দিল্লির হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় প্রবল শৈত্যপ্রবাহও যেন হার মেনে যায় ওদের উষ্ণশোণিত তেজস্বীর কাছে। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এমন প্রতিবাদ চিত্র প্রায় মাসাধিক কাল অতিক্রম করে আজও সমানভাবে দুর্দমনীয় ও দীপ্যমান। শাহিনবাগ যেন আজ সিএএ-বিরোধী দেশজোড়া আন্দোলনের সমস্ত শক্তির এপিসেন্টার। সততা ও অদম্য সাহসকে সঙ্গী করে, ‘আজাদি’র স্বপ্নকে বুকে নিয়ে রাজপথের মাটি আঁকড়ে পড়ে রয়েছেন সদ্যোজাত শিশু থেকে নবতিপর বৃদ্ধারাও। প্রশ্ন উঠতেই পারে, স্বাধীন দেশে আবার নতুন করে কিসের আজাদি? তাদের কাছে এই আজাদি— সরকারি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ থেকে নিশ্চিন্তের খোঁজে।
রেহেনার মাতৃক্রোড়ে সদ্য পৃথিবীর আলো দেখা ছোট্ট আশিয়ানা, যার মাথায় স্নেহের উষ্ণতার পরশ নবতিপর বৃদ্ধা আসমা বিবির। বৃদ্ধার অশক্ত কম্পিত প্রসারিত হাত যেন ভরসা জোগাচ্ছে নাওয়া-খাওয়া ভোলা অবস্থানরত মানুষগুলোকে। এ হাত শুধু নির্ভরতার আশ্বাস নয়, তা যেন দেশান্তরীর আশঙ্কামুক্তির প্রতিজ্ঞার শপথ। আসমা বিবি, অশীতিপর বিলকিস বেগম বা ৭৫-এর নূরুন্নেসারা যেন এই আন্দোলনের নিউক্লিয়াস। তাঁদের অভিভাবকত্বের স্নেহময়তায় চলতে থাকে সদাসতর্ক সুতীক্ষ নজরদারি। ছোট-বড় যে কোনও বিষয় তাঁদের ঘোলাটে, ছানি পড়া, ক্ষীণ দৃষ্টিসম্পন্ন চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। কে অভুক্ত, কে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল— সব কিছুই তারা দক্ষ হাতে সামলাচ্ছেন। বাড়ির কাজকর্মকে শিকেয় তুলে, বাড়ির নিশ্চিন্ত আশ্রয় থেকে অনেক দূরে, প্রবল শীতে লেপ কম্বলের উষ্ণতার ওমে আয়েশি রাত্রিযাপনকে ছুটি দিয়ে, দাদি আম্মার মতোই অগণিত মহিলারা তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে হাজির হচ্ছেন কোজাগরির এই রাজপথে। জীবনের অন্তিমকালে পৌঁছে শাহিনবাগের এই রাজপথই যেন এই মানুষগুলোর কাছে এখন অস্থায়ী বসত। অস্ফুট চোখে ছোট্ট আশিয়ানা যেন বলতে চাইছে— “জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি, এমন বিদ্রোহ কখনো দেখেনি কেউ, দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ, স্বপ্ন চূড়ার থেকে নেমে এসো সব–শুনেছ? উদ্দাম কলরব শুনেছ? তাদের দলের পেছনে আমিও আছি..’’
আসিয়ানার মতো সদ্যোজাতের সঙ্গে ছোট ছোট শিশুরাও আজ বাড়ি ছেড়ে রাজপথের এই আন্দোলনে বেশ মানিয়ে নিয়েছে। বাড়ির মহিলারা হেঁসেলে শিকল তুলে রান্নার পাঠ আপাত ভাবে স্থগিত রেখেছেন। অরন্ধনের আবহে মায়েদের ভরসা ঘরে রাখা চিড়ে, মুড়ি বা বিস্কুট, তাই তুলে দিচ্ছেন সন্তানদের বুভুক্ষু মুখে। কারণ, সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে মায়েরও আছে ধর্ণা মঞ্চে যাবার তাড়া। এই তাড়া একান্তই নিজের। পূর্বপুরুষের ভিটেমাটির সঙ্গে স্বীয় পরিবারের অস্তিত্বকে দেশের মাটিতে টিকিয়ে রাখার তাড়া। কচিকাঁচার দল নিজের মায়েদেরকে বায়না থেকে বিরত রাখছে। তারাও যেন বুঝতে শিখে গিয়েছে এখন বায়না করার সময় নয়। বাড়ি থেকে খেয়ে আসা মুড়ি-বিস্কুট ছাড়াও ধর্নামঞ্চে দেওয়া ডিম সিদ্ধ বা একটুকরো কেকই ওদের আহার্য। শীতের দুপুরে বিলানো গরম গরম খিচুড়ি ওদের কাছে এখন অমৃত সমান।
এই আন্দোলনের পুরোভাগে রয়েছেন মহিলারা। এই অবস্থান-বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে সাময়িক ভাবে ঘুচে গিয়েছে ধনী-দরিদ্রের শ্রেণিবৈষম্যের বিস্তর ব্যবধান।
অচেনার ভিড়ে সারা দিনের কাজকর্ম সেরে সন্ধ্যায় একে একে হাজির হচ্ছেন কারখানার শ্রমিক থেকে শুরু করে অফিস ফেরত কর্মী, স্কুল শিক্ষক, অধ্যাপক, ডাক্তার, আইনজীবী ও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। শিক্ষকেরা ছোটদের পড়াশোনার দিকে লক্ষ রাখছেন, দেখিয়েও দিচ্ছেন তাদের স্কুলের হোমওয়ার্ক। প্রথিতযশা যে চিকিৎসককে দেখানোর জন্য তিন মাস ধরে অপেক্ষা করতে হত, আন্দোলনের ভিড়ে উপস্থিত তিনিও। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি নিজে হাতে সব সামলাচ্ছেন। যে শপিংমলের মালিকেরা প্রাচুর্যের চূড়ায় অবস্থান করেন, তিনিও নেমে এসেছেন রাস্তায়। শ্রমিক কর্মচারীদের থেকে খাবার ভাগ করে একসঙ্গে সেরে নিচ্ছেন রাতের আহার। ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচের অপূর্ব মেলবন্ধনের বিরল চিত্র দেখা যাচ্ছে শাহিনবাগের রাজপথের ধর্না মঞ্চে। এই ভাবে রাত বাড়তে থাকে, ক্লান্তিতে ঘুম জড়িয়ে আসে চোখে। সেই সময়ে অকস্মাৎ মাইক্রোফোন হাতে তুলে নেয় খুদেরা। গেয়ে ওঠে সমস্বরে আজাদির গান। ঘুমের আড়মোড়া ভেঙে ছোটদের উদ্দামতায় নতুন করে জেগে ওঠে শাহিনবাগ। স্লোগান, কবিতায় ও গানে আবার মুখরিত হয়
রাজপথের ধর্নামঞ্চ।
মধ্যরাতে কেউ ফ্লাস্কে করে নিয়ে আসে চা-কফি। ভাগ করে চুমুক দিয়ে নেয় সবাই, উষ্ণতা আসে মনে। কেউ বা নিজের সাধ্যমতো খাবার নিয়ে এসে বিলোতে শুরু করেন। কারওর নিয়ে আসা গুটিকয়েক রুটি, রুটির সংখ্যার দ্বিগুণ সংখ্যক মানুষের মধ্যে অনায়াসে ভাগ করে খাওয়া হয়। সবকিছুর মধ্যেও কোথাও যেন কাজ করতে থাকে একটা চাপা ভীতি— এই বুঝি আবার এল পুলিশ! জোরপূর্বক উঠিয়ে দিল অবস্থান! অসম বয়সী মানুষগুলোর যুথবদ্ধতার শক্তিই ওদের সাহসের মূলধন, মনের জোর। বৃদ্ধ আনোয়ার নিজের মাফলার খুলে জড়িয়ে দেয় এক ছোট্ট শিশুর কানে। এক দোকানি কাজু, কিসমিস, আখরোট এনে বিলিয়ে দেয় সকলকে।
অনুষ্কা চৌধুরী কোলে তুলে নেয় ছোট্ট হামিদাকে, ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে আদরের সঙ্গে অস্ফুট স্বরে উচ্চারিত করে— ‘ইয়ে পেয়ারি পেয়ারি আজাদি’। এই ভাবে রাত পার করে আসে ভোর। নবপ্রভাতের নতুন সূর্যোদয়ের আশায় পেরিয়ে চলে একের পর এক কোজাগরি রাত্রিযাপন। দ্রোহের আগুনে তপ্ত শাহিনবাগ যেন শীতের প্রাবল্যকেও ম্লান করে দিচ্ছে। কেউ ধর্মীয় স্লোগান দিলে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে বারণ করা হচ্ছে, তিনিও তৎক্ষণাৎ নিজেকে সংশোধন করে নিচ্ছে।
তাঁরা জানেন, সিএএ-বিরোধী আন্দোলন শুধুমাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আবদ্ধ থাকলে ধর্মীয় মেরুকরণ আরও তীব্রতর হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাঁরা এ-ও জানেন, অমুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা যোগ না দিলে, এই আন্দোলন অচিরেই নিষ্প্রভ হয়ে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা। শাহিনবাগের শান্তিপূর্ণ ধর্না-অবস্থানের এই আন্দোলন এইখানেই অন্য আন্দোলনের চেয়ে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এখানে মুসলিম অমুসলিম বিবিধ মানুষের একত্র সহাবস্থানই আন্দোলনের ভিত্তিকে আরও সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছে। এই অরাজনৈতিক আন্দোলনকে হাতিয়ার করে কোনও রাজনৈতিক দল মাইলেজ কুড়োবে, কোনও ভাবেই সেটা হতে দেওয়া যাবে না। এটাই ওদের ধনুর্ভাঙা পণ।
শাহিনবাগ আন্দোলনের এই ধারা সংক্রামিত হয়েছে কলকাতার পার্কসার্কাস ময়দানেও। পার্কসার্কাসও যেন এখন হয়ে উঠেছে ‘মিনি শাহিনবাগ’। নাগরিকত্ব আইনের পুনঃসংশোধন ঘটিয়ে ধর্মীয় সমতা আনাই একমাত্র লক্ষ্য হোক।
লেখক শক্তিনগর হাইস্কুলের জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy