‘দেখ আমি বাড়ছি মাম্মি’। বিজ্ঞাপনের সেই পরিচিত স্লোগানটাকে ধার করে আমরা কি বলতে পারি, ‘দেখ আমি বাড়ছি গণতন্ত্র’? এই আমি কারা? এই আমি আসলে ভারতবর্ষের মহিলারা, যাঁরা অনেক লড়াইয়ের পরে আস্তে আস্তে ভারতবর্ষের সংসদীয় গণতন্ত্রে জায়গা করে নিচ্ছেন। এই বছর ভারতবর্ষের লোকসভায় ৫৪২ জন সাংসদের মধ্যে ৭৮ জন মহিলা। অর্থাৎ শতাংশের হিসেবে আমাদের লোকসভায় ১৪ শতাংশ মহিলা। ২০১৪-এর লোকসভায় নির্বাচনের পরে, অর্থাৎ ষোড়শ লোকসভায় মহিলাদের সংখ্যা ছিল ৬৫ জন। অর্থাৎ ১২ শতাংশ। তার আগের বার অর্থাৎ ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরে, পঞ্চদশ লোকসভায় মহিলা সাংসদের সংখ্যা ছিল ৫৯। তা হলে যদি দেখতে হয়, নিশ্চিন্তে বলাই যেতে পারে, গত তিনটি লোকসভা নির্বাচনে ধারাবাহিক ভাবে ভারতবর্ষের সংসদে মহিলাদের সংখ্যা বাড়ছে।
কিন্তু সেটাই কি যথেষ্ট? মানবীবিদ্যার গবেষক হিসেবে বলতে পারি, এই বিষয়ে ভারতবর্ষ অনেক পিছিয়ে। বিশ্বের ১৯০টি দেশের মধ্যে ভারতবর্ষ রয়েছে ১৫৩তম স্থানে। ‘আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন’-এর তৈরি করা তালিকা অনুযায়ী, জাতিদাঙ্গায় বিধ্বস্ত আফ্রিকার রোয়ান্ডা বিশ্বে সর্বপ্রথম। সে দেশের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে মহিলাদের সংখ্যা ৬১ শতাংশ। ইউরোপের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলিতে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব সেই দেশগুলির পার্লামেন্টে প্রায় ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। তার তুলনায় আমেরিকা এবং ইংল্যান্ড বেশ পিছিয়ে। আমেরিকায় যেখানে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব ৩২ শতাংশ, সেখানে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে মহিলা সদস্য মাত্রই ২৩ শতাংশ। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমেরিকায় গত বারের নির্বাচনে কিন্তু হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ-এ উল্লেখযোগ্য ভাবে মহিলাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতিহাস সৃষ্টি করে প্রথম মুসলিম মহিলা হিসেবে রশিদা তালিব মার্কিন হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ-এ ঢুকে পড়েছেন, তেমনই অভিবাসীদের মধ্যেও অনেক মহিলা ২০১৮-র নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছেন।
যেটা আমাদের ভারতীয় হিসেবে চিন্তায় রাখতে পারে, সেটা হচ্ছে, প্রতিবেশী পাকিস্তান বা বাংলাদেশেও আমাদের পার্লামেন্টের তুলনায় মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব অনেক বেশি। পাকিস্তানে যেটা ২০ শতাংশ, সেটা বাংলাদেশে ২১ শতাংশের উপরে। বাংলাদেশে তো এর আগের বার সংসদে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেত্রী, স্পিকার সবাই মহিলা ছিলেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ অন্তত এই বিষয়টি নিয়ে গর্ব করতেই পারে। তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে যদি ভারতবর্ষের সংসদে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেন, তা হলে দেখা যাবে ২০০৯ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে সংসদে মহিলাদের সংখ্যা বেড়েছে ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ১৪ শতাংশ হয়েছে। এর আগের লোকসভায়, মানে ষোড়শ লোকসভায় পশ্চিমবঙ্গ থেকেও যথেষ্ট মহিলা প্রতিনিধি ছিল লোকসভায়।
কিন্তু তার পরেও ভারতবর্ষের হাল সন্তুষ্ট করার মতো নয়? যেহেতু ভারতবর্ষ বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র বলে নিজে দাবি করে এবং আমরা সত্যি সত্যিই তাই, তাই জনসংখ্যার অর্ধেক আকাশ যাঁরা পূর্ণ করছেন, সেই মহিলাদের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব কিন্তু এখনও ভারতবর্ষের সংসদে দেখা যায়নি। বিজেপি, কংগ্রেস— দেশের দুই প্রধান দল নীতিগত ভাবে সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ বা আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে লোকসভার এক-তৃতীয়াংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত করার জন্য দাবিকে নীতিগত ভাবে মেনে নিলেও আজ অবধি সেই বিল পাশ হয়নি। লোকসভায় সেই বিল পাশ না হওয়ার প্রধান কারণ উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারের দুই শক্তিশালী দল যথাক্রমে সমাজবাদী পার্টি এবং রাষ্ট্রীয় জনতা দলের এই সংরক্ষণের তীব্র বিরোধিতা করা। মূলত তাঁদের তীব্র বাধাতেই লোকসভায় মহিলাদের সংরক্ষণ বিল পাশ হতে পারেনি।
আর একটু যদি পরিসংখ্যান নিয়ে নাড়াচাড়া করি, তা হলে, মহিলাদের প্রতিনিধিত্বের দিক থেকে ভারতবর্ষ কতটা পিছিয়ে আছে তা পরিষ্কার হবে। দেশের ৫৪৩টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে প্রায় অর্ধেক, অর্থাৎ ৪৮.৪ শতাংশ আসনে ১৯৬২ সাল থেকে কোনও মহিলা লোকসভা নির্বাচনে জিততে পারেননি। অর্থাৎ দেশের প্রায় অর্ধেক আসনই গত ৬০ বছরে কোনও মহিলা সাংসদ পায়নি। অথচ ভারতবর্ষের সংসদীয় গণতন্ত্রে মহিলাদের সাফল্যের খতিয়ান কিন্তু যথেষ্ট ভাল। বিভিন্ন সমীক্ষক দল যখনই তৃণমূল স্তরের জনপ্রতিনিধিত্ব বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন, দেখা গিয়েছে গ্রামসভার ক্ষেত্রে, পঞ্চায়েতের ক্ষেত্রে মহিলা নেতৃত্বের ভূমিকা খুবই ভাল। যে কোনও ধরনের আলোচনা, নতুন কোনও নীতি প্রণয়ন বা গ্রামসভা পর্যায় উত্তেজনা নিরসনে মহিলা জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা খুবই ভাল। তা হলে কেন সংসদে বা গণতন্ত্রের বৃহত্তম পীঠস্থানে অর্থাৎ লোকসভায় মহিলাদের সংখ্যা কম থাকবে?
আসলে এটাই বোধহয় পুরুষতন্ত্রের চশমা দিয়ে রাজনীতিকে দেখার বিপদ এবং সেই কারণেই রাজনীতির প্রধান মঞ্চে মহিলাদের উঠে আসার ক্ষেত্রে বাধাও বটে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের কথাই ভাবুন, জয়াপ্রদা থেকে মিমি চক্রবর্তী এক জন মহিলাকে রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হওয়ার জন্য কতটা তীব্র ব্যক্তিগত এবং সামাজিক আক্রমণকে সহ্য করতে হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত দুই সাংসদ, যাঁরা অভিনেত্রীও বটে, সেই মিমি চক্রবর্তী ও নুসরত জাহানকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ট্রোলিং’-এর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। এক সময়ে তারকা ক্রিকেটার, এ বারের নির্বাচিত সাংসদ গৌতম গম্ভীর যদি টি-শার্ট আর জিনস পরে লোকসভায় যান, তা হলে সামাজিক মাধ্যমে তাঁকে আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয় না। কিন্তু একই ধরনের পোশাক পরে মিমি কিংবা নুসরত যদি লোকসভার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন এবং সেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোষ্ট করেন, তা হলে ট্রোলিং-এর ঝড় বয়ে যায়। এটাই পুরুষতন্ত্রের ‘প্রিজম’ দিয়ে নারীকে দেখার চেষ্টা এবং নারীর ক্ষমতায়নকে সব সময় হেয় করে যাওয়া বা ছোট করে দেখানোর চেষ্টা। সেই জন্যই তো সমাজবাদী পার্টির আজম খান জয়াপ্রদাকে নিয়ে ওই রকম কুরুচিকর মন্তব্য করেও পার পেয়ে যান।
আসলে আমরা মহিলা প্রধানমন্ত্রী পেয়েছি, দেশের একাধিক রাজ্যে মহিলা মুখ্যমন্ত্রী পেয়েছি, লোকসভার স্পিকারের আসনেও মীরা কুমার কিংবা সুমিত্রা মহাজনেরা বসেছেন, কিন্তু আসলে মহিলাদের ক্ষমতায়ন হয়নি। হয়নি বলেই কোনও রাজনীতিক অনায়াসে বলতে পারেন, একদা নায়িকা, আজকের সাংসদ হেমা মালিনীর গালের মতো মসৃণ রাস্তা বানিয়ে দেবেন। ভেবেও দেখেন না, এই মন্তব্য এক জন মহিলার কাছে কি আদৌ কোনও সম্মানের বার্তা বহন করে নিয়ে যায়? বিখ্যাত ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ নেভিল কার্ডাস যদিও বলেছিলেন, স্কোরবোর্ড একটা গাধা, কিন্তু অনেক সময় তো স্কোরবোর্ড আপনাকে বাস্তবের একটা হদিশ দেয়। সেই জন্যই ধারাবাহিক ভাবে কী ভাবে ভারতবর্ষের সংসদে মহিলাদের প্রতিনিধিত্বের হার নির্ধারিত হয়েছে, তা বিচার করলে বোঝা যাবে কেন এখনও আমাদের অনেকটা দূর যাওয়া বাকি।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy