এই লেখা যখন লিখছি তার কিছুদিন আগে শান্তিপুর শহরের কৃষ্ণবল্লভ প্রামাণিক স্ট্রিটের প্রামাণিক বাড়ি লোকে লোকারণ্য। দূর-দূর থেকে ভক্তরা এসেছেন প্রসাদ পেতে।
সারা দিন ধরে মাইকের তাণ্ডব চালিয়ে চলছে নাম সঙ্কীর্তন, নানা অনুষ্ঠান। মাইকের দাপটে অন্যদের যে অসুবিধা হতে পারে, তা কেউ-ই খেয়াল রাখেননি, রাখেনও না। শান্তিপুরে শপিংমল উদ্বোধনে যেমন জনজোয়ার নেমেছিল, ঠিক তেমনই জনজোয়ারে যানজট। রাস্তা বন্ধ। আমাদের দীর্ঘ দিনের শান্ত পাড়াটা যেন জেগে উঠেছে কোনও জাদুকরের ছোঁয়ায়। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইসকন আয়োজন করেছে ঝুলন উৎসবের। এর কিছু দিন আগেই রীতিমত নোটিস লটকিয়ে তাঁরা দখল নিয়েছেন প্রামাণিক ঠাকুরবাড়ির। এই ঠাকুরবাড়ি নাকি তাঁরা দান হিসাবে পেয়েছেন প্রামাণিক পরিবারের উত্তরাধিকারীদের কাছ থেকে।
আমি ধর্মীয় ব্যাপারে খুব উৎসাহী নই কোনও কালেই। তবু নিজের শহরের নিজের এলাকার ঠাকুরের এই হাতবদল কোথাও ব্যথিত করেছে আমায়। আর সব চেয়ে ব্যথিত করেছে ঠাকুরবাড়ি সংলগ্ন মাঠটি দখল হয়ে যাওয়ায়। ওই মাঠ জুড়ে আমাদের বাল্য কৈশোরের কত স্মৃতি! পাড়ার মধ্যে ওই একটি খেলার মাঠেই কত সকাল, দুপুর, বিকেল। কত সন্ধ্যায় ঝিঁঝিঁ ডাকের গন্ধ গায়ে মেখে ফুটবল পিটিয়ে কাদা মেখে ঘরে ফেরা। এখন থেকে সেই মাঠ ভ্যানিশ।
এখন সেখানে মন্দির উঠবে। সাহেব-মেমরা কণ্ঠি পরে ‘হরে কৃষ্ণ’ বলে নেচে উঠবেন। সব হারানো নিঃস্ব মানুষ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আর হঠাৎ বড়লোকেরা ‘ধর্ম কর্ম ভাল’ বলে যোগ দেবেন সেই নাচে। আমার পাড়ার শান্ত পরিবেশ হারিয়ে চলবে অষ্টপ্রহর পেরিয়ে চৌষট্টি প্রহরের নামগান। আমরা যাঁরা পেরিয়ে এসেছি মধ্যবয়স তাঁরা বসে বসে ভাবব ওই মাঠে চার ফুট দশে সোনাদা’র সঙ্গে ফুটবল টুর্নামেন্টের কথা। দশ ওভারের ক্রিকেটের কথা। জঙ্গলে লুকিয়ে হুসহুস খেলার কথা। সব মিথ্যে হয়ে যাবে। সত্য হয়ে বাজবে শুধু নামগান। আর সেই নামগান শান্তিপুরকে শেখাবেন ইসকনের মোবাইল আর টিকিধারী সন্ন্যাসীরা। দামী দামী গাড়ি এসে থামবে। হা-ঘরে হাড় জিরজিরে মানুষগুলো অবাক চোখে দেখবেন— দামি গাড়ি আর বিদেশি সন্ন্যাসীনিদের। আমরা ভুলে যাব ইসকনের জন্মের বহু আগে শত শত বছর আগে বৈষ্ণবরসে সিক্ত আমাদের ‘শান্তিপুর ডুবুডুবু নদে ভেসে যায়’। শান্তিপুর নতুন করে পাঠ নেবে কর্পোরেট বৈষ্ণবচর্চার।
শান্তিপুরের পৌরসভা পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় পৌরসভা। এই পৌরসভা তৈরির জন্য যাঁরা অগ্রণী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কৃষ্ণবল্লভ প্রামাণিক। তাঁর নামেই আমাদের পাড়ার নাম কৃষ্ণবল্লভ প্রামাণিক স্ট্রিট। আর সেই মানুষটির ঠাকুরবাড়িটিই আজ নেই হয়ে গেল তাঁদের অযোগ্য উত্তরপুরুষের হাতে।
কলকাতা শহরের বয়স তিনশো বছর আর শান্তিপুর শহরের বয়স হাজার বছরেরও বেশি। এই শান্তিপুর অদ্বৈতাচার্যের শান্তিপুর। বিজয়কৃষ্ণের শান্তিপুর। শ্যামসুন্দর গোস্বামীর শান্তিপুর। নির্মলেন্দু লাহিড়ীর শান্তিপুর। কী করে ভুলে যাব শান্তিপুরের সংস্কৃতিচর্চায় এই প্রামাণিক বাড়ির মাঠটির অবদান? এই প্রামাণিক বাড়িতেই ১৯৩৩ সালে নাট্যমন্দিরের হয়ে শিশির ভাদুড়ী ‘সীতা’র অভিনয় করেছিলেন। উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে সংস্কার হয়েছিল বুড়োশিব মন্দির, যার অবস্থান এই প্রামাণিক ঠাকুরবাড়িরই উল্টোদিকে। এখনও সেই মন্দিরে লাগানো ঝাপসা ফলক স্মৃতি বহন করছে সেই ‘সীতা’ অভিনয়ের। এই মাঠেই ‘সাজাহান’ অভিনয় করেছিলেন ছবি বিশ্বাস, ঠাকুরদাস মিত্ররা। সে নাটকে গীতা দে হয়েছিলেন জাহানারা আর শ্যাম লাহা সেজেছিলেন দিলদার।
ঠাকুমার মুখে শুনেছি সেই সব অভিনয়ের কথা। স্বাধীনতার আগে তরুণ নাট্য সমাজ কত অভিনয় করেছে এই মাঠে মঞ্চ বেঁধে। প্রেমাংশু বসু, মহেন্দ্র গুপ্ত, রবীন মজুমদার—কত জন অভিনয় করেছেন এই মাঠে। সত্তর-আশির দশকেও দেখেছি এই মাঠে পাড়ার ছেলেরা মঞ্চ বেঁধে অভিনয় করছে। তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সুবীর সেন, কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায় থেকে ভি বালসারা— কত সঙ্গীতের বিচিত্র আসরের সাক্ষী এই মাঠ।
মামা-কাকা-মায়ের মুখে শুনেছি এই মাঠেই বসত ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার আসর, বিজয়া সম্মিলনীর আসর। এই সম্মিলনীর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র। সেই মাঠে এখন থেকে লেখা থাকবে ‘বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ’। যে সব তরুণেরা ধার করে পকেটের পয়সা দিয়ে ব্যাট-প্যাড-ডিউজবল কিনে সারা দুপুর নিজের ভারী রোলার টেনে পিচ তৈরি করে শান্তিপুরের ক্রিকেট লিগে চ্যাম্পিয়ন হতেন, তাঁরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবেন তাঁদের খেলার কোনও মাঠ নেই। সেখানে ‘হরে কৃষ্ণ’ বলে নাচছেন অচেনা-অজানা অন্য কোথাকার মানুষের দল, যাঁদেরকে আমাদের পাড়া কোনও দিন চোখেও দেখেননি। শুধু প্রশ্ন থেকে যাবে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি হলেই কি যাকে খুশি দানপত্র লিখে দেওয়া যায়? বিশেষ করে, যে বাড়িটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একটি শহরের কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ধর্মীয় ঐতিহ্য? পৃথিবীতে এমন শহর বিরল নয়, যেখানে আপনার ইচ্ছা হলে হলেই আপনি বাড়ির রং পাল্টাতে পারবেন না। ডিজাইন তো দূরের কথা। শান্তিপুরের ঐতিহ্যপূর্ণ মাঠকে রূপ দেওয়া যেত কোনও স্পোর্টস অ্যাকাডেমিতে। হতে পারত একটি আধুনিক প্রেক্ষাগৃহ, কৃষ্ণবল্লভের নামেই। দীর্ঘ দিন ধরে একটি আধুনিক প্রেক্ষাগৃহের দাবি জানিয়ে প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছুই সংগ্রহ করতে পারেননি সংস্কৃতির কর্মীরা। দানই যখন করলেন এমন কোনও মহৎ উদ্দেশ্যে করলেন না কেন এই প্রশ্ন ঘুরে জাগছে।
যেমন জাগছে এই প্রশ্নও যে, কেন চুপ সবাই? কোন মন্ত্রে চুপ সমস্ত রাজনৈতিক দলের কর্তাব্যক্তিরা? কেন চুপ শান্তিপুরের ঐতিহ্যবাহী বিগ্রহ পরিবারগুলি? কেন তাঁরা বললেন না আপনাদের উত্তরপুরুষেরা অযোগ্য ও শিকড়চ্যূত হলে আমাদের দিন, আমরা রক্ষা করব আপনাদের ঠাকুর? আমাদের ঠাকুরের সঙ্গেই পূজিত হবে আপনাদের ঠাকুর? কেন এলাকার লোককে ট্রাস্টি গঠন করে চালাতে দিলেন না কূলদেবতার পুজো?
সবার মুখে এক কথা— পুরো কাজটাই হয়েছে গোপনে, সবাইকে না জানিয়ে। অথবা বিশেষ কিছু জনকে জানিয়ে। আর নিন্দকের তো অভাব নেই। তাঁরা আড়ালে-আবডালে বলেই যাচ্ছেন কাঞ্চনমূল্যের জোরের কথা। আর সেই জোরের কাছে মাথা নত করে ভবিষ্যতে হয়তো অন্য কোনও বংশের বর্তমান বা উত্তরপুরুষেরা ‘দানপত্র’ করে দেবেন তাঁদের মন্দির আর কূলদেবতাকে। ধীরে ধীরে আমার শান্তিপুর হারাবে তার নিজস্বতা, মাটির গন্ধ, নিজস্ব ধর্মীয় ঐতিহ্য। নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে থাকব হয়তো আমরা। আর তখনও বক্তৃতা শুনব শান্তিপুরের ধর্ম-শান্তিপুরের কৃষ্টি-শান্তিপুরের ঐতিহ্য নিয়ে। শুধু ভিতরে ভিতরে চুরি হয়ে যাবে আমার শিকড়। হয়তো আরও চমক থাকবে রাসে। বড়গোস্বামী বাড়ি ছেড়ে লোকে হামলে পড়বে ইসকন ঠাকুর দেখতে। মুছে যাবে প্রামাণিক বাড়ি নামটা।
শুধু মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে কারও মনে হবে আমার দেশটা কেমন করে পরদেশি হয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে হোর্ডিং ঝুলবে ‘দিদিকে বলো’। ধূর্ত রাজনীতিক খুশি হবেন এই ভেবে যে ‘হরে কৃষ্ণ’র পরের পদটিই তো ‘হরে রাম’। তাকে ‘জয় শ্রী রাম’এ পাল্টে দিতে সময় লাগবে না বেশি। আর ভিতরে ভিতরে আমি বুঝতে শিখব ধর্ম ব্যাপারটা সত্যিই কী? মনে পড়বে রবীন্দ্রনাথের কথা। মনে পড়বে মানুষের ধর্মের কথা। উপলব্ধি করব এই কথা যে, ধর্মের নামে যত অধর্ম করেছে মানুষ, অধর্ম স্বয়ং অতটা পারেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy