Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

আসানসোলের সাহিত্যচর্চার অন্যতম কেন্দ্রে ছিলেন তিনি

সমরেশ দাশগুপ্ত। আসানসোলের সাহিত্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত কমবেশি অনেকেই এই সদাহাস্যময় নিপাট ভাল মানুষটির কথা শুনেছেন। কোনও কিছুতেই তাঁর কোনও বিরক্তি ছিল না। অফিসে সাহিত্যের সঙ্গে জড়িতদের ভিড় লেগেই থাকত। লিখছেন দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়এক কথায় তিনি ছিলেন লিটিল ম্যাগাজিন অন্তপ্রাণ এক জন মানুষ।

রেখাচিত্রে সমরেশ দাশগুপ্ত। ছবি: লেখক

রেখাচিত্রে সমরেশ দাশগুপ্ত। ছবি: লেখক

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০১:১০
Share: Save:

তাঁর অনুরাগীদের চোখে তিনি ছিলেন এমন এক জন মানুষ, যিনি নিজের লেখালিখির বাইরে অনেকের উৎসাহদাতা। তাঁর অফিসটি ছিল যেন আসানসোলের কফিহাউস। সে অফিসে পাঁচ থেকে পঞ্চান্ন— সবারই ছিল অবাধ প্রবেশ। এক জন চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলে কয়েক মিনিটের মধ্যে আবার এক জন এসে দখল করতেন ফাঁকা চেয়ার। জীবনবিমা করাতে নয়, অধিকাংশ মানুষই আসতেন বুক ভরা তাজা অক্সিজেন নিতে। কত কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকারের সঙ্গে সে অফিসে দেখা হয়েছে, আলাপ হয়েছে আর কত লিটিল ম্যাগাজিনের আঁতুড়ঘর ছিল সে অফিস তা বলে শেষ করা যায় না। তিনি সমরেশ দাশগুপ্ত। তাঁর বিমা অফিসের টেবিলে বসে কত সাহিত্য পত্রিকার বিষয়ে চিন্তা, ভাবনা, পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তার গুণতি কোনও দিন করা হয়নি। কেউ নতুন পত্রিকা প্রকাশের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে শুনলেই তিনি শিশুর মতো আনন্দে লাফিয়ে উঠতেন। এক কথায় তিনি ছিলেন লিটিল ম্যাগাজিন অন্তপ্রাণ এক জন মানুষ।

সমরেশ দাশগুপ্ত। আসানসোলের সাহিত্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত কমবেশি অনেকেই এই সদাহাস্যময় নিপাট ভাল মানুষটির কথা শুনেছেন। কোনও কিছুতেই সমরেশবাবুর কোনও বিরক্তি ছিল না। কেউ তাঁর কাছে নিজের লেখা গল্প, কবিতা বা অন্য কোনও রচনা নিয়ে গেলে উৎসাহে সেগুলি দেখতেন। কখনও বা অভিভাকের মতো তিনি সেগুলিতে কোনও ত্রুটি থাকলে তা সংশোধন করে দিতেন। কখনও কোনও লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদককে তিনি বলতেন, ‘‘যত ছোট পত্রিকাই হোক তুমি তো সম্পাদক। তোমার দায়বদ্ধতা রয়েছে। আরও যত্নশীল হতে হবে। আর পত্রিকা সম্পাদনা করতে গিয়ে তোমার নিজের লেখালেখির যেন ক্ষতি না হয় সেটা মনে রেখে কাজ কর।’’

কখনও তিনি তরুণ গল্পকারকে চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমি তো পর পর চিঠি দিয়েই যাচ্ছি। কোনও উত্তর না পেয়ে চিন্তার মধ্যে রয়েছি। একেবারে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে কেন? তোমার এবং বাড়ির সকলের সঙ্গে কুশল সংবাদ দিয়ে নিশ্চিন্ত কর। তোমার বা তোমাদের সঙ্গে আত্মীয়তা আজকের নয়— মনে হয় এ যেন জন্ম জন্মান্তরের।’ সবশেষে তিনি জানতে চাইতেন, ‘নতুন কিছু লিখলে? টাটকা নিয়ে এস এক দিন।’

শুধু বাংলা নয়, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু— যে কোনও ভাষার গল্প এবং গল্পকারদের প্রতি তাঁর ছিল অসীম টান। তিনি ছিলেন মূলত ছোট গল্পকার। কিন্তু কবিতা, উপন্যাস এবং প্রবন্ধও লিখেছেন। আবার অন্য ভাষা থেকে নাটকের অনুবাদও করেছেন। অনেক ছোটগল্পের নাট্যরূপও দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর আসল পরিচিতি গল্পে। ‘শনিবারের চিঠি’, ‘পূর্বাশা’, ‘শুকসারী’, ‘কথাসাহিত্য’, ‘সীমান্ত’-সহ কলকাতার বহু পত্রপত্রিকার রবিবাসরীয় কলমে তাঁর লেখা গল্প প্রকাশিত হয়েছে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ গল্প সঙ্কলন’-এ তাঁর ‘রতনের ঘর’ গল্পটি স্থান পায়। ‘সাজঘরের বাইরে’ প্রকাশিত হয় শনিবারের চিঠিতে। নবনীতা দেবসেনের পিতা নরেন দেবের ‘পাঠশালা’ পত্রিকায় প্রচুর গল্প লিখেছেন সমরেশবাবু। মিহির আচার্যের ‘শুকসারী’ ও পরে ‘লেখক সমাবেশ’-এর নিয়মিত লেখক ছিলেন তিনি। বিমল কর, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সমরেশ বসু, মিহির আচার্য –সহ আরও অনেক প্রখ্যাত লেখকরা সমরেশ দাশগুপ্তের ছোটগল্পের প্রশংসা করেছিলেন।

এহেন সমরেশ দাশগুপ্ত আসলে ছিলেন লিটিল ম্যগাজিনের লেখক। যত ছোট লিটিল ম্যাগাজিনই হোক না কেন তার অধিকাংশয়ই তাঁর লেখা পাওয়া যায়। এমন অনেক পত্রিকা রয়েছে যেটির একটি মাত্র সংখ্যাই হয়তো প্রকাশিত হয়েছিল। মাত্র পাঁচ থেকে ছ’টি রচনা নিয়ে। সেখানেও সমরেশবাবুর লেখা পাওয়া যায়। তৎকালীন বর্ধমান, বীরভূম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার বহু লিটিল ম্যগাজিনেই তিনি লিখতেন। অনেক সময়েই দেখা গিয়েছে তাঁর অফিসের দরকারি কাগজপত্র চাপা পড়ে গিয়েছে লিটিল ম্যাগাজিনের স্তূপের তলায়। কোনও সাহিত্য পত্রিকার বিষয়সূচি সাজানো থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন কী ভাবে রাখলে দৃষ্টিনন্দন হবে— সব বিষয়েই তিনি সম্পাদকদের পরামর্শ দিতেন। তাঁর কাছে বহু সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকই যেতেন পরামর্শ নিতে। নতুন লেখকদের কাছে কারও লেখা ভাল লাগলেই তিনি নিজের কাছে রেখে দিতেন। পরে সময়মতো কোনও লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদকের হাতে সেটি তুলে দিতেন। লেখক ও সম্পাদকদের মধ্যে যোগাযোগের সেতু হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।

বিকাশ গায়েন, বাসুদেব মণ্ডল, অরবিন্দ দাশগুপ্ত, পার্থপ্রতিম আচার্যের মতো সেই সময়ের লেখক ও সম্পাদকেরা অনেকেই আসতেন তাঁর কাছে। জয়া মিত্র, উদয়ন ঘোষ, অসিত বিশ্বাস, নন্দদুলাল আচার্য, নীতিশ চৌধুরীর মতো অনেকেই সাহিত্য আলোচনা করতে যেতেন সমরেশ দাশগুপ্তের অফিসে। চা, চপ, সিঙারা, রসগোল্লা— যখন যা পাওয়া যেত তা দিয়েই চলত সাহিত্য আলোচনা।

লিটিল ম্যাগাজিনের লেখক বলেই হয়ত সমরেশ দাশগুপ্ত লিখতে পেরেছিলেন ‘খড়কুটোর সে দিন’-এর মতো গল্প। এই গল্পকে গল্প না বলে বরং বলা চলে লিটিল ম্যাগাজিনের জন্ম ও মৃত্যুর এক অসাধারণ তথ্যচিত্র। একটি পত্রিকা কী ভাবে মফস্সলের কয়েক জন তরুণের আশা, আকাঙ্ক্ষা ও ভালবাসার প্রতীক হয়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত পত্রিকার মৃত্যু কী ভাবে সেই তরুণদের স্বপ্নভঙ্গের দ্যোতক হয়ে ওঠে তার এক অসামান্য উদাহরণ এই গল্প। দেশভাগের যন্ত্রণার কথা ফুটে উঠেছিল তাঁর ‘জন্মভূমি’ গল্পে। এই ঘল্পগুলির বাইরেও ‘সাজ ঘরের বাইরের ট্রেন’, ‘মানুষের বাচ্চা’, ‘গ্যালিলিও’, ‘অটোমেশন ও অসুখের অন্ধকার’, ‘রতনের ঘর’ প্রভৃতি গল্পের লিখনশৈলী ও বুনন আজও পাঠকের কাছে আবেদন রাখে।

তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘পেপার কলোনি’, উপন্যাস ‘দ্রাক্ষাদহ’ সেকালে বহু প্রশংসা অর্জন করেছিল। শেষ জীবনে তিনি গল্প অ্যাকাডেমি তৈরি ও তার প্রসারের দিকেই মনোনিবেশ করেছিলেন।

১৯৩৩ সালের ১ জুন বাংলাদেশের কুমিল্লায় সমরেশ দাশগুপ্ত জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর প্রথম গল্প ‘তাবিজ’ প্রকাশিত হয়েছিল ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকার। দেশভাগের পরে এ পার বাংলায় চলে আসেন। ১৯৫০ সালে ভর্তি হন বর্ধমান রাজ কলেজে। বর্ধমানে নরেন দেব ও তাঁর ‘পাঠশালা’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে যে সাহিত্যচর্চা শুরু হয়েছিল তার অন্যতম শরিক ছিলেন তিনি। ১৯৫২ সাল থেকে তিনি আমৃত্যু আসানসোল নিবাসী ছিলেন। এখানে প্রথমে পেলেন ‘রূপমঞ্জরী’ ও ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকা দু’টি। ক্রমে ক্রমে অনেক পত্র, পত্রিকা

আর অসংখ্য কবি, লেখকের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও আত্মীয়তা। ২০০০ সালের পয়লা জানুয়ারি আমাদের ছেড়ে চলে যান মানুষটি।

ইসিএল-এর কর্মী

অন্য বিষয়গুলি:

Samaresh Gupta Books Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy