Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
যুদ্ধের বীজ রয়েছে ভারত পাকিস্তান জাতি-রাষ্ট্র পরিকল্পনার মধ্যেই

শান্তি দূর অস্ত্

সার্জিকাল স্ট্রাইকের রণনীতি নতুন নয়। কিন্তু, পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে নিয়ন্ত্রণরেখার ৭০ কিলোমিটার ভিতরে অনুপ্রবেশ করে বিমানহানার ঘটনা ১৯৭১-পরবর্তী সময়ে নজিরবিহীন। কেন এই সবল প্রত্যাঘাত?

উদ্‌যাপন: পুলওয়ামায় আঘাতের স্মৃতি এবং বালাকোটে প্রত্যাঘাতের স্বীকৃতি। পটনা, ২৬ ফেব্রুয়ারি। পিটিআই

উদ্‌যাপন: পুলওয়ামায় আঘাতের স্মৃতি এবং বালাকোটে প্রত্যাঘাতের স্বীকৃতি। পটনা, ২৬ ফেব্রুয়ারি। পিটিআই

শিবাশিস চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

পুলওয়ামার প্রত্যুত্তরে ভারতীয় সেনা মঙ্গলবার ভোরে পাকিস্তানের বালাকোটে জইশ-ই-মহম্মদের সবচেয়ে বড় জঙ্গি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে ১২টি মিরাজ ২০০০ বিমানের সাহায্যে বোমাবর্ষণ করে। ভারতের দাবি, এই প্রত্যাঘাতে তিনশোর ওপর জঙ্গির মৃত্যু হয়েছে। পাকিস্তান দাবি করছে যে, ভারতের বিমান হানা ব্যর্থ হয়েছে; বিমানগুলি দু’দেশের মধ্যবর্তী নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) অতিক্রম করলেও পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর তৎপরতায় তারা কোনও ক্ষতি সাধন করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান এর যোগ্য বদলার হুমকিও দিয়ে রেখেছেন। ভারতের বিমানহানায় ক্ষয়ক্ষতি না হলে ‘যোগ্য জবাব’-এর প্রয়োজনীয়তা কী, তা খুব পরিষ্কার নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা বিদেশ নীতি নির্ধারণে এই ধরনের অস্বীকারের কথোপকথনকে ব্যতিক্রম বলা যাবে না। কিন্তু পারমাণবিক শক্তিতে বলীয়ান দুই যুযুধান রাষ্ট্রের উত্তপ্ত বাতাবরণে এই ধারাভাষ্য আরও জটিলতা তৈরি করেছে। উত্তরোত্তর দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়ছে। কার্গিল-পরবর্তী সময়ে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধের এত কাছাকাছি আসেনি। দুই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যুদ্ধের পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে ক্রমাগত।

সার্জিকাল স্ট্রাইকের রণনীতি নতুন নয়। কিন্তু, পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে নিয়ন্ত্রণরেখার ৭০ কিলোমিটার ভিতরে অনুপ্রবেশ করে বিমানহানার ঘটনা ১৯৭১-পরবর্তী সময়ে নজিরবিহীন। কেন এই সবল প্রত্যাঘাত? ভারতের বিদেশ সচিব বিজয় গোখলে মন্তব্য করেছেন, এ অভিযান অ-সামরিক ও স্বতঃপ্রণোদিত। এর লক্ষ্য ছিল জইশ জঙ্গিদের আত্মঘাতী স্কোয়াড সদস্যদের আর একটি পুলওয়ামা ধাঁচের বড় মাপের ষড়যন্ত্রকে অঙ্কুরেই নির্মূল করা। যদি ভারতের দাবি ঠিক হয়, পাকিস্তানে লালিত সন্ত্রাসের পরিকাঠামো যে বড় ধাক্কা খেল, তা বলা চলে। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা যদি স্মরণে থাকে, এই আক্রমণাত্মক রণনীতি কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে তর্কের অবকাশ আছে। জাতীয়তাবাদ ও জনপ্রিয় সার্বভৌমত্বের ধারণায় নির্মিত জাতি-রাষ্ট্রে প্রত্যাঘাতের ভাবাবেগ ও ন্যায়বিচারের সরল মানদণ্ডে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে চালিত করার প্রবণতা অস্বাভাবিক নয়। ভারত ও পাকিস্তানের ইতিহাস, লাগামহীন বৈরিতা ও পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং তার সফল সামাজিকীকরণ, ঘৃণার রাজনীতি ও কথোপকথনে ক্রমবর্ধিত অনীহা, হিংসা ও প্রতিহিংসার যে ‘দুষ্টচক্র’ তৈরি হয়েছে, তা কিছু শান্তিকামী মানুষদের চেষ্টায় দূর হওয়ার নয়। তা ছাড়া, কথাটা আমাদের গণতান্ত্রিকতাকে যত আঘাতই করুক না কেন, জাতীয় নিরাপত্তা, বিদেশ নীতি ও সার্বিক নীতি নির্ধারণের ক্ষমতা রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে, এবং দু’দেশের নীতিনির্ধারকরা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্বিশেষে, মূলত একই দূরবিন দিয়ে নিরাপত্তাকে দেখে, আর নিরাপত্তার স্বার্থে জনসাধারণের মধ্যে দেশাত্মবোধ সঞ্চারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এর একটা নিজস্ব গতিপ্রকৃতি আছে। সরকার বদলাতে পারে, কিন্তু নিরাপত্তার ধারাভাষ্যটা বদলায় না। যুদ্ধের বীজ রয়েছে জাতি-রাষ্ট্র পরিকল্পনার মধ্যে। গণতন্ত্র আর জনকল্যাণ এই আদিমতাকে নিয়ন্ত্রণ করেমাত্র, অতিক্রম করে না।

নিরাপত্তা শাস্ত্রের যুক্তিতে ভারত পাকিস্তানের আজকের পরিস্থিতি কতকগুলো পুরনো কিন্তু প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়। প্রথমত, দু’দেশের সামরিক নিরাপত্তার সমীকরণ দাঁড়িয়ে আছে স্থায়িত্ব-অস্থায়িত্ব অসঙ্গতির ওপর। কিন্তু এই ধারণা আদতে একটি প্যারাডক্স বা কূটাভাস। অর্থাৎ, এর দুটো সম্ভাবনা হতে পারে। এক দিকে, দুই পারমাণবিক ক্ষমতা-সম্পন্ন দেশের মধ্যে ভীতির ভারসাম্য থাকলে সন্ত্রাসের সম্ভাবনা বাড়ে। সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়, মাইকেল ক্রিপন, পল কপূর, অ্যাশলে টেলিস প্রমুখ বিশেষজ্ঞের মতে, এই প্রবণতাই পাকিস্তানের রণনীতির প্রকৃষ্ট ব্যাখ্যা। অর্থাৎ, এক দিকে পারমাণবিক নিরোধক ভারতের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বলয় রচনা করেছে, যা পাকিস্তানের প্রচলিত সামরিক বাহিনীর অপ্রতুলতাকে অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক করে তোলে। অন্য দিকে, এই নিরাপত্তার বর্ম ইসলামাবাদকে উদ্দীপ্ত করে ভারতের বুকে সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে নিরন্তর ভাবে প্ররোচনা দিতে ও প্রত্যক্ষ ভাবে সন্ত্রাসবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে গড়ে তুলতে। দ্বিতীয়ত, ভীতির ভারসাম্য প্রচলিত যুদ্ধের সম্ভাবনাকে দমিয়ে রাখে, কারণ, কর্তৃত্বমূলক তীব্রতা বৃদ্ধির সুযোগ এই অবস্থায় কমে যায়। ভারতের বিমানহানা এই কৌশলগত ধারণাটিকে চ্যালেঞ্জ জানায়। পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তির প্রথম ব্যবহার থেকে বিরত থাকার অঙ্গীকারবদ্ধ নয়। ভারতের তুলনায় দুর্বল দেশ বলে আত্মরক্ষার্থে পারমাণবিক শক্তিকেই ব্রহ্মাস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে যে কোনও দেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সীমা লঙ্ঘন করে পড়শির বুকে বিমানহানা দুঃসাহসিক মানসিকতার নিদর্শন, ঝুঁকিসম্পন্নও। পারমাণবিক ভারসাম্য শুধু উপ-প্রচলিত কৌশলের সুযোগ তৈরি করে না; পাশাপাশি যুদ্ধের সম্ভাবনাকেও একটা নিম্নমাপের স্থিতিতে বেঁধে রাখে।

কিন্তু সামরিক রণকৌশলই একমাত্র পন্থা মেনে নিলে, আলোচনার বিষয়ের প্রকৃত গুরুত্ব পরিমাপ সম্ভব নয়। কেন পাকিস্তান ভারতীয় ভূখণ্ডে সক্রিয় সন্ত্রাসবাদী শক্তিগুলিকে মদত দিতে সক্ষম হয়? এই প্রশ্নের উত্তর না পেলে সমস্যার সমাধান হবে কি? কাশ্মীরের যুবসম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ কেন বিচ্ছিন্নতাকামী মনোভাবাপন্ন হয়ে পড়েছে, তা উপলব্ধি করার জন্য যে রাজনৈতিক দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠতার প্রয়োজন, তা কি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে? সুরক্ষাকরণের যুক্তি থেকে কি কাশ্মীরকে বার করা যাবে? সেনাবাহিনীর উপর সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে কাশ্মীরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যাবে না।

কাশ্মীর শুধু নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ নয়, আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকারও। পাকিস্তানের দুরভিসন্ধিমূলক নীতি কখনওই কার্যকর হবে না যদি ভারতের হৃত রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতার জমিটা উদ্ধার করা সম্ভব হয়। আজকের মেরুকরণের রাজনীতিতে এ নিয়ে কথোপকথনও সম্ভব নয়। রাজনৈতিক বৈধতার কথা উঠলেই দেশদ্রোহিতার কলঙ্কময় অভিযোগের ভাগিদার হতে হবে। সামনের দিনগুলোতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা-নির্মাণের যুক্তি আরও শক্তিশালী হবে। কিন্তু রাজনীতি থেকে নিরাপত্তাকে বিরত রাখলেই সব সমস্যার সমাধান হবে, এটা মেনে নেওয়া কঠিন।

রাষ্ট্রের চরিত্রের উপর তার বিদেশ ও প্রতিরক্ষা নীতি অনেকটাই নির্ভর করে। সমাজবিজ্ঞানী চার্লস টিলি অভিমত পোষণ করেছিলেন যে রাষ্ট্রের নির্মাণ প্রক্রিয়ায় যুদ্ধ হলে, যেমনটা পশ্চিম ইউরোপে ঘটে, রাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ অন্তর্কলহ কাটিয়ে বলীয়ান হয়, আর শক্তিশালী সামরিক বাহিনী, পুলিশ, কর-ব্যবস্থা ও আইনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। অন্য দিকে, উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশগুলো নির্মিত হল পারস্পরিক যুদ্ধ ছাড়াই। তাই এদের ভবিতব্য হল তীব্র অন্তর্কলহ, রাজনৈতিক বৈরিতা, আর দুর্বল প্রতিষ্ঠানসমূহ। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্যসাধন আর শক্তিশালী রাষ্ট্র নির্মাণের একটা আকর্ষণ এখানে থেকে গিয়েছে। পাকিস্তানের দিকে দেখলে ধর্মীয় মৌলবাদ আর রাষ্ট্রের যোগসাজশ সহজেই চোখে পড়ে। রাষ্ট্র কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠীকে কৌশলগত ভাবে ব্যবহার করতে থাকে সে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতাকে পূরণ করতে। পল কপূর দেখিয়েছেন, কী ভাবে বহু দশক ধরে এই নীতি ইসলামাবাদের রাষ্ট্রীয় ভিত্তিকে মজবুত করেছে, শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সাফল্য এনেছে, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ব্যাহত করেছে পাকিস্তানের স্বার্থে। কিন্তু আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ও বিশ্ব রাজনীতিতে এই রণকৌশলের অবৈধতা, পাকিস্তানের সামনে বড় বিপদ ডেকে এনেছে। প্রশ্ন হল, পাকিস্তান কি এই পথ পরিত্যাগ করতে পারবে? আফগানিস্তানের কৌশলগত গভীরতা পুনরুদ্ধারে ও কাশ্মীরে নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহারের প্রলোভন থেকে মুক্তির কোনও আশু সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।

ভারতের জাতীয় রাজনীতির জটিল আবর্তে, বিদেশ নীতি ও নিরাপত্তা নির্মাণ অঙ্গাঙ্গি। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতায় ‘ভায়োলেন্স’-এর গুরুত্ব অপরিসীম। জাতীয় নিরাপত্তার যুক্তির অন্যতম ভিত্তি জাতীয়তাবাদ। জাতি-রাষ্ট্রভিত্তিক ও জনপ্রিয় সার্বভৌমত্বে দীক্ষিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় অভ্যন্তরীণ হিংসার একটা রাজনৈতিক যুক্তি আছে। মানবদরদি, জনসমাজ-নির্ভর শান্তির যুক্তি এখানে অচল। ভারতের মতো রাষ্ট্রে নিরাপত্তার অমোঘ যুক্তিতে রাজনীতির সোপান নির্মাণ যত সহজ, উন্নয়ন, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বা বৈরিতার উৎসে গিয়ে তাকে সমূলে নির্বাপিত করা ঠিক ততটাই দুরূহ। নিরাপত্তার যুক্তিকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব নয়। আগামী দিনে তাই যে দল বা জোটই দিল্লির মসনদে বসুক, দু’দেশের সম্পর্কের গুণগত পরিবর্তনের আশা আছে বলে মনে হয় না।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক

অন্য বিষয়গুলি:

War India Pakistan India Pakistan Conflict
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy