বৃহত্তর আদর্শে ব্রতী বালকদের দল গড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
১৩৩৬ বঙ্গাব্দ। সতীশচন্দ্র রায় আর ধীরানন্দ রায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হল বিশ্বভারতী ব্রতীবালকদের মাসিক মুখপত্র। ‘ব্রতী-বালক’ নামের সেই পত্রের প্রচ্ছদটি বেশ চোখ টানে। এক কিশোর, পিঠে তার ব্যাগ আর হাতে জয়ধ্বজা। জয়ধ্বজা সে স্থাপন করেছে ঊষর পাহাড়িয়া-ক্ষেত্রে। ছবিটা একঝলক দেখেই বিলিতি স্কাউটদের কথা মনে পড়বে। ১৯০৭-এ ইংল্যন্ডে স্কাউট-মুভমেন্টের সূত্রপাত। তা বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। ইংল্যন্ডের উপনিবেশ ভারতবর্ষেও এই ভাবনার ঢেউ এসে লাগল কয়েক বছরের মধ্যেই।১৯০৯-এ বাঙ্গালোরের বিশপ কটন বয়ে’জ স্কুলে এদেশে স্কাউটিং-এর সূচনা। ১৯১৬ সালে কলকাতার ডেপুটি পুলিশ কমিশনার জে এস উইলসন পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে ‘স্কাউটিং ফর বয়েজ’ বইটিকে পাঠ্যতালিকাভুক্ত করেন। মদনমোহন মালব্য, অ্যানি বেশান্ত, দু’জনেই ছিলেন স্কাউটিং-এর পক্ষপাতী।
রবীন্দ্রনাথের ব্রতী-বালক কিন্তু নিছক স্কাউটিং নয়,তার আদর্শ অনেক বড়। এদেশে কেরানি-নির্মাণকারী যে শিক্ষাব্যবস্থা উপনিবেশের সাহেবরা তৈরি করেছিলেন, ব্রতী-বালকদের আদর্শ সেই শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘ভাণ্ডারঘর যেমন করিয়া আহার্য্যদ্রব্য সঞ্চয় করে আমরা তেমনি করিয়াই শিক্ষা সঞ্চয় করিতেছি, দেহ যেমন করিয়া আহার্য্য গ্রহণ করে তেমন করিয়া নহে।’ তুলনাটি মোক্ষম। ভাণ্ডার ঘরে খাবার জমে, তা মানুষের কাজে লাগে না। দেহের প্রতিটি অংশ কিন্তু খাবারের দ্বারা পরিপুষ্ট – হাত-পা-মাথা ঠিকমতো চলে তারই ফলে। সাহেবি শিক্ষা মূলত শহরে একদল উঁচু-নিচু কেরানি তৈরি করে মাত্র। দেশের অধিকাংশ মানুষ যে গ্রামগুলিতে বসবাস করেন, সেই গ্রামে শিক্ষার আলো যায় না, আর্থিক সামর্থ তলানিতে। স্বদেশ অন্ধকারে ডুবছে, ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ মারা যাচ্ছেন। আর শহরের কিছু লোক নানারকম মাপের কেরানি হয়ে সাহেবদের পদে সোহাগ মদে দোদুল কলেবর। এই অবস্থাগত অসামঞ্জস্য দূর করার জন্যই ব্রতীদল গড়ে তোলা। ছেলেরা গ্রামে গ্রামে যাবে – সেখানে শিক্ষা আর স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার উন্নয়নে সচেষ্ট হবে। তারা বিদ্যালয়ে যে শিক্ষা পেয়েছে গ্রামবাসীদের মধ্যে হাতে-কলমে তা কাজে লাগাবে, প্রকৃত দেশকে চিনবে, অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। তাদের পথ দেখাবেন পরিদর্শকেরা।
‘ব্রতী-বালক’পত্রটি নানারকম রিপোর্টে ভরা – গ্রামে গিয়ে কী দেখছে তারা, কী কাজ করছে তারই বিশদ খতিয়ান। তখন গ্রামে যে কতরকম ব্যাধি। মানুষের জীবনের কোনওই মূল্য নেই যেন। মানুষ এই আছেন – এই নেই। গ্রামে তখন কী কী রোগ হত?১৯২৯ সালে শ্রীনিকেতনের আশেপাশের ১১৪টি গ্রামের খতিয়ান পাওয়া যাচ্ছে। জিতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রধান চিকিৎসক। ডাক্তারবাবুর উদ্যোগে গ্রামের ৬৭৬০ জন মানুষ সে-বছর ওষুধ নিতে এসেছিলেন। নিউমোনিয়া,মেনিনজাইটিস্, টাইফয়েড, রক্তআমাশা, গ্যাংরিন প্রধান অসুখ। ব্রতী-বালকদের নিয়ে ডাক্তারবাবু আর তাঁর সহযোগীরা গ্রামে গ্রামে গেছেন। স্বাস্থ্যবিধি কীভাবে মানলে রোগের প্রকোপ কমবে তা হাতে ধরে গ্রামবাসীদের বুঝিয়েছেন। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে যে-কোনও সময়ে যে কোনও রোগ মহামারীর আকার নিতে পারে।
অনেক সময় ওষুধ খেয়ে রোগ কমে গেলে গ্রামবাসীদের জীবনযাপনে নানা শিথিলতা দেখা যেত, ওষুধ খেতেও চাইতেন না আর। ১৯২৮-এ ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কিছু কম, তাই কুইনাইন খাওয়া বন্ধ করে দিলেন অনেকে। তেঁতো ওষুধ খেতে কারই বা ইচ্ছে করে। যাঁরা কুইনাইন খেলেন না তাঁদের মধ্যে শতকরা ৮৩জনের ফের ম্যালেরিয়া হল। বাঁধগোড়া গ্রামের পরিদর্শক ঊষারঞ্জন দত্ত। তাঁর রিপোর্ট থেকে জানা গেল, ১৯২৯-এ বাঁধগোড়া দক্ষিণপাড়ার মুসলমানেরা কুইনাইন খেতে চাননি। ফল ভাল হল না। ত্রিশ জন অধিবাসীর মধ্যে চারজন ম্যালেরিয়ায় ভুগে কাহিল। শুধু ওষুধে ম্যালেরিয়া যাবে না। ভুবনডাঙায় ব্রতী-বালকেরা তাই ১৫টি ছোট ডোবা ভরাট করেন। মশার ডিপো ভরাট না করলে উপায় কী? কোথাও কোথাও ডোবাতে কেরোসিন দেওয়ারও ব্যবস্থা ছিল। বাহাদুরপুরে ৩৫টি ডোবায় কেরোসিন দেওয়া হয়েছিল। ভুবনডাঙায় ৩০০ গজ নালাও কাটা হল – জল আর জমবে না। সাফ করা হল এক বিঘে জঙ্গল। ‘সহজ পাঠ’-এ রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আজ মঙ্গলবার। জঙ্গল সাফ করার দিন।’ সে কেবল শিশু-পাঠ্য প্রাইমারির কথা নয়, বাস্তব জীবনেও বিষয়টির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
আরও পড়ুন: ‘যুদ্ধজ্বর’ হানা দিয়েছিল রবীন্দ্র-পরিবারেও, মনে করাল বিষণ্ণ ২৫শে বৈশাখ
সজনীকান্ত দাসকে দুঃখ করে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, অনেকেই ভাবেন তাঁর শ্রীনিকেতনের কাজকর্ম নেহাতই কল্পনা-বিলাস। একেবারেই তা ছিল না। কর্মীদের কাজে উৎসাহিত করতেন তিনি। দেশ-বিদেশ ঘুরে সেবাকার্যের জন্য টাকা সংগ্রহের দায়িত্ব নিতেন। রবীন্দ্রনাথের টানে অন্যদেশের মানুষ এসে যোগ দিতেন পল্লিসংগঠনের কাজে। অ্যান্টি-ম্যালেরিয়া-সোসাইটিতে বক্তৃতা দিতে গিয়ে সে-কথা বলেছিলেন তিনি। ‘সহৃদয় ইংরেজ এল্ম্হার্স্ট্, তিনি এক পয়সা না নিয়ে নিজের খরচে বিদেশ থেকে নিজের টাকা সংগ্রহ করে সে টাকা সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। তিনি দিনরাত চতুর্দিকের গ্রামগুলির দুরবস্থা কী করে মোচন হতে পারে, এর জন্য কী-না করেছেন বলে শেষ করা যায় না।’ রবীন্দ্রনাথের তখন প্রায় আশি বছর বয়স। মোটরগাড়ি করে অসুস্থ শরীরে বাঁকুড়ায় গেলেন। পুকুর কেটেছে – জল-সংস্কার করেছে গ্রামের মানুষ। তাদের সেই সাধু উদ্যোগে পাশে থাকা চাই।
রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন রোগ-ব্যাধির সঙ্গে লড়াইয়ের মূলমন্ত্র সামাজিক দূরত্ব অতিক্রম করা। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগসাধন না হলে মহামারির সঙ্গে লড়াই করা অসম্ভব। ব্যাধির যথার্থ প্রতিষেধক সমবায়ী সামাজিক মন। ডেনমার্কের সমবায়-ব্যবস্থা নিয়ে বেশ খোঁজখবর নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বলেছিলেন, ডেনমার্কে সমবায় প্রথা চালানো সম্ভব কারণ ‘সে দেশ রণসজ্জার বিপুল ভারে পীড়িত নয়। তার সমস্ত অর্থই প্রজার বিচিত্র কল্যাণের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণে নিযুক্ত হতে পারে। প্রজার শিক্ষা স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সম্পদের জন্যও আমাদের রাজস্বের ভারমোচন আমাদের ইচ্ছাধীন নয়।’ঔপনিবেশিক ভারতে প্রজার শিক্ষা-স্বাস্থ্যে তেমন অর্থ বরাদ্দ হত না। রাজস্বের উদ্বৃত্ত অন্য খাতে ব্যয় করা হত। সেই ঐতিহ্যের বদল এই গণতান্ত্রিক ভারতেও কি খুব হয়েছে! ঔপনিবেশিক সরকারের উপর ভরসা না করে স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রসার ও ম্যালেরিয়া দূরীকরণের জন্য সামাজিক সমবায় গড়ে তোলাই সেকালে রবীন্দ্রনাথের মতে সেরা উপায়।
এই রাবীন্দ্রিক বিধান মাথায় পাক খায়, ক্রমাগত। করোনা কবলিত ভারতে পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রেখে গৃহবন্দি থাকলেই কিন্তু সব সমস্যার সমাধান হবে না। সামাজিক সহযোগের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তদের কাছে লকডাউনের যে তাৎপর্য, গরিব মানুষের কাছে লকডাউনের তাৎপর্য তো তা নয়। অর্থ-খাদ্যের মজুত যখন কমবে তখন নিজেদের উদ্বৃত্ত ভাগ করে নিতে হবে। পাশের মানুষটি স্বাস্থ্যবিধি না মানলে তাঁকে বোঝানো চাই। অকারণ ভয় আর অসহিষ্ণুতার ফল কোনও কালেই সুখপ্রদ ছিল না। প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দায়িত্ব পালনই এখন সকলের আদর্শ হওয়া উচিত।
(বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy