Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Herbal

বাঁচানো হোক বিশল্যকরণী

প্রকৃতির মধ্যে থাকা ভেষজ গাছগুলোর হারিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ক্রমশ বেড়ে ওঠা নগরসভ্যতা, গাছগুলোকে আগাছা হিসাবে গণ্য করে তাদের ধ্বংস করা, বর্তমান প্রজন্মের তার চারপাশের প্রকৃতির প্রতি উদাসীন হওয়ার মতো বেশ কিছু কারণকেই দায়ী করছেন পরিবেশবিদেরা। এদের বিলুপ্তি আটকাতে বাড়ির টবেই লাগানো হোক। সমস্যার কথা হল, চোখের সামনে আগাছার মতো বেড়ে ওঠা এই গাছগুলো ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে থেকে।

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

সুদীপ ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৬:১৬
Share: Save:

জীবনের পথে ফেলে আসা অনেকগুলো বছরকে পিছনে ফেলে এক পা এক পা করে পিছন দিকে হাঁটি। হঁাটতে হাঁটতে কখনও যদি ছোটবেলার সেই রাতে ফিরে যাই!

সেই ঝিঁঝিঁ পোকা, আর শিয়াল ডাকা ঘুটঘুটে অন্ধকারের রাতে তখন টিনের চালে অবিরাম বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে। ঘরের মাঝে লন্ঠনের শিখাটা শ্রাবণ রাতের দমকা হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠছে মাঝে মাঝেই। একই সঙ্গে ঘরের কোণে চৌকিতে শুয়ে ভীষণ জ্বরে কাঁপছে একটা ছোট্ট শিশু। সঙ্গে বেদম কাশি।

মাথার কাছে বসে ঠাকুরমা মাথায় জলপট্টি দিচ্ছেন ঘন ঘন। কিছু ক্ষণ পর পর মা এসে দিয়ে যাচ্ছেন মধু, তাল মিছড়ি, দারুচিনির সঙ্গে বাসকপাতা ফুটিয়ে ছেঁকে নেওয়া পানীয়। ঠাকুরমার নির্দেশে ছোট্ট শিশুটিকে চিবিয়ে খেতে হচ্ছে একটা উৎকট স্বাদ-গন্ধ যুক্ত কাঁচা নিসিন্দা পাতা।

সে সময় জ্বর হলেই প্যারাসিটামল বা কাশি হলে কাফ সিরাপ এত সহজলভ্য ছিল না গ্রামের মানুষের কাছে। তাঁরা ওষুধে এত অভ্যস্তও ছিলেন না। জ্বর-জ্বালা হলে বাড়ির আশপাশের গাছগাছালিই ছিল মানুষের সুস্থ হয়ে ওঠার মূল ভরসা। ঔষধি গুনে ভরা কালমেঘ, ঘৃতকুমারি, তেলাকুচো, পলতা, আকন্দ, বৈচি, থানকুনি, কুলেখাড়া, ব্রাহ্মি, কলমি, হ্যালেঞ্চার মতো কতশত নাম জানা, না জানা গুল্ম, বৃক্ষ, শাক গ্রামবাংলার পথঘাটে ছড়িয়েছিটিয়ে ছিল তখন।

এখন যাদের অনেকগুলোই হারিয়ে গিয়েছে বা হারিয়ে যেতে বসেছে। তাদের গুণাগুণ সম্বন্ধেও সচেতন নয় বর্তমান প্রজন্ম। এই যেমন ঘুসঘুসে জ্বরে নিসিন্দা পাতা, সর্দি কাশিতে বাসক, তুলসিপাতা তো আছেই। রক্তাল্পতায় কুলেখাড়া, বুদ্ধি বিকাশে ব্রাহ্মি, অনিদ্রায় শুষনিশাকের ব্যবহার তো অতি পরিচিত। কৃমির জন্য সাত সকালে কাঁচা কালমেঘ পাতা, আনারস পাতার রস তো মহৌষধ বলে মনে করা হয় এখনও। পেটের সমস্যায় থানকুনি পাতা, গাঁদাল পাতা ব্যবহারে ভালোফল মেলে। কেটে গেলে রক্ত বন্ধ করতে বন তুলসি, পাথর কুচি, গাঁদা বা কচার আঠা ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেওয়া— এ সব তো খুব চেনা টোটকা ছিল ছোটবেলায়।

বেশ কিছুদিন আগেও সাত সকালে নিম, কচা বা বাড়ির পাশে ঝোপ হয়ে থাকা আশশেওড়ার ডাল দিয়েই দাঁত মাজতেন গ্রামবাংলার মানুষ। ভ্যারান্ডা, জীবলি বা পলতা মাদার গাছের ডাল দিয়ে বাড়ির বেড়া দেওয়া তো খুব সাধারণ ব্যপার ছিল একটা সময়। চৈত্র মাসে টানের সময়ে সেই ডাল পুঁতলে তার থেকে সহজেই শিকড় বেরিয়ে গাছ হয়ে যেত। এখন তো জীবলি বা পলতা মাদার গাছ প্রায় চোখেই পড়ে না। জংলি গাছগুলোর মধ্যে দাদমর্দন, পলতা মাদার (পারিজাত), কেওকন্দর মতো বেশ কিছু গাছের ফুল এত সুন্দর দেখতে যে, তাদের বাহারি গাছ হিসেবেও বাড়িতে লাগানো যেতেই পারে। চাকুন্দা, দাদমর্দন গাছের রস চর্মরোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করার রেওয়াজ আছে। এমনকি, গায়ে লাগলেই গা চুলকায় যে বিছুটি গাছকে আমরা এড়িয়ে চলি সেই গাছও চর্মরোগ, প্রস্রাবের সমস্যা, মাথাব্যথা, হাঁপানিতে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

আগে রাস্তার ধারে প্রচুর হাতিশুঁড় গাছ দেখা যেত, যা চোখের সমস্যায় ও গাঁটের ব্যথায় ব্যবহার হত। গ্রামগঞ্জের রাস্তার ধারে ধারে হলুদ ফুলের কাল কাসুন্দার ঝোপ আজও চোখে পড়ে। যা কাশি, রক্তের দোষে ব্যবহার করা হয়। আগে তো বাড়িতে বেড়া দেওয়ার জন্য মেহেন্দি গাছেরও খুব কদর ছিল। মেহেন্দি পাতা বেটে মহিলারা হাতে মেহেন্দি করতেন, তেমনই আবার চুল কালো করতে হাতের নাগালে পাওয়া কেশুত গাছের পাতারও যথেষ্ট ব্যবহার ছিল।

সমস্যার কথা হল, চোখের সামনে আগাছার মতো বেড়ে ওঠা এই গাছগুলো ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে থেকে। গাছগুলোর হারিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ক্রমশ বেড়ে ওঠা নগর সভ্যতা, গাছগুলোকে আগাছা হিসাবে গণ্য করে তাদের ধ্বংস করা, বর্তমান প্রজন্মের তার চারপাশের প্রকৃতির প্রতি উদাসীন হওয়ার মতো বেশ কিছু কারণকেই দায়ী করছেন পরিবেশবিদেরা।

কৃষ্ণনগরে রাষ্ট্রীয় উদ্যান গবেষণা কেন্দ্রের প্রাক্তন প্রধান তথা উদ্যানবিদ ব্যাসদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কোভিড পরিস্থিতিতে লকডাউনের সময়ে চারপাশে বেড়ে ওঠা বনজঙ্গলের মাঝে, হারিয়ে যেতে বসা কিছু কিছু গাছ আবার চোখে পড়তে শুরু করেছে। এটা ভাল লক্ষণ।’’

এ ছাড়াও এখন বিভিন্ন স্কুলে ভেষজ উদ্যান করার ব্যপারে উৎসাহ বেড়েছে। ‘‘এতে ছাত্রছাত্রীরা এই সব গাছ চিনতে পারছে সহজে’’— বলে মত ব্যাসদেবের। এ ছাড়াও তাঁর পরামর্শ, এরা বেশির ভাগই জংলা গাছ হওয়ায় এদের আলাদা করে বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয় না। নিজে থেকেই বেড়ে ওঠে।

তাঁর মতে, খুব সহজেই কালমেঘ (Andrographis paniculata), বাসক (Justicia adhatoda), শুষনি (Marsilea quadrifolia), পাথরকুচি (Bryophyllum pinnatum), গাঁদাল (Paederia foetida), তুলসী (Ocimum Sp), থানকুনি (Centella asiatica)-র মতো খুব প্রয়োজনীয় কয়েকটি গাছ বাড়ির টবে লাগিয়ে রাখা ভাল।

তাতে প্রকৃতি থেকে এই সব ভেষজ, জরুরি গাছের উবে যাওয়া খানিক রোখা যাবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Herbal Trees
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy