Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

কলেশ্বর-কলেশনাথ ঘিরে কতই কাহিনি

মূল গর্ভগৃহে কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গকে ঘিরে দেখা মিলবে আকর্ষণীয় শিল্পনৈপুণ্যের। মন্দিরের গায়েও পুরাণের বিভিন্ন দেবদেবী ও তাদের নানা লীলাদৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বিশাল এই মন্দিরের স্থাপত্য রীতি ও বৈচিত্র পরিচয় দেয় শিল্পী মননের দক্ষতা এবং নান্দনিক মূল্যবোধের। লিখছেন মধুরিমা ঘোষ।মূল গর্ভগৃহে কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গকে ঘিরে দেখা মিলবে আকর্ষণীয় শিল্পনৈপুণ্যের। মন্দিরের গায়েও পুরাণের বিভিন্ন দেবদেবী ও তাদের নানা লীলাদৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বিশাল এই মন্দিরের স্থাপত্য রীতি ও বৈচিত্র পরিচয় দেয় শিল্পী মননের দক্ষতা এবং নান্দনিক মূল্যবোধের। লিখছেন মধুরিমা ঘোষ।

কলেশ্বর-কলেশনাথ মন্দির চত্বর। ছবি: লেখক।

কলেশ্বর-কলেশনাথ মন্দির চত্বর। ছবি: লেখক।

শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৯ ০০:৩১
Share: Save:

শিবভূমি বীরভূমে বিক্ষিপ্ত ভাবে বহু ঐতিহাসিক শিবমন্দির ছড়িয়ে আছে। আপাত দৃষ্টিতে মন্দিরগুলির জনপ্রিয়তা জনমানসে ঠিক মতো ধরা না পড়লেও ইতিহাস বিচারে সেগুলির গুরুত্ব কোনও অংশে কম নয়। এ রকমই একটি কলেশ্বর-কলেশনাথ মন্দির। এই মন্দির তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা অলৌকিক ঘটনা, পুরাণের ছোঁয়া পেয়ে যেন আরও লোমহর্ষক অথচ জীবন্ত হয়ে ওঠে। কারও কাছে নিছক গালগল্পের মতো শোনালেও, ভক্তসমাজের কাছে তা পরম পবিত্রতায় পূর্ণ। বিভিন্ন কিংবদন্তি ও লোকমুখে পাওয়া তথ্যের উপরে ভিত্তি করে চলুন, একবার ফিরে তাকানো যাক কী ভাবে এই মন্দিরটি সুদীর্ঘ কালের চড়াই উতরাই পেরিয়ে সাধক মুনি-ঋষির মন্দির থেকে কলেশ ঘোষের মন্দির, তার পরে রাজা রামজীবনের মন্দির থেকে স্বামী দ্বারিকানাথ দেবতপস্বীর মন্দির আর সব শেষে আমাদের সকলের মন্দির হয়ে উঠল।

সাঁইথিয়া শহর থেকে প্রায় বারো মাইল পূর্বে রয়েছে কলেশ্বর নামের মায়াভরা গ্রাম। কলেশ্বরের এক মাইল উত্তরে সাঁইথিয়া-বহরমপুর বড় রাস্তা, অতীতে যা মিলিটারি রোড নামে পরিচিত ছিল। দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে ক্ষীণ সলিলা শিবগঙ্গা। এই নদীর উত্তর তীরে শ্মশান। পশ্চিমে দেবীদহ আর পূর্বে অনতিদূরে মুর্শিদাবাদ জেলার সীমারেখা। ইন্টারনেটে নাম ‘টাইপ’ করা মাত্রই সহজে পাওয়া যায় পথ নির্দেশিকা।

বর্তমান কলেশ্বর-কলেশনাথ মন্দিরের উচ্চতা একশো ফুটেরও বেশি। ফাল্গুন মাসে শিবচতুর্দশী তিথিতে শৈবতীর্থ কলেশ্বর ধামে শিবরাত্রি ব্রত উৎসব পালন করা হয়। একই সঙ্গে সাত দিন ব্যাপী মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের চল আছে। আনুষ্ঠানিকতার বৈচিত্রে এবং জাঁকজমকে বেশ আকর্ষণীয় এই উৎসব গ্রামবাসীদের উপহার দেয় আনন্দ মুখরিত কয়েকটা দিন। গ্রামে আছে রামকৃষ্ণ নাম আশ্রম, যেখানে লোকসাহিত্য, লোকসংস্কৃতি, লোকনৃত্য, লোকসংগীতের চর্চা হয়। এ ছাড়াও মন্দির চত্বরে হরিনাম সংকীর্তন থেকে দোল উৎসব, নন্দোৎসব, ভাদু, ভাজুই, শারদোৎসব—সবই হয়। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ যে যথৈব সত্যি, তা আরও একবার স্মরণ করিয়ে দেয় এই ব্রত উৎসব। মন্দির শীর্ষে এ সময় মানুতে ধ্বজা বাঁধা হয়। হাজার হাজার দর্শনার্থীর জন্য ভোগ প্রসাদের আয়োজন রয়েছে। ভক্ত মানুষের দান-অনুদানে এই মহোৎসব হয়। শিবচতুর্দশী তো বটেই, সারা বছরই পুণ্যার্থীদের আনাগোনা লেগেই থাকে কলেশ্বরে।

এ বার ফেরা যাক সেই আগের আলোচনায়। গগনস্পর্শী এই মন্দিরের আবির্ভাব ও বিস্তৃতি সম্পর্কে নানা সময় নানা কিংবদন্তি, জনশ্রুতি, লোককথা প্রচলিত আছে। অনেকে বিশ্বাস করেন, বহু মুনি ঋষির সাধনাক্ষেত্র ছিল কলেশ্বর ধাম। পর্বত নামে এক ঋষি এখানে দেবী পার্বতীর তপস্যায় রত ছিলেন। তাঁরই নামানুসারে গ্রামের নাম ছিল পার্বতীপুর। ঘন জঙ্গলাকীর্ণ ছিল তখনকার এই অঞ্চল। আবার লোকমুখে শোনা যায়, ধানঘড়া গ্রামের কলেশ ঘোষ পুজো করে শিবকে তুষ্ট করেন। চন্দ্রচূড় নামক পুথিতে কলেশ্বর ধামকে মৎস্য দেশে অবস্থিত মায়াতীর্থ রূপে অভিহিত করা হয়েছে। দেবাদিদেব মহাদেবের উক্তি—‘প্রকাশ হইতে যবে মোর ইচ্ছা হবে/কোন কোন মহাশয় মন্দির করিবে।’ (উপক্রমণিকা)

এ ভাবেই কলেশ ঘোষের মাধ্যমে কলেশ্বর-কলেশনাথ শিবের পুনঃপ্রকাশ ঘটে। পূর্বে যা পার্বতীপুর ছিল, তাঁর নামানুসারে এখন তা কলেশ্বর নামে আখ্যাত হল।

মন্দিরটির ইতিহাস সম্পর্কে আরও জানা যায়, সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে স্থানীয় ঢেকার স্বাধীনচেতা নরপতি রামজীবন রায় মন্দিরটি সংস্কার বিষয়ে মনোনিবেশ করেন। তিনি নিজে শিব শক্তির উপাসক ছিলেন আর স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পরে মন্দিরটি মোহনীয় রূপে তৈরিতে ব্রতী হন। তখনই নির্মিত হয় নয়টি চূড়া বিশিষ্ট সুউচ্চ মন্দির। ওই চত্বরেই তৈরি হল আরও কয়েকটি মন্দির, যেমন ভৈরব, বাসুদেব, চন্দ্রচূড় মন্দির। রাজা রামজীবনের নানা কীর্তি অদ্যাপি বীরভূমকে উজ্জ্বল করে রেখেছে। তার মধ্যে চণ্ডীপুরে তারা মায়ের মন্দির, বিরাট রামসাগর সরোবর, চিরঞ্জীব দিঘি, শিবসাগর উল্লেখযোগ্য। কৃষির সুবিধার জন্য বানানো এই সরোবরগুলি এখনও বর্তমান। মাস খানেক আগেও ঢেকা গ্রাম সংলগ্ন এলাকায় খননকার্যের সময় উদ্ধার হয়েছে রাজপরিবারের ব্যবহৃত কিছু অমূল্য পূজা সামগ্রী, সঙ্গে একটি পাথরের গৃহদেবতার প্রতিমূর্তি। রামজীবনের নির্মিত মন্দিরের ভিত্তি কাজ খুবই মজবুত ছিল। ছোট ছোট চৌকো ইট বর্তমান মন্দির প্রাঙ্গণের আশপাশে মাটির নীচে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। গ্রামবাসীদের অনেকেই মনে করেন, প্রাচীন শিব মন্দিরের পশ্চিম দিকে এক সুড়ঙ্গ-পথ ছিল। রাজা মন্দিরের সেবা পূজার জন্য বহু ভূসম্পত্তি দান করে গিয়েছেন। কিন্তু তার সিংহভাগই বর্তমানে বেহাত হয়ে গিয়েছে।

রামজীবনের মৃত্যুর পরে কলেশ্বর ধাম অনাদৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। শিবমন্দির ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে শুরু করে। এই দুর্দিনে মন্দির নির্মাণের দায়িত্ব তুলে নেন দক্ষিণখণ্ডের শ্রী শ্রী দ্বারিকানাথ দেবতপস্বী এবং গড়ে তোলেন বর্তমান মন্দিরটি। বাংলা ১৩৩২ সালে তিনি ভগ্ন শিব মন্দিরের ঈশান কোণে পর্ণ কুটিরে আশ্রম স্থাপন করেন। মন্দির নির্মাণ ও শিবালয় তথা আশ্রমে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বাবা একটি কমিটি গঠন করার পরামর্শ দেন, যার সভাপতি নিযুক্ত হন ভগবতীপুর নিবাসী নবীনচন্দ্র দুবে। পার্শ্ববর্তী সাঁইথিয়া, যুগসরা, জেমো, এরোয়ালি প্রভৃতি গ্রাম ও শহরের ভক্তগণ ওই কমিটির সদস্য মনোনীত হন। মন্দির নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় কাশিপুর নিবাসী অকিনচন্দ্র দাসকে। মন্দিরের সকল কাজ সুসম্পন্ন হতে সময় লাগে পনেরো বছর দু’মাস ষোলো দিন।

প্রায় ১০৯-১১০ ফুট উঁচু মন্দিরটি তৈরি করতে করতে লক্ষাধিক ব্যয় করা হয়। আর্থিক সাহায্যে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসেন মুর্শিদাবাদ জেলার রাজাধিরাজ ধীরেন্দ্রনারায়ণ রায়। প্রায় দু’মণ ওজনের পার্বতীমাতার অষ্টধাতুর মূর্তিটি তিনি দান করেন। ১৩৪৭-এর ২৮ শে মাঘ, মাঘী পূর্ণিমার দিন কলেশনাথের নতুন শিবমন্দির সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।

শিবালয় ও আশ্রম প্রাঙ্গণের ধারে পাশে বেল, হরিতকী, মহুয়া, মুচকুন্দ, গুলঞ্চ, কলিকা ইত্যাদি ফল-ফুলের গাছগুলি আপনাকে উপহার দেবে এক শান্তির পরিবেশ। উঁচু মন্দিরটির গর্ভগৃহে কিন্তু আপনাকে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রবেশ করতে হবে, হয়তো মন্দিরগুলির প্রবেশদ্বার এই রকম রাখা হয় যাতে শ্রদ্ধা ভক্তিতে মাথা নত হয়ে প্রবেশ করতে হয় অনাদি দেবের কাছে। মূল গর্ভগৃহে কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গকে ঘিরে দেখা মিলবে আকর্ষণীয় শিল্পনৈপুণ্যের। মন্দিরের গায়েও পুরাণের বিভিন্ন দেবদেবী ও তাদের নানা লীলাদৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বিশাল এই মন্দিরের স্থাপত্য রীতি ও বৈচিত্র পরিচয় দেয় শিল্পী মননের দক্ষতা এবং নান্দনিক মূল্যবোধের।

সরকারি অর্থানুকুল্যে বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে ঠিকই। তবে এখনও বিভিন্ন দিক থেকে অবহেলিত কলেশনাথ মন্দির। গ্রামবাসীরা মনে করেন, কলেশ্বরকে পর্যটন মানচিত্রের অর্ন্তভুক্ত করা হলে পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে, এলাকার আর্থসামাজিক রূপ বদলে যাবে। তাঁদের এই দাবি আজও অপূর্ণই রয়ে গিয়েছে, কিন্তু তাঁরা আশা ছাড়েননি স্বপ্নপূরণের। কথায় আছে ‘বিগ্রহ জাগ্রত হয় সাধকের সাধনায় নচেৎ তাহা পুতুল’। আপনি আধ্যাত্মিক হন বা নাস্তিক, তাতে কিছু যায় আসবে না, পুণ্য সঞ্চয়ার্থেই হোক বা ভ্রমণপিপাসু তার অভিজ্ঞতার ঝুলি পরিপূর্ণ করতে, আপনি ঘুরে আসতেই পারেন এই মন্দির। হতাশ হবেন না, হলফ করে বলতে পারি।

(লেখক বিশ্বভারতীর ছাত্রী ও সাহিত্য কর্মী, মতামত নিজস্ব)

অন্য বিষয়গুলি:

History Birbhum
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy