Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪
Durga Puja

ওরাও তো পাড়ার লোক

এটা কেমন উৎপীড়ন, তা বোঝা খুব সহজ, আমাদের চোখে সারা রাত কেউ আলো ফেলে রাখলে যেমন হবে, অনেক গাছের ক্ষেত্রেই হবে ঠিক তাই।

পুলক লাহিড়ী
শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৮ ০০:০১
Share: Save:

পুজো আসতে না আসতেই আমাদের পাড়ায় গাছ ছাঁটা শুরু হয়েছে। রাস্তার দিকে মেলে দেওয়া ডালপালাগুলো কেটে সাফ করে দিচ্ছেন পুরসভার নিয়োগ-করা কর্মীরা। এখন গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে অদ্ভুত বেখাপ্পা ভাবে। তার এক দিকে পাতাসুদ্ধ ডালের ‘ক্যানোপি’, অন্য দিক একেবারে ফাঁকা।

যাঁরা এমন ভাবে গাছ কাটেন, তাঁদের জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হয়, আপনার একটা পা যদি কেটে দেওয়া হয়, কেমন করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন আপনি? গাছের শরীরেরও তো একটা ভারসাম্য রয়েছে। সব দিকে ডালপালা ছড়িয়ে সেই ভারসাম্য সে তৈরি করে অনেক দিন ধরে। সেটা কি এমন করে নষ্ট করে দেওয়া যায়?

এই তো শুরু। এর পরে গাছের সারা গায়ে পেঁচিয়ে দেওয়া হবে আলো। এমনকি তার ডালের ফাঁকেও কায়দা করে উঁচু ওয়াটের বড় আলো গুঁজে দেওয়া হবে, সারা রাত সেগুলো জ্বলবে। এটা কেমন উৎপীড়ন, তা বোঝা খুব সহজ, আমাদের চোখে সারা রাত কেউ আলো ফেলে রাখলে যেমন হবে, অনেক গাছের ক্ষেত্রেই হবে ঠিক তাই। যে সব ফুল রাতে ফোটে, ফোটার মুখে এক সেকেন্ড আলো ফেললে সে ফুল আর কোনও দিন ফুটবে না। এমনই সংবেদনশীল বহু গাছ। নানা গাছের উপর আলোর প্রভাব নানা রকম। কার কী ক্ষতি হচ্ছে, কতটা হচ্ছে, মানুষ টেরও পায় না। পার্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সোডিয়াম বাষ্পের আলো গাছের জন্য ভাল নয়, কারণ তা অবলোহিত আলো খুব বেশি বিকিরণ করে।

পুজোর আর এক বিপদ, গাছের গায়ে পেরেক ঠুকে বিজ্ঞাপনের বড় বড় ফ্লেক্স, হোর্ডিং লাগানো। অথচ এই শহরে বসে একশো বছর আগে জগদীশচন্দ্র বসু দেখিয়েছিলেন প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যে ব্যথার বোধ একই রকম বর্তমান। তার পর বিজ্ঞান অনেক এগিয়েছে। উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা বলছেন, গাছের শোক, দুঃখ, টেনশন আছে, আবার আছে সখ্য, সমাজবন্ধন। এমনকি বাবা-মায়ের প্রতি ‘নাড়ির টান’ বলতে মানুষ যা বোঝে, তা-ও আছে গাছের। ‘দ্য হিডন লাইফ অব ট্রিজ়’ বইটির লেখক পেটর ওলবেন দেখেছেন, অরণ্যে অতি-প্রাচীন গাছের গুঁড়িটুকু বাঁচিয়ে রেখেছে আশেপাশের গাছেরা, শিকড়ের মাধ্যমে খাবার আর জল পাঠিয়ে। সব বুড়ো গাছকে এ ভাবে কিন্তু বাঁচায় না অন্য গাছেরা। ওলবেন বলছেন, নিশ্চয়ই ওদের মধ্যে ‘সম্পর্ক’ আছে। সম্ভবত জননী-সন্তানের সম্পর্ক।

মানবসমাজের মতোই গাছেদেরও আছে নিজস্ব সমাজ, বিজ্ঞানের জগতে তা নিয়ে জোরদার চর্চা চলছে। এটা কিছু আশ্চর্য কথা নয়, একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়। শাল গাছ আমাদের দেশে অনেক হয়, কিন্তু একা একটা শাল প্রায় দেখাই যায় না। মানুষ আলাদা করে পুঁতলে তার বৃদ্ধি তেমন হয় না। আশপাশে অন্য শালগাছ না থাকলে শাল বড়ই হয় না। আমেরিকার রেড-উড গাছ দু’তিন হাজার বছরও বাঁচে, লম্বা হতে পারে দু’শো ফুট অবধি, চ়ওড়া যা হয় তাতে ভিতর দিয়ে একটা হাইওয়ে চলে যেতে পারে। অথচ ইউরোপের নানা পার্কে তার চারা এনে পোঁতার পর তারা সাধারণ দৈর্ঘ্যের গাছ হয়েই থেকেছে।

সমাজ-সংসারের মধ্যে গাছদের যে বাড়বাড়ন্ত, একা তা সহজে হয় না। বৃক্ষশিশুরা আক্ষরিক অর্থেই ‘মায়ের ছায়া’য় বেড়ে উঠলে তবে ‘বড়’ হতে পারে। তার পুষ্টি, সুরক্ষা, অসময়ে অতিবৃদ্ধির নিয়ন্ত্রণ, এ সবই হয় অন্য গাছের সঙ্গগুণে। ‘একটি গাছ, একটি প্রাণ’ ধুয়ো তুলে পার্কে একটা গাছ বেমক্কা পুঁতে দেওয়ার সময়ে সে কথাটা ভুলে যাই।

সমাজ মানেই সংযোগ, পরস্পরকে বার্তা পাঠানো। গাছ কী ভাবে একে অন্যকে বার্তা পাঠায়, তা নিয়ে অনেক গবেষণা চলছে। যখন বাগানে বা ময়দানে অনেকটা ঘাস এক সঙ্গে কাটা হয়, তখন বাতাসে একটা গন্ধ ভাসে। অনেকের হয়তো সদ্য-কাটা ঘাসের বুনো বুনো গন্ধ ভাল লাগে, কিন্তু ওই গন্ধ আসলে স্বজনের প্রতি ঘাসের সতর্কবার্তা। ‘আমি কাটা পড়লাম, তুমি সাবধান হও’ এই খবর বাতাসে ছড়িয়ে দেয় ঘাস। আফ্রিকায় এ ভাবেই জিরাফেরা অ্যাকাশিয়া গাছে মুখ দিলে সে গাছ বাতাসে রাসায়নিক ছেড়ে বার্তা পাঠায় অন্য গাছকে। তারা তড়িঘ়ড়ি টক্সিন এনে জমা করে পাতায়, পাতা তেতো হয়ে যায়। জিরাফও তা জানে, তাই তারা হাঁটে হাওয়ার উল্টো দিকে।

ঘাস ছড়ায় অ্যালকোহল, কিটোন, অ্যালডেহাইড, এস্টার ধরনের রাসায়নিক। অন্য ঘাসের এমন প্রতিক্রিয়া হয় যাতে পশুরা মুখ দিলে বিস্বাদ লাগে। মুশকিল হল, গাছদের মধ্যে বহু যুগ ধরে গড়ে-ওঠা আত্মরক্ষার এমন সব রাসায়নিক উপায়ও মানুষের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মেনে যায়। কুড়ুল, করাত কিংবা ঘাস কাটার বৈদ্যুতিন যন্ত্রের মোকাবিলা করার শক্তি প্রকৃতি এখনও উদ্ভিদ জগৎকে দেয়নি। যে শত্রু ঘাস-পাতা খায় না, গাছের শরীরে ডিম পাড়ে না বা বাসা বাঁধে না, যার জিভ-নাক-চোখ কিছুই নেই, তেমন ধাতব দানবকে কী করে নিরস্ত করবে গাছ?

মানুষ তার সূক্ষ্ম অনুভূতির বড়াই করে, কিন্তু গাছদের প্রাণকে আমরা নিজের মধ্যে অনুভব করি না। পাড়ার কুকুরকে নির্যাতন করলে অনেকে তবু আপত্তি করেন, কিন্তু গাছের ক্ষতি করলে কেউ কিছু বলেন না। বরং পেরেক ঠুকতে বারণ করতে গিয়ে শুনতে হয়েছে, ‘‘এত বড় গাছে একটা-দুটো পেরেক লাগালে কিছু হবে না।’’ ওই ক্ষতস্থানে সংক্রমণ হয়ে গাছ যে মরেও যেতে পারে, তা বোঝানো মুশকিল।

পুরস্কার কমিটিগুলো পুজোর উদ্যোক্তাদের অনেক বিষয়ে সচেতন করেছে। মাইকের অত্যাচার কমেছে, অগ্নিসুরক্ষা এসেছে, ইমার্জেন্সি নিষ্ক্রমণ-সহ দর্শকের নানা সুবিধের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ বার পাড়ার গাছগুলোর ভালমন্দকে কি ভাল পুজোর শর্তের মধ্যে জোড়া যায় না? গাছে আলো লাগানো বন্ধ হোক, উৎসবের আলো ঊর্ধ্বমুখী না হয়ে আলোকিত করুক রাস্তাটুকু। পুজোর সাজসজ্জার জন্য গাছের গায়ে হাত না পড়ে। গাছ কেন কষ্ট পাবে পুজোয়? ওরাও তো পাড়ারই লোক।

অন্য বিষয়গুলি:

Tree Branches Durga Puja
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE