Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Ramakrishna

সর্বধর্ম সমন্বয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ

সময়টা উনিশ শতকের মাঝামাঝি। কলকাতাকে কেন্দ্র করে তখন এক বিশাল সংস্কার যজ্ঞ চলছে। সমাজ থেকে ধর্ম—প্রায় সর্বক্ষেত্রেই সচেতন ও শিক্ষিত নাগরিকবৃন্দের চোখ পড়েছে এবং তাঁরা এক উন্নততর সমাজ গড়ে তোলার বিষয়ে প্রত্যয়ী হয়েছেন। লিখছেন সৌমেন রক্ষিত কলকাতার সিঁদুরিয়াপটির শম্ভুচরণ মল্লিকের কাছে তিনি বাইবেলের কথা শুনতেন। পানিহাটি মহোৎসব বা বিভিন্ন বৈষ্ণবীয় উৎসবেও তাঁর যাতায়াত ছিল।

শ্রীরামকৃষ্ণ। ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকার আর্কাইভ থেকে

শ্রীরামকৃষ্ণ। ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকার আর্কাইভ থেকে

শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৪:১১
Share: Save:

দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় হাত ধরে কলকাতায় এসেছিলেন গদাধর। দাদার সূত্রেই দক্ষিণেশ্বরে পৌরোহিত্যের কাজে তাঁর যুক্ত হওয়া। ক্রমে হয়ে ওঠা শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।

সময়টা উনিশ শতকের মাঝামাঝি। কলকাতাকে কেন্দ্র করে তখন এক বিশাল সংস্কার যজ্ঞ চলছে। সমাজ থেকে ধর্ম—প্রায় সর্বক্ষেত্রেই সচেতন ও শিক্ষিত নাগরিকবৃন্দের চোখ পড়েছে এবং তাঁরা এক উন্নততর সমাজ গড়ে তোলার বিষয়ে প্রত্যয়ী হয়েছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শিবনাথ শাস্ত্রী, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী প্রমুখ তখন শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। কলকাতায় তখন এক দিকে ব্রাহ্মদের একেশ্বরবাদ, অন্য দিকে, হিন্দুদের বহুদেববাদ। একই সঙ্গে রয়েছে তন্ত্রসাধনা, বৈষ্ণবীয় ভাব, ইসলাম ধর্মের প্রসার এবং খ্রিস্ট ধর্মের বহুল প্রচার।

এই রকম একটি পরিবেশ ও সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কলকাতায় আগমন। তাঁর কর্মধারা ও জীবনযাপনকে অনেকেই গ্রাম্য ব্যক্তির পাগলামি ধরে নিলেও শ্রীরামকৃষ্ণ শুধুমাত্র রাসমণি দেবী প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দিরের উপাসক হয়েই থাকলেন না। তিনি নিজের জীবন দিয়ে অন্য ধর্মগুলিকেও বোঝার চেষ্টা করলেন। জীবনের প্রথম পর্যায়ে ভৈরবী যোগেশ্বরীকে গুরু করেন। চলে তন্ত্রসাধনা। ভৈরবী ব্রাহ্মণীর নির্দেশে শাস্ত্র অনুসারে গোকুলব্রত ও চৌষট্টি প্রকার তন্ত্রসাধনা করেন। এরপর জটাধারী নামে এক রামায়েত সাধুর কাছে রামমন্ত্র গ্রহণ করেন। এমনকি, ছ’মাস স্ত্রীবেশ ও স্ত্রীভাব ধারণ করেছিলেন কেবল ব্রজের গোপীদের ন্যায় মধুর ভাবে সাধনা করার জন্য। আচার্য তোতাপুরীর কাছে অদ্বৈত বেদান্তের নিয়ম মেনে নির্বিকল্প সমাধির সাধনায় রত হন। পরবর্তীকালে সুফি সাধক গোবিন্দ রায়ের কাছে ইসলাম ধর্মে উপদেশ গ্রহণ করেন। খ্রিস্ট ধর্ম সম্পর্কেও তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। কলকাতার সিঁদুরিয়াপটির শম্ভুচরণ মল্লিকের কাছে তিনি বাইবেলের কথা শুনতেন। পানিহাটি মহোৎসব বা বিভিন্ন বৈষ্ণবীয় উৎসবেও তাঁর যাতায়াত ছিল।

ফলে প্রথম জীবনে শ্রীরামকৃষ্ণের এই সাধনা তাঁকে প্রায় সকল প্রধান ও বহুল প্রচলিত ধর্মীয় পন্থার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিল। আর তার পরিণতিতেই শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অন্যতম প্রধান বক্তব্য, ‘যত মত, তত পথ’। নিজের জীবনকে বিভিন্ন ধারার ধর্মপথে অতিক্রান্ত করে তবেই এই সিদ্ধান্তে তিনি এসেছিলেন। অবশ্য এই কথা বৈদিক ঋষিদের ‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি’ অর্থাৎ সত্য একটাই, ঋষিরা তাকে বহু নামে বলে থাকেন—এই ভাবনা বহু প্রাচীনকালেই প্রচলিত ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণদেব সেই প্রাচীন সত্যকে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পুনরায় সমাজে প্রতিষ্ঠা করলেন। তাঁর বক্তব্য, “আমি যার যা ভাব তার সেই ভাব রক্ষা করি। বৈষ্ণবকে বৈষ্ণবের ভাবটি রাখ্‌তে বলি, শাক্তকে শাক্তের ভাব। ...আমি সব ভাবই কিছু কিছু করেছি—সব পথই মানি।” বলা চলে, শ্রীরামকৃষ্ণদেবের এই ভাবের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা।

ধর্ম অর্থে বিভিন্ন ধর্মীয় পথগুলিকে নির্দেশ করা হলেও শ্রীরামকৃষ্ণ দৃষ্টিতে সে সকল পথ অধ্যাত্মচেতনাকে সুনিশ্চিত করে। তাঁর মতে, পথ আলাদা হতে পারে, মতের বিভিন্নতাও থাকবে, কিন্তু প্রধান ইঙ্গিত ছিল অধ্যাত্ম ভাবনা ও পরিবেশে জীবন যাপন। শ্রীরামকৃষ্ণদেব ঠিক এই উদ্দেশ্যেই বলতেন, ‘সংসারে থাকতে গেলে থাকতে হয় পাঁকাল মাছের মতন—সংসারের পাঁকে থাকবে, কিন্তু সংসারের পাঁক গায়ে লাগবে না।’ এইরূপ ছোট ছোট কাহিনি ও ঘটনা নিয়ে দক্ষিণেশ্বরের বাড়িতে কিংবা ভক্তবাড়িতে তিনি হাজির হতেন সমন্বয়ের ভাবনা নিয়ে। বলতেন, ‘এক মায়ের পাঁচ ছেলে ও মায়ের পাঁচ রকম মাছ রান্না করার গল্প। যার যেটি সয়, তাকে সেটিই করে দেন মা।’ আসলে যার যা প্রকৃতি তাকে সেই ভাব নিয়েই থাকা উচিত— সেটাই বলতে চেয়েছিলেন তিনি। শ্রীরামকৃষ্ণের এই ভাবনার জন্যই ব্রাহ্মনেতা প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, বর্ধমান রাজার সভাপণ্ডিত পদ্মলোচন, জয়পুরের পণ্ডিত নারায়ণ শাস্ত্রী, প্রখ্যাত ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার প্রমুখ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি ও পণ্ডিত সহজেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে অর্থে শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসেননি। কিন্তু তিনিও শ্রীরামকৃষ্ণের এই ভাবের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকায় লিখেছিলেন ‘To The Paramhansa Ramkrishna Deva’ নামক একটি কবিতা। সেটিই ‘প্রবাসী’তে বাংলায় লেখেন—“বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা/ ধেয়ানে তোমার মিলিত হয়েছে তারা।/ তোমার জীবনে অসীমের লীলাপথে/ নূতন তীর্থ রূপ নিল এ জগতে;/ দেশ বিদেশের প্রণাম আনিল টানি/ সেথায় আমার প্রণতি দিলাম আনি।” ছয় পঙ্‌ক্তির এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণের সমন্বয়ী আদর্শকেই চিত্রিত করেছেন। এমনকি, জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন, “ধর্মীয় ধ্বংসাত্মক এমন ঊষর একটি যুগেও তিনি আমাদের আধ্যাত্মিক সম্পদের সারসত্য উপলব্ধি করেছেন, বহু সাধনার আপাত পরস্পরবিরোধী দ্বন্দ্বমুখর ধারাগুলি মিলিত হয়েছে তাঁর হৃদয়ের প্রশস্ততায়, তাঁর আত্মার সারল্য চিরকাল ধিক্কার জানায় পণ্ডিত আর ধর্মবেত্তাদের সমস্ত আড়ম্বর আর আত্মম্ভরিতাকে।” অন্য দিকে, শিবরাম চক্রবর্তী তাঁর ‘দেশের মধ্যে নিরুদ্দেশ’ গল্পে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের এই সমন্বয়ী ভাবনাকেই অস্বীকারে যেন স্বীকার করে নিয়েছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণদেবের এই ভাব প্রচারের প্রায় দেড় শতক অতিক্রান্ত। বর্তমানে তাঁর এই ভাবনা নতুন করে জানা ও বোঝার সময় এসেছে। ধর্মীয় জগতের পুরোধা হিসেবে তাঁকে সরিয়ে রেখে তাঁর এই অমূল্য মতবাদকে গুরুত্ব না দিলে সময় এক দিন তার পরিণাম দেখাবে। আসলে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের এই ভাবনায় নিহিত আছে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও উদার মানসিকতা। বর্তমান সমাজে যার অভাব অনেক বেশি সেই শ্রদ্ধা ও ভালবাসা এবং উদারচেতনাই পারে সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রগতির পথে চালনা করতে। ফলে আড়ম্বর বা আত্মম্ভরিতাকে বিসর্জন দিয়ে প্রত্যেকের জীবনকে অধ্যাত্ম আবহে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াতেই ধর্মের প্রবাহ। শ্রীরামকৃষ্ণ তাই নতুন কোনও ধর্মের বা অনুশাসনের প্রবর্তন করেননি, কেবল নিজের জীবনের প্রত্যেক মুহূর্তকে ভরে রেখেছিলেন একটি সুন্দরতম অধ্যাত্ম ভাবনায়। ‘ধর্ম’ বুঝতে চাইলে এই অর্থেই বোঝা উচিত। সংসারী ও সন্ন্যাসী শিষ্যদের তিনি আলাদা আলাদা করে এই অধ্যাত্মচেতনার কথাই বলে এসেছেন বিভিন্ন সময়ে। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের এই ভাব সঠিক অর্থে জীবনে গ্রহণ করলেই সমাজের উন্নতি।

লেখক সহশিক্ষক, সিমলাপাল মদনমোহন উচ্চ বিদ্যালয়, বাঁকুড়া

অন্য বিষয়গুলি:

Ramakrishna Religion
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy