একসঙ্গে: ম্যারাথনের নামে হওয়া দৌড় প্রতিযোগিতাগুলিতে যোগদানকারীদের সংখ্যা থাকে চোখে পড়ার মতো বেশি। নিজস্ব চিত্র
দূরত্বের নির্দিষ্ট সীমা মানার বালাই নেই। থাকে না চিকিৎসা পরিষেবা কিংবা যান নিয়ন্ত্রণ। তবু সেগুলি নাকি ম্যারাথন! অন্তত তার আয়োজকেরা তো তাই দাবি করেন।
ইতিহাস বলছে, ৪৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক এবং পারসিকদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। সেটি ম্যারাথনের যুদ্ধ নামে পরিচিত কারণ যে ময়দানে যুদ্ধ হয়েছিল তার নাম ছিল ম্যারাথন। সেখানে গ্রিকদের জয় হয়। গ্রিক দূত ফেইডিপ্পিডেস ম্যারাথনের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ৪২.১৯৫ কিলোমিটার বা প্রায় ২৬ মাইল ছুটে গ্রিসের অন্যতম প্রাচীন শহর আথেন্সে এসে জয়ের খবর দেন। তবে জয়ের আনন্দ উপভোগ করার আগেই মৃত্যু হয় ফেইডিপ্পিডেসের। সেই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতেই শুরু হয়েছিল ম্যারাথন দৌড়। এই দৌড় প্রথমে গ্রিসের প্রাচীন অলিম্পিকে স্থান পেয়েছিল। ১৮৯৬ সালে আধুনিক অলিম্পিক শুরু থেকেই এই দৌড়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফেইডিপ্পিডেস অনেক চড়াই-উতরাই টপকে আথেন্সে এসেছিলেন। তাই এই দৌড়কে অনেকে ‘ক্রস কান্ট্রি রেস’ও বলেন।
আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, ম্যারাথনে ৪২ কিলোমিটার দৌড়তে হয়। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার সঙ্গে দুই মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রামেও ম্যারাথন দৌড় হয়। ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট অ্যাথলেটিক অ্যাসোসিয়েশনের অধীনে বেঙ্গল রোড রেস অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে ডিস্ট্রিক্ট রোড রেস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালনায় প্রতি বছর এই আয়োজন করা হয়। সেগুলির স্থানীয় আয়োজক হিসেবে থাকে বিভিন্ন ক্লাব ও ক্রীড়া সংগঠন। জেলা পর্যায়ে আয়োজিত এই প্রতিযোগিতারগুলির রুটের দূরত্ব ২৫ কিলোমিটারের বেশি হয় না বললেই চলে। তাই আন্তর্জাতিক নিয়ম মানলে কোনও ভাবেই সেগুলি ম্যারাথন নয়। তবে অনেক আয়োজক সেগুলিকেই ম্যারাথন বলে চালানোর চেষ্টা করেন। কেউ কেউ বলেন মিনি ম্যারাথন বা হাফ ম্যারাথন।
জেলার জেলায় ক্রীড়া আধিকারিকদেরক কাছে এই দৌড়গুলি ‘রোড রেস’ নামে পরিচিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই আয়োজনে নানা অনিয়ম থাকে। ডিস্ট্রিক্ট রোড রেস অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গিয়েছে, দুই মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ‘রোড রেস’ হয় পশ্চিম মেদিনীপুরে। এই জেলার বিভিন্ন জায়গায় বছরে কমবেশি ২৫০টি রোড রেস হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনও অনুমতি থাকে না। কোনও কোনও জায়গায় স্থানীয় থানা, ব্লক প্রশাসনের আধিকারিক অথবা নেতাদের নিমন্ত্রন করলেও অনুমতির বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার এক ক্রীড়া আধিকারিকের ক্ষোভ, ‘‘আগে রো়ড রেসগুলির অতিথি হিসেবে কোনও ক্রীড়াবিদ আসতেন। তবে ইদানিং এই প্রতিযোগিতায় ক্রীড়া ব্যক্তিত্বদের বদলে নেতা-মন্ত্রীরা আসেন।’’
অনিয়মগুলি কী রকম?
আগে জেলায় জেলায় শুধুমাত্র শীতকালেই ‘রোড রেস’ হত। এখন প্রায় সারা বছর ধরেই হয়। যদিও গরম ও বর্ষায় এই দৌড় বেশ বিপজ্জনক। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন প্রান্তে কম দূরত্বের ‘রোড রেসে’ ১০-১২ বছরের ছেলে-মেয়েরাও যোগ দেয়। ওইটুকু বয়সে তাদের যে দূরত্ব অতিক্রম করতে হয় সেটা অনেকটাই বেশি। যে রুটে ‘রোড েরস’ হয় সেখানে যান নিয়ন্ত্রণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকে না বললেই চলে। বেশিরভাগ জায়গায় স্বেচ্ছাসেবক দিয়েই কাজ চালানো হয়। যদিও তাঁদের যান নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক জ্ঞানটুকুও নেই। ফলে যে কোনও সময়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ঘটেও।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতিযোগীদের শারীরিক পরীক্ষার ব্যবস্থাও থাকে না। যে কোনও পর্যায়ের ম্যারাথন আয়োজন করতে গেলে এক কিলোমিটার অন্তর চিকিৎসক ও জলের ব্যবস্থা থাকার কথা। কিন্তু সেই নিয়মও মানা হয় না। এমনকি, অনেক জায়গায় অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থাও থাকে না। অনেক সময় দেখা যায়, প্রতিযোগীদের উৎসাহ দিতে রাস্তার একপাশ দিয়ে মোটরবাইক যায়। সেই মোটরবাইকে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে।
পূর্ব মেদিনীপুরে ছোট-বড় মিলিয়ে বছকে প্রায় ৩০টি ‘রোড রেস’ হয়। এখানেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনও অনুমতি নেওয়া হয় না। সমস্যার কথা স্বীকার করে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা ডিস্ট্রিক্ট রোড রেস অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক ত্রিদিবনাথ হাজরা বলেন, ‘‘যেভাবে নিয়মের তোয়াক্কা না করেই বিভিন্ন ক্লাব সংগঠন রোড রেসের আয়োজন করছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে যে কোনও সময় বড় অঘটন ঘটতে পারে।’’ বেঙ্গল রোড রেস অ্যাসোসিয়েশনের সহ সভাপতি তথা পশ্চিম মেদিনীপুর রোড রেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি উদয়রঞ্জন পালের ক্ষোভ, ‘‘জেলায় অধিকাংশ ক্লাব ম্যারাথন করার জন্য কোনও লিখিত অনুমতি নেয় না। বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও আয়োজকরা আমাদের কথায় কেউ কান দেন না। আমরা এই বিষয়ে খুবই উদ্বিগ্ন।’’
তবে এর মধ্যেই কিছুটা ব্যতিক্রম হল ঝাড়গ্রাম। ঝাড়গ্রাম মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক অমিত হাজরা বলেন, ‘‘ঝাড়গ্রাম শহরে বছরে তিনটি রোড রেস হয়। তার সবকটিই ডিস্ট্রিক্ট রোড রেস অ্যাসোসিয়েশনের নিয়ম মেনে হয়। মফস্বলে আরও গোটা তিনেক প্রতিযোগিতা হয়। সেগুলিও স্থানীয়ভাবে অনুমতি নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।’’
মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক চিকিৎসক সৌগত রায় জানান, মাত্রাতিরিক্ত দৌড়ে হৃদযন্ত্র ও দেহের রক্তসঞ্চালন এবং মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চালনে নানা সমস্যা আসতে পারে। কেউ হৃদযন্ত্রের সমস্যা নিয়ে রোড রেসে নামলে হৃদরোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
অনিয়ম রয়েছে এটা যেমন সত্যি, তেমনই এটাও সত্যি যে বছর চার-পাঁচেকের মধ্যে জেলায় ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ম্যারাথন। কীভাবে? এর একটা কারণ যদি হুজুগ হয়ে থাকে, তবে অন্যটি অবশ্যই মোটা অঙ্কের আর্থিক পুরস্কারের হাতছানি। তিন জেলার কয়েকটি মিনি ম্যারাথনে প্রথম পুরস্কার মূল্য থাকে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এছাড়া সোনা-রুপোর পদক, আকর্ষণীয় উপহার ও যোগদানকারীদের পুরস্কার তো আছেই।
সেই কারণেই অনেকে অসুস্থ শরীর নিয়েই দৌড়তে চলে আসেন। কোনও কোনও ‘রোড রেসে’ দৌড়তে দেখা যায় কিশোরদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy