রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কত আর বয়স তখন। তিরিশের কোঠায়। বছর আটেক হল বিয়ে হয়েছে। গায়ক এবং কবি হিসেবে খ্যাতি ছড়িয়েছে। পিতৃদেব জমিদারির দেখভালের জন্য গুরুদায়িত্বও চাপিয়েছেন। প্রায় তিন মাস প্রবাসে কাটিয়ে ফিরেছেন দেশে। দেশে ফিরেই চললেন জমিদারি পর্যবেক্ষণ করতে কালিগ্রামে। সেখান থেকে নদীপথে পৌঁছলেন শাহজাদপুর। এ দিকে কলকাতায় তখন তাঁর দ্বিতীয় কন্যা ভূমিষ্ঠ হল। নিজেও কাঁধে বাতের বেদনায় ভয়ানক কষ্ট পাচ্ছেন। এর মধ্যেই তাঁর প্রিয় ‘পদ্মা’ বোট কাছারি পেরিয়ে অনেক দূরে একটা নিরিবিলিতে বাঁধা। প্রকৃতি এখানে অপার। একলা বসে বসে এই নৈঃশব্দ, অপার শান্তি আর সৌন্দর্য দেখেই দিন কেটে যায়। জমিদারির কাজ আর কাব্যচর্চার মাঝে ফাঁক পেলে তিনি কাগজ-কলম নিয়েও বসে যান চিঠি লিখতে। কখনও লেখেন তাঁর স্নেহের ‘বব’কে। কখনও বা আবার তাঁর আদরের ‘ছুটি’কে।
সেদিন সকাল সকাল তিনি লিখতে বসেছেন। হঠাৎই তাঁর কাছে এসে হাজির এক জন। তিনি নাকি শাহজাদপুরের এক নামকরা গণৎকার। সেই গণৎকার এসে তাঁর মূল্যবান সকালটিকে ভারী এলোমেলো করে দিলেন। এ-কথা সে-কথার মাঝে গণৎকার তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁর জন্মের রাশি এবং লগ্ন কী। এ সব শোনার পরে গণৎকার গুণতে শুরু করে দিলেন। বললেনও অনেক কথা। কী বলেছিলেন? সে কথা শোনা যাক ‘ভাই ছুটি’কে লেখা একটি চিঠির কিয়দংশে—“...আমি সুবেশী, সুরূপ, রংটা শাদায় মেশানো শ্যামবর্ণ, খুব ফুটফুটে গৌরবর্ণ নয়।”
আরও বলেছিলেন সেই গণৎকার—“...তার পরে বল্লে আমার সঞ্চয়ী বুদ্ধি আছে কিন্তু আমি সঞ্চয় করতে পারব না — খরচ অজস্র করব কিন্তু কৃপণতার অপবাদ হবে — মেজাজটা কিছু রাগী।”
পত্রলেখকের ধারণা, তাঁর তখনকার বিরক্তিকর মুখখানা দেখেই বোধহয় গণৎকার তাঁকে রাগী বলতে বাধ্য হয়েছিলেন। এর পরে যে কথাটি বলেছিলেন সেই গণৎকার, সেটি খুবই কৌতুকের— “ষাট বাষট্টি বৎসরের বেশি বাঁচব না। যদিবা কোন্ মতে সে বয়স কাটাতে পারি তবু সত্তর কিছুতেই পেরতে পারব না।”
এর পরের ইতিহাস সকলের জানা। গণৎকারকে মিথ্যে প্রমাণ করে পত্রলেখক দীর্ঘ আশি বছর বেঁচে ছিলেন। হ্যাঁ এই কাহিনি ১৮৯১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের জীবনের ঘটনা। দীর্ঘ জীবনে প্রিয়জনদের মৃত্যু বারবার তাঁকে শোকাহত করলেও মৃত্যুঞ্জয়ী রবীন্দ্রনাথ নিজে মৃত্যুর করাল কবল থেকে একাধিক বার বেঁচে ফিরে এসেছিলেন।
১৮৯২ সালের কথা। সেবারও জমিদারির কাজে শিলাইদহে আছেন কবি। জুলাই মাস। ভরা বর্ষার কাল। কবি পদ্মা বোটে সেদিন গোরাই নদীবক্ষে। নদীবক্ষেই থাকতে বেশি পছন্দ করতেন। বর্ষার জলে গোরাই সেদিন জলে পরিপূর্ণ একেবারে। তিনি সেই ভরা নদীর সৌন্দর্যে মোহিত। পাল তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে পান্টি থেকে শিলাইদহ যাচ্ছেন। হু হু করে বোট দুলে দুলে চলেছে। কবি কখনও লেখাপড়া করছেন, কখনও বা বাইরের ভিজে অঝোর শ্রাবণকে দেখছেন। বেলা তখন সাড়ে দশটা হবে। হঠাৎই বিপদ ঘনিয়ে এল। চলতে চলতেই গোরাই নদীর ব্রিজ দেখা গেল। বোটের মাস্তুল ব্রিজে বাধবে কি না, তাই নিয়ে মাঝিরা নিজেদের মধ্যে তর্ক শুরু করে দিল। তর্কের মধ্যেই তাদের খেয়াল নেই যে ব্রিজ একেবারে ঘাড়ের কাছে এসে গেছে। মাঝিরা ভেবেছিল স্রোতের বিপরীতে বোট চলছে যেহেতু, তাই দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। ব্রিজের কাছাকাছি এলেও যদি দেখে যে মাস্তুল ব্রিজে লেগে যাচ্ছে, তখন পাল নামিয়ে নিলে বোট আবার স্রোতের বিপরীতে ব্রিজ থেকে পিছিয়ে যাবে। কিন্তু তা হল না। আসলে বিপদ তো বলে কয়ে আসে না। দৈবাৎই হাজির হয়। হলও তাই। দেখা গেল ব্রিজে মাস্তুল বেধে যাচ্ছে এবং সেখানে জলের একটা ঘূর্ণিও আছে। ব্যস...
“দেখতে দেখতে বোটটা ব্রিজের উপর গিয়ে পড়ল। মাস্তুল মড়্ মড়্ করে ক্রমেই কাত হতে লাগল...’’ কবি লিখছেন, “আমি হতবুদ্ধি মাঝিদের ক্রমাগত বলছি, ‘তোরা ওখান থেকে সর্। মাস্তুল ভেঙে তোদের মাথায় পড়বে।’ — এমন সময়ে আর একটা নৌকো তাড়াতাড়ি দাঁড় বেয়ে এসে আমাকে তুলে নিলে।... যদি সময় মত নৌকো না আসত আর বেশিক্ষণ টিঁকত না।”
সত্যি সত্যি সেদিন সকলে ডাঙায় এসে বলেছিল “আল্লা বাঁচিয়ে দিয়েছেন, নইলে বাঁচবার কোনো কথা ছিল না।”
পরে বোটে বসেই স্ত্রী মৃণালিনীদেবীকে এই ঘটনার কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ— “আজ আর একটু হলেই আমার দফা নিকেশ হয়েছিল। তরীর সঙ্গে দেহতরী আর একটু হলেই ডুবেছিল।....ব্রিজের নিচে জলের তোড় খুব ভয়ানক — জানিনে, আমি সাঁৎরে উঠতে পারতুম কি না...।” পরদিন স্নেহের বিবিকে লিখেছিলেন, “কাল যমরাজের সঙ্গে এক রকম হাউ-ড্যু-ড্যু করে আসা গিয়েছে। মৃত্যু যে ঠিক আমাদের নেকসট ডোর নেবার এ রকম ঘটনা না হলে সহজে মনে হয় না।” মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেও কবির রসবোধে এতটুকু খামতি পড়েনি!
এ ঘটনা ঘটে যাওয়ার বেশ কয়েক বছর পরে কবির জীবনে শিহরণ জাগানো আর একটি ঘটনার কথা জানা যায়। ১৯০৯ সাল। কবির ছোট মেয়ে মীরা তখন অসুস্থ। কবির ইচ্ছে ওঁকে হাওয়াবদলের জন্য কোনও পাহাড়ি জনপদে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু কিছুতেই তা হয়ে উঠছে না। এর মধ্যে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অজিতকুমার চক্রবর্তীকে চিঠিতে জানালেনও সেকথা— “মীরা সেরেছে কিন্তু আমি সেই মুখের বাঁ দিকের neuralgia তে বড় কাবু হয়ে পড়েছি। এবার কিছু বেশি বাড়াবাড়ি।...আমার শরীরটাকে নিয়ে সন্দেহ আছে।”
তবু সামান্য সুস্থবোধ করতেই কালকা অভিমুখে ট্রেনে চেপে বসলেন। কিন্তু পথে কষ্ট বেড়ে যাওয়ায় ইলাহাবাদ স্টেশনে নেমে বন্ধু নগেন্দ্রনাথ গুপ্তের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সে যাত্রায় সেই ব্যথা আর তেমন কষ্ট না দিলেও বছর পাঁচ পরে আবার তা মাথা চাড়া দেয়।
১৯১৪ সাল। গ্রীষ্মাবকাশে দু’বছর আগে নৈনিতালের রামগড় পাহাড়ে রথীন্দ্রনাথের কেনা ‘স্নো-ভিউ গার্ডেনস’-এ হাওয়াবদল করতে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে গিয়েই বাড়িটির নতুন নামকরণ করলেন, ‘হৈমন্তী’। সেবার কবির সঙ্গে অনেকেই গেছেন। গান লিখছেন, গান বাঁধছেন, গানের আসর বসিয়ে গান করছেন। একেবারে চুটিয়ে আনন্দ করছেন। কিন্তু এরই মধ্যে অ্যান্ড্রুজকে একটি চিঠিতে লিখলেন নিজের মানসিক অস্থিরতার কথা।
“I am struggling on my way through the wilderness...My feet are bleeding, and I am toiling with painting breath. Wearied, I lie down upon the dust and cry and call upon His name.”
কী হল কবির? তিনি তো এমন কথা চট করে লেখেন না! অথচ নিজেকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য ‘চরণ ধরিতে দিও গো আমারে’ বা ‘এরে ভিখারি সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি করিলে’ জাতীয় গানও রচনা করে চলেছেন। শেষে জুন মাসে কলকাতায় ফিরে এলেন। সেপ্টেম্বর মাসে রথীন্দ্রনাথকে জানালেন, “রামগড়ে যখন ছিলুম তখন থেকে আমার conscience-এ কেবলি ভয়ঙ্কর আঘাত করচে যে বিদ্যালয়ে জমিদারী সংসার দেশ প্রভৃতি সম্বন্ধে আমার যা কর্ত্তব্য আমি কিছুই করিনি— আমার উচিত ছিল নিঃসংকোচে আমার সমস্ত ত্যাগ করে একেবারে রিক্ত হয়ে যাওয়া।”
সঙ্গে একটি মারাত্মক কথাও লিখলেন, “...এবং কেবলি মনে হচ্ছিল যখন এ জীবনে আমার idea কে realise করতে পারলুম না তখন মরতে হবে।”
আসলে কবির বাঁ দিকের কানের সেই পূর্বের রোগটি ফের দানা বেঁধেছিল এবং তার জন্য যে সমস্ত ওষুধ খেয়েছেন, বিশেষ করে ইউনানি ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া চরম হতে হতে এই মানসিক বিপর্যয় হয়েছিল। কবি নিজেই বলেছেন, “দিনরাত মরবার কথা এবং মরবার ইচ্ছা আমাকে তাড়না করেছে। মনে হয়েছে আমার দ্বারা কিছুই হয়নি এবং হবে না।... ”
ভেবে দেখার বিষয় যে তিনি কিন্তু ইতিমধ্যেই নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেছেন। নাম, যশ, খ্যাতির ছড়াছড়ি বিশ্বময়। অথচ বলছেন, “আমি deliberately suicide করতেই বসেছিলুম — জীবনে আমার লেশমাত্র তৃপ্তি ছিল না।”
ভাগ্যিস কোনও অঘটন ঘটেনি। তাই রক্ষে। কারণ অমিতপ্রতিভাধর কবি নিজেই এর সমাধানের পথ খুঁজে পেয়ে পুত্রকে অভয় দিয়ে বললেন, “তোদের ভয় নেই...এর ওষুধ আমার অন্তরেই আছে।”
তথ্য সহায়তা:
চিঠিপত্র ১; ২
ছিন্নপত্রাবলী
রবিজীবনী ২য়, ৩য়, ৭ম খণ্ড: প্রশান্তকুমার পাল
ররীন্দ্রজীবনী ১ম ও ২ খণ্ড: প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
রবীন্দ্রজীবনপ্রবাহ-কালানুক্রমিক বর্ষপঞ্জি: গৌরচন্দ্র সাহা
শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ: শচীন্দ্রনাথ অধিকারী
লেখক রবীন্দ্র-গবেষক ও সাহিত্যকর্মী, মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy