নিজের টিফিন স্কুলে পুরোটা নিজেই খেতাম— এমন বদনাম কেউ কখনও করতে পারবে না। টিফিনটাইমে দিব্যি খোলতাই চেহারা হত টিফিন বক্সটার। এক দিকে আধখানা লুচির সঙ্গে এক টুকরো আলু, পোস্ত-মোড়া রুটি, খানিকটা ম্যাগি, একটু নোনতা সুজির (এখন বলি, উপমা) সঙ্গে এক কোণে পড়ে থাকত আমার নিজের মাখন-পাউরুটি আর সন্দেশের টুকরোরা। করোনা-পর্ব পেরিয়ে স্কুল খোলার আগে, সেই আমাকেই এখন খুদে কন্যাটিকে শেখাতে হবে, না, কারও সঙ্গে টিফিন শেয়ার নয়। নিজের টিফিন, বাড়ি থেকে পরিপাটি স্যানিটাইজ় করে পাঠানো টিফিন, শুধু নিজেরই। কে জানে, যদি অন্যের টিফিন বক্স থেকে আসা দুষ্টু ভাইরাস ঘরের ভেতর সেঁধিয়ে যায় চুপিসারে!
স্কুলবেলায় আলাদা ডেস্ক-চেয়ারে বসার সুযোগ ছিল না আমাদের। এক বেঞ্চেই চার-পাঁচ জন ঠেসাঠেসি, গুঁতোগুঁতি। এর ব্যাগ ওর ব্যাগের ঘাড়ে, এর কনুই ওর অঙ্ক খাতায়। বেঞ্চ কম পড়ে যেত। এখন বাচ্চারা শিখবে ক্লাসরুমে কী করে অন্যের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে হয়, স্কুলের গেটে বন্ধুকে দেখেই ছুট্টে গিয়ে হাত ধরতে নেই, বরং ওর সঙ্গেও যথেষ্ট ফাঁক রেখে বসতে হয়। টিফিনটাইমে গোল হয়ে হইহই গল্প, প্রাণখোলা হাসি, মাঠে ছুটোছুটি নয়। বরং এক অদ্ভুত আতঙ্ক ঘাড়ে চাপিয়ে, মাস্কে মুখ ঢেকে, নির্দিষ্ট সময় অন্তর হাত ধুয়ে যাওয়াই এই ২০২০ সালের শিক্ষা।
শিক্ষা আরও অনেক কিছুরই। ল্যাপটপ, মোবাইল শুধুই গেম খেলার জিনিস নয়, ওতেই এখন ক্লাস বসে। সেখানেই নিয়ম করে আসে হোমটাস্ক, হয় পরীক্ষা, খাতা দেখা। এই কথাগুলো লিখতে হয়তো কয়েক মিনিট লাগে, কিন্তু জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে এই বিশাল পরিবর্তনকে আত্মস্থ করতে ও শিশুদের সেটা বোঝাতে অনেক সময় দরকার। দুর্ভাগ্য, কোভিড-১৯ সেই সময়টা দিল না। কেন আমরা হঠাৎ এক মার্চ মাসে একটা খোলসের মধ্যে সবাই ঢুকে পড়লাম আর এই ভাবেই চলতে শুরু করলাম আগামী অনেক মাস ধরে, সেটা একটা চার-পাঁচ-ছয় বছুরেকে বোঝাতে কষ্ট হয়। কষ্ট হয় এটা ভেবে যে, একটা শিশুর গড়ে ওঠার জন্য যে সামাজিকতার মোড়ক খুব জরুরি, সেটা আমাদেরই কেমন ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে হচ্ছে। ‘নিউ নর্মাল’ শিক্ষা— একা থাকো, সুস্থ থাকো।
এই যে বাইরের সব দরজা-জানালা এঁটে প্রযুক্তির হাতেই জীবনটাকে প্রায় সঁপে দেওয়া হল, পড়া, নাচ-গান শেখা, আড্ডা সবই হয়ে গেল ভার্চুয়াল, বাচ্চাদের উপর তার প্রভাব কী হচ্ছে, সেটা নিয়ে আমরা যথেষ্ট ওয়াকিবহাল তো? না কি এইটুকু বয়সেই সে কেমন সুন্দর টেকনোলজিতে সড়গড় হয়ে যাচ্ছে, সেটা ভেবেই আত্মহারা? কথা হচ্ছিল এক শিশু চিকিৎসকের সঙ্গে। তিনি জানালেন, লকডাউন ঘোষণার সময় যে বাচ্চাদের বয়স ছিল এক থেকে দেড় বছর, ছ’মাস পরে এসে দেখা যাচ্ছে, তাদের অনেকেই কথা বলার সমস্যায় ভুগছে। হয় কথা শেখেইনি। নয়তো শিখলেও এই বয়সে যতটা শেখার কথা ছিল, ততটা হয়নি। প্রধান কারণ, তার সামাজিক মেলামেশা বন্ধ হয়ে যাওয়া। একটি শিশু শুধুই মা-বাবার কাছ থেকে কথা শেখে না। সে দাদু-ঠাকুমার গল্পের মধ্যে দিয়ে শেখে, সমবয়সি অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে আধো কথা বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে শেখে। তার পর স্কুলে তাতে পালিশ পড়ে। স্কুলের পরিবেশ, বন্ধুদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা বাচ্চাকে বইয়ের বাইরে আরও কিছু বাড়তি জিনিস শেখায়। একসঙ্গে খেলা, টিফিন ভাগ করা, বই দেওয়া-নেওয়ার মধ্যে দিয়ে সে সম্পর্ক তৈরি করতে শেখে। সেই প্রক্রিয়ার শুরুতেই যদি তাকে হঠাৎ থামিয়ে দেওয়া হয়, তা হলে এক বিরাট ছন্দপতন ঘটার সম্ভাবনা। আর এ তো তিন-চার মাসেই শেষ হয়ে যাওয়ার নয়। ইউরোপ, আমেরিকা থেকে আমরা দিব্যি বুঝতে পারছি, আগামী দিনে সংক্রমণের ঢেউয়ের পর ঢেউ আসবে, আসবেই। ফলে, শিশুদের ওপর এর প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী হতে চলেছে, তার হয়তো কোনও ধারণাই করতে পারছি না আমরা।
ধারণা না পাওয়ার আরও একটা কারণ, এমন পরিস্থিতি এর আগে কখনও দেখা যায়নি। মনচিকিৎসকেরা বলছেন, বিভিন্ন বাচ্চা বিকাশের বিভিন্ন স্তরে আছে। তার উপরেই নির্ভর করছে, সে শারীরিক দূরত্বের (‘সামাজিক দূরত্ব’ বেশি ব্যবহার না করাই ভাল) ধারণাটিকে কেমন ভাবে বুঝবে। যেমন, যারা একেবারেই খুদে, এক-দেড় বছর বয়স, তারা এই অস্বাভাবিকতাকেই স্বাভাবিক ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাদের বোঝানো তেমন সমস্যার নয়। আবার, ১৪-১৫ বছরের বাচ্চাকেও বোঝানো তুলনায় সহজ যে, আগামী ছয়-আট-দশ মাসের জন্য এই দূরত্ব বজায় রাখা কেন জরুরি।
কিন্তু একটি পাঁচ-ছয় বছরের বাচ্চার ক্ষেত্রে সমস্যা তুলনায় বেশি। তার কাছে ভবিষ্যতের ‘কী হবে’র অনিশ্চয়তার চেয়ে এই মুহূর্তটা অনেক বেশি জরুরি। ভাল-লাগা, স্বস্তির ধারণাটি তাদের কাছে তাৎক্ষণিকতায় ভর্তি। এই মুহূর্তে ছুট্টে গিয়ে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরা তাকে যে অনাবিল আনন্দ দেবে, সেই আনন্দ পেতে আরও ছ’মাস তাকে অপেক্ষা করে থাকতে হবে, এই জটিল তত্ত্ব তারা সহজে বুঝতে চায় না। ফলে এই মুহূর্তে যদি তাকে বন্ধুর কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়, তার প্রভাব তো পড়বেই। হয়তো ভবিষ্যতে বন্ধুত্ব বা অন্য সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রেও সে এক অদ্ভুত অনিশ্চয়তায় ভুগবে।
মনে রাখতে হবে, ভারতে শিশুর সংখ্যা এখন ৪০ কোটিরও বেশি। এদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশই নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে প্রতি দিন লড়াই করে চলেছে। দারিদ্র, পারিবারিক বা সামাজিক নিরাপত্তার অভাব প্রভৃতি কারণে তাদের শৈশব এমনিতেই টালমাটাল। নিঃসন্দেহে, কোভিড-পরিস্থিতি তাদের অবস্থাকে আরও অনেক গুণ অসহনীয় করে তুলল।
সাধারণ ভাবে গত ছ’মাসের পর্যবেক্ষণে মনচিকিৎসকেরা দেখেছেন, বাচ্চাদের মধ্যে উদ্বেগ, অবসাদ অনেক গুণ বেড়েছে। রোগ নিয়ে, মৃত্যু নিয়ে অনেকেই আতঙ্কে ভুগছে। অনেকে আবার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহটাই হারিয়ে ফেলেছে। এমন আচরণ অপ্রত্যাশিত নয়। একে তো তাদের বাইরে বেরোনো, খেলাধুলোর সুযোগ কমেছে, অন্য দিকে অনবরত মা-বাবার উদ্বেগের সংস্পর্শে থাকতে হচ্ছে। বাড়িতে কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে নানা আলোচনা তো চলছিলই, অসুখ-মৃত্যু নিয়ে একটা ভয়ের পরিবেশও তৈরি হচ্ছিল, তার সঙ্গে জুড়েছে দীর্ঘ লকডাউনে আর্থিক অনিশ্চয়তার বিষয়টি। পরিবারের কারও হয়তো চাকরি গিয়েছে, কারও আয় কমেছে অনেক, কেউ হয়তো শিশুটির স্কুলের মাইনে দিতে পারছেন না। আর এই সমস্ত উদ্বেগ, টানাপড়েন, ভয়, অশান্তির সাক্ষী থাকতে হচ্ছে বাড়ির একরত্তিটিকে। সে ক্রমশ খিটখিটে, জেদি, বায়নাবাজ হয়ে উঠছে। কখনও হয়তো সেই ঘেরাটোপের মধ্যেই নিয়মিত দেখতে হচ্ছে পারিবারিক হিংসার নানা ছবি। সমীক্ষা বলছে, লকডাউনে বিশ্বের সঙ্গে এ দেশেও অত্যন্ত বেড়েছে শিশু নির্যাতনের হার। তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে একটি শিশুর ছোট্ট, রঙিন দুনিয়া। কী অসহায় অবস্থা!
এই পরিস্থিতিতে ভীষণ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে মা-বাবার ভূমিকা। তাঁরা কী ভাবে পরিস্থিতি সামলাচ্ছেন, তার উপরেই শিশুর ভাল থাকা, না-থাকা অনেকটা নির্ভর করে। এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র সন্তানকে সংক্রমণ থেকে আগলে রাখাই যেন তাঁদের একমাত্র কর্তব্য হয়ে না ওঠে, মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও যেন সমান নজর থাকে। অতিরিক্ত সাবধানি হয়ে শিশুদের জবরদস্তি নিয়ম পালনে বাধ্য করে লাভ নেই। তাতে না-মানার প্রবণতা আরও বাড়বে। মনে রাখতে হবে, বাচ্চাদের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা যথেষ্ট। ক্ষেত্রবিশেষে বড়দের চেয়েও বেশি। তাই তার মতো করে বোঝালে, এবং নিজে সেই নিয়মগুলো মানলে বাচ্চাও এক সময় এতে অভ্যস্ত হবে। চাকরির টেনশন, সংক্রমণ সংখ্যা, মৃত্যু নিয়ে অনবরত ভয়-ধরানো আলোচনা থেকে তাকে দূরে রাখাই ভাল। থাক না সে তার নিজের অ-বাস্তব দুনিয়ায়। বাইরে বেরোনো একেবারে বন্ধ করে দেওয়া নয়, সব রকম স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিরাপদ জায়গায় তাকে নিয়ে একটু হেঁটে আসা, বাড়ির ছাদে কিংবা খোলা মাঠে হাত-পা ছোড়ার সুযোগটুকু করে দেওয়াও জরুরি।
কোভিড পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে, কেউ জানে না। আমরা এখনও সংক্রমণের মাঝসমুদ্রে দাঁড়িয়ে আছি, স্থলভাগের দেখা নেই। তাই বাচ্চাদের মানসিক স্বাস্থ্য আগামী দিনে কেমন হতে চলেছে, তা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর সময় এখনও আসেনি। তবে, অতি বেপরোয়া না হয়েও, সীমাবদ্ধতার মধ্যেই কিছুটা স্বাভাবিকতার স্বাদ তাদের দেওয়ার সময়ও হয়তো এ বার এসেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy