ব্যানন একটা কথা বলেছিল— যদি সমাজটাকে মূলগত ভাবে পাল্টাতে চাও, তা হলে আগে পুরনো সমাজটাকে ভেঙে ফেলতে হবে,’ শিবুদা থামতে কথার সূত্র ধরল তপেশ। ‘আমার কী মনে হয় জানেন তো, এই যে নিজের নিজের কুয়োর মধ্যে দুনিয়া, এটাই হল সেই ভেঙে ফেলা।’
‘একদম।’ তপেশের কথাটা লুফে নেন শিবুদা। ‘সমাজটাকে সম্পূর্ণ রিডিফাইন করে দিল সোশ্যাল মিডিয়া। তোর হাতে ধরা ফোনের স্ক্রিনটাই তোর পৃথিবী— সেখানে আর যারা আছে, তাদের সঙ্গে তোর এক জায়গায়, এমনকি এক দেশেও থাকার দরকার নেই, তোদের এক সুতোয় বাঁধবে কয়েকটা আবেগ। মানবসভ্যতার ইতিহাসের প্রাচীনতম দুটো আবেগ— রাগ আর ভয়। তোর কিসে রাগ হয়, কাকে তোর ভয়, তোর ডিজিটাল প্রোফাইল থেকে জেনে নিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া। তার পর, আস্তে আস্তে এমন সব জিনিস পাঠাচ্ছে তোর ফিডে, যাতে তোর ভয় বা রাগ বা বিশ্বাস ক্রমে জোরদার হতে থাকে। এ ভাবেই তৈরি হচ্ছে তোর নিজের দুনিয়া, নিজের সমাজ। পুরনো, প্রাক্-সোশ্যাল মিডিয়া সমাজের থেকে মৌলিক ভাবে আলাদা— এখানে বিরুদ্ধ মতের জায়গা নেই। এই কারণেই তুই বোঝাতে পারবি না যে, জাস্টিস ফর সুশান্ত আসলে একটা নিখাদ ধাপ্পাবাজি, সিরিয়াস প্রশ্নের থেকে নজর ঘুরিয়ে রাখার কৌশল।’
শিবুদা একটু দম নিলেন। তার পর বললেন, ‘ট্রাম্পের জয় আর ব্রেক্সিট, দুনিয়ার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া দুটো ঘটনার পিছনে যে কোম্পানি, সেই কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা নিজেদের কাজটাকে কী বলত জানিস— ডেটা ড্রিভ্ন বিহেভিয়র চেঞ্জ। সহজ কাজ— যদি দেখা যায়, কারও মনে মুসলমানদের প্রতি ভয়, তবে তার নিউজ়ফিডে সমানেই আসতে থাকবে মুসলমান সন্ত্রাসবাদের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে ভিডিয়ো, আরও অনেকের কমেন্ট, ব্লগ। কী ভাবে মুসলমানরা দখল করে নেবে গোটা দেশটাকে, সে বিষয়ে ভুয়ো ‘তথ্য’সমৃদ্ধ ফেক নিউজ়। যেটা তুই ভাবছিস, সেটাই যেন সবাই ভাবছে। এ দিকে, আমাদের মনের গঠনটাই এমন যে আমরা সেই কথাগুলোই লোকের কাছে শুনতে চাই, যেগুলো আমরা নিজেরা ভাবি। শুনলে, সেই কথাগুলোই আমাদের মনে থেকে যায়। আমার কথা নয়, বিলিফ রি-ইনফোর্সমেন্ট থিয়োরি সার্চ করে দ্যাখ, পাবি। অন্য দিকে, কানেম্যানদের লস অ্যাভার্শন থিয়োরির কথা ভাব— বিপদের গন্ধ পেলে মানুষের প্রতিক্রিয়া যে তীব্রতর হবে, তার আচরণ যে পাল্টাবে, তাতে সংশয়ের জায়গাই নেই। মানে, আমরা যেখানে ভাবছি যে হাতের মুঠোয় বিশ্ব নিয়ে ঘুরছি, সেখানে সোশ্যাল মিডিয়া আসলে আমাদের মগজ নিয়ে ছেলেখেলা করছে। আমরা পুতুল, সোশ্যাল মিডিয়ার হাতের পুতুল।’
‘শুধু রাজনৈতিক মেরুকরণের সুবিধা হবে বলে ফেসবুক এই রকম একটা বিপজ্জনক জিনিস তৈরি করে রাখবে?’ প্রশ্ন করল শিশির।
‘রাজনীতিটা নেহাত ঘটনাচক্রে,’ হাতে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করলেন শিবুদা। ‘রাজনৈতিক প্রয়োজনে এই বিভাজনকে ব্যবহার করা যায়, সেটা ঠিক। তুই উগ্র হিন্দুত্ববাদের বদলে এই বিভাজন ব্যবহার করে যদি পপকর্ন বেচতে চাস, তাতেও আপত্তি নেই। আসল প্রশ্নটা হল, এই রকম গোষ্ঠী প্রয়োজন হয় কেন? এর উত্তরটা মারাত্মক— একুশ শতকের টেকনোলজি আসলে মানুষকে আদিম মানুষের পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছে, যেখানে প্রত্যেকে শুধু নিজের গোষ্ঠীর প্রতি অনুগত, অন্য সবাই তার শত্রু। শত্রুতাটা জরুরি, কিন্তু আরও জরুরি আনুগত্য। ভেবে দেখ, যে কোনও একটা কথা একটা জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে হলে, সবাইকে সেই পথে হাঁটাতে হলে গোষ্ঠীটাকে কতখানি দৃঢ়সংবদ্ধ হতে হয়। সেটা এক দিনে হয় না, তৈরি করতে হয়। জাস্টিস ফর সুশান্তই বল, বা শশী তারুরকে ট্রোল করা, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক যে ট্রেন্ডই হোক, এটা হল সেই গোষ্ঠীকে ইচ্ছেমতো চালাতে পারার নেট প্র্যাকটিস। এটা পারে বলেই তো সোশ্যাল মিডিয়ার কদর।’
শিবুদা উঠে পড়েছিলেন। তপেশ বলে, ‘অ্যাটেনশন এক্সট্র্যাকশন কথাটা শুনেছেন?’
‘তুই নেটফ্লিক্সে দ্য সোশ্যাল ডিলেমা দেখে কথাটা শেখার অনেক আগেই।’ শিবুদা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন আবার। গোপালকে হাতের ইশারায় চা দিতে বললেন। ‘অবিশ্যি, কথাটা খাপ বুঝে বলতে পারলি দেখে বুঝলাম, তোর মাথায় ঢুকেছে।’
গোপাল চা দিল। চুমুক দিয়ে শিবুদা বললেন, ‘এক্সট্র্যাকশন— খনি থেকে তোলা। উত্তোলন। গোটা ক্যাপিটালিজ়মের ইতিহাসটাই দাঁড়িয়ে আছে এক্সট্র্যাকশনের ওপর, কোনও দাম না দিয়েই প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের ওপর। কয়লা, লোহা— প্রকৃতি থেকে এই দুটো জিনিস লুট না করলে শিল্প বিপ্লব হতই না। সে দিক থেকে ফেসবুক ক্যাপিটালিজ়মের ধ্বজা বইছে— আমাদের মনোযোগ উত্তোলন করছে আমাদের মগজ থেকে। আমাদের জন্য যে ভার্চুয়াল দুনিয়াটা তৈরি করে দিয়েছে, সেটায় আরও বেশি সময় কাটাতে, আরও মনোযোগ খরচ করতে বাধ্য করছে আমাদের। ভেবে দ্যাখ, একমাত্র পণ্য কিন্তু আমাদের মনোযোগটাই— বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে ওরা আমাদের মনোযোগের নিশ্চয়তাটাই বেচে। কার্যত গ্যারান্টি দেয়, এই মনোযোগের মধ্যে আমাদের যে দেখাবে, আমরা সেটাতেই বিশ্বাস করব, সেটাই কিনব— ঘৃণাও কিনব, পপকর্নও কিনব।
‘মজার কথা কী জানিস, এই মনোযোগ উত্তোলনের যন্ত্রপাতি আমরাই সোশ্যাল মিডিয়াকে দিয়েছি। নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ, লজ্জা-ঘৃণা-রাগের কথা জানিয়ে তৈরি করে দিয়েছি ডিজিটাল প্রোফাইল, যাতে ওরা জানে যে ঠিক কোথায় আমার মনোযোগ পাওয়া যাবে। আর তার চেয়েও মজার কথা হল, কয়লা বা লৌহ আকরিকের যে ক্ষমতা ছিল না, আমাদের কিন্তু সেটা ছিল, এবং আছে— চাইলে, আমরা এই মনোযোগ উত্তোলনে বাধা দিতে পারতাম। এখনও পারি। আমরা চাইনি, তাই পারিনি। সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের গুহামানবের জনগোষ্ঠী তৈরি করে দিয়েছে, বিনিময়ে আমরা আমাদের মগজটাকে ওদের দিয়ে দিয়েছি।’
হাতে ধরা চায়ের কাপটার দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকলেন শিবুদা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy