Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ১

জমি দখল নয়, এ হল বাড়ি ফেরার প্রশ্ন

কাশ্মীর পণ্ডিতদের পুনর্বাসন নিয়ে এখন নতুন করে শ্রীনগর ও দিল্লি সরগরম। পক্ষে বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া প্রবল। ‘যৌথ’ না ‘পৃথক’ বাসস্থান কাম্য, সেই প্রশ্নে রাজনীতি উত্তাল। কিন্তু পুনর্বাসন যে একটা ‘অধিকার’, সেটা আগে মানা দরকার।রাজেশ রায়না কাশ্মীরের বেশ নামী সাংবাদিক। কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি ফেসবুকে একটি ভিডিয়ো পোস্ট করেন, যেটা কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘ভাইরাল’ হয়ে যায়, হু হু করে চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

উত্তপ্ত। কাশ্মীরে পণ্ডিত কলোনি তৈরির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, শ্রীনগর, ৩ জুন। পিটিআই

উত্তপ্ত। কাশ্মীরে পণ্ডিত কলোনি তৈরির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, শ্রীনগর, ৩ জুন। পিটিআই

সুজাত বুখারি
শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

রাজেশ রায়না কাশ্মীরের বেশ নামী সাংবাদিক। কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি ফেসবুকে একটি ভিডিয়ো পোস্ট করেন, যেটা কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘ভাইরাল’ হয়ে যায়, হু হু করে চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিয়োতে দেখা যায়, কোকরনাগের এক বয়স্ক কাশ্মীরি, আবদুর রাজ্জাক ওয়াগি, রাজেশের স্ত্রীর কাছে আশি টাকা ফেরত দিতে চাইছেন, কেননা সেই ভদ্রমহিলার বাবা সোমনাথ কাউল ১৯৯০ সালে পাকাপাকি ভাবে কাশ্মীর ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে ওয়াগি তাঁর কাছে আশি টাকা ধার করেছিলেন। অনেক কষ্ট করে ওয়াগি কাউলের কন্যা রাজেশের স্ত্রীর সন্ধান পান, তাঁর কাছে অনেক কাকুতিমিনতি করেন, সেই টাকা ফেরত দিয়ে নিজেকে ঋণমুক্ত করতে চান। ভদ্রমহিলা কান্নায় ভেঙে পড়েন, কিছুতেই তিনি টাকা নিতে চান না। শুধু টাকা ফেরত নয়, রাজ্জাক রাজেশের স্ত্রীকে অনুরোধ করেন তাঁদের ফেলে আসা পৈতৃক বাড়িতে আবার ফিরে আসার জন্য, বলেন, ‘‘আমাদের বাড়ির দরজা আপনার পরিবারের জন্য চিরদিন খোলা থাকবে।’’

ভিডিয়োটি নাকি আড়াই লক্ষের‌ও বেশি মানুষ দেখেছেন। শ্রীনগরে, দিল্লিতে, জম্মুতে। কাশ্মীরি পণ্ডিত নিয়ে যখন আবার রাজনৈতিক পরিবেশ সরগরম, সেই সময় এই দর্শকরা কী বুঝলেন এই ভিডিয়ো থেকে কে জানে। তবে এই কাহিনি কিন্তু প্রাক্তন প্রতিবেশীদের পুনর্মিলনের সাধারণ কাহিনি নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে আরও অনেক কিছু। কাশ্মীর উপত্যকায় কাশ্মীরি পণ্ডিতদের প্রত্যাবর্তন নিয়ে এখন যত রাজনৈতিক চাপান-উতোর, জটিল আলোচনা বিবেচনা, তার তলায় লুকিয়ে-থাকা এই কাহিনিগুলি বুঝিয়ে দেয় দুই পক্ষেই কতখানি আবেগ আজও বইছে, যা কখনও উপরতলার কথাবার্তায় ধরা পড়বে না। মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি ২৮ মে রাজ্যপালের বিধানসভা বক্তৃতার উত্তরে প্রত্যয়ের সঙ্গে ঘোষণা করেছেন যে, তিনি কাশ্মীর পণ্ডিতদের উপত্যকায় ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হবেন। প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়েছে এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের আগের বাড়িঘর ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়, আগের মতো মিলেমিশে থাকা সম্ভব নয়, এই সব শোনা যায়। মুফতি বলেন যে আপাতত তাঁদের জন্য আলাদা বাসস্থান তৈরি হবে, পরে ‘‘পরিস্থিতি অনুকূল হলে তাঁরা বাড়ি ফিরতে পারবেন।’’ ‘যৌথ’ বসবাস অঞ্চলের কথা তিনি বলেননি। বলেছেন, এখন তৈরি হবে ‘সাময়িক বসবাস অঞ্চল’।

ঘটনা হল, ভারত সরকার কিন্তু এত দিন বার বার ‘যৌথ বসবাস অঞ্চল’-এর কথাই বলে এসেছে। সংসদে যত বার কথা উঠেছে, কিংবা কাশ্মীর বিধানসভার সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, তত বারই এমন অঞ্চলের প্রস্তাবই শোনা গিয়েছে। ২০১৫ সালের ৭ এপ্রিল প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোর সূত্রেও জানা যায় যে পূর্বতন মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সইদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহকে এমন অঞ্চল তৈরির কথাই বলেছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকার সেই অনুযায়ী আলাপ আলোচনা চালায়। এ বারেও মেহবুবা মুফতি ‘কম্পোজিট’ বসবাস অঞ্চলের কথা অস্বীকার করেননি। তাই, সরকার যখনই বলেছে যে নির্মীয়মাণ অঞ্চলে কেবল কাশ্মীরি পণ্ডিতরাই থাকবেন না, অন্যরাও থাকতে পারেন, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের প্রধান সংগঠন ‘পানুন কাশ্মীর’ জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছে যে, না, কোনও মতেই ‘সহাবস্থান’-এ রাজি নন তাঁরা, আলাদা বাসস্থানই তাঁদের চাই!

পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (পিডিপি) এবং বিজেপির ‘মিলিত কর্মসূচি’তে এই বিষয়টি সবিস্তার আলোচিত হয়নি। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের প্রত্যাবর্তনের কথা কর্মসূচিতে ছিল। কিন্তু সেই আলোচনার ভাষার মধ্যে অনেকটা ফাঁক রাখা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, কাশ্মীরি পণ্ডিতরা ফিরলে রাজ্যের নাগরিক হিসেবে তাঁদের অধিকার মান্য করা হবে, এবং ক্রমে তাঁদের কাশ্মীরি সমাজের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হবে। বলা হয়েছিল, ‘‘নতুন করে সমন্বিত সমাজ তৈরির একটি পদ্ধতি আছে। সরকার সেই কাজ শুরু করলেও নাগরিক সমাজই আস্তে আস্তে তা সম্পূর্ণ করতে পারে।’’ শব্দের ব্যবহারই বলে দেয়, নতুন টাউনশিপ কেমন হবে, ‘কম্পোজিট’ বা যৌথ, না কি ‘সেপারেট’ বা পৃথক, সে বিষয়ে সরাসরি কিছু বলতে চাওয়া হয়নি। যে পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে, সেটাও সুবিবেচনার কথা। কেবল সাময়িক ভাবে নতুন বাসস্থানের ব্যবস্থার প্রশ্নেই এত প্রবল বিরোধিতা আসছে, গোটা রাজ্য এই ভাবে বিবদমান শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়েছে! রাজনৈতিক দলগুলিও পক্ষ বেছে তাল মেলাচ্ছে। পণ্ডিতদের ফেরার ব্যবস্থা কী হবে, তার বন্দোবস্তের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাপারটা থেকে যে যার মতো করে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করে নেওয়ার হিড়িক। সরকার যে সাময়িক বসবাস অঞ্চলের প্রস্তাব দিচ্ছে, তার ছবিটা এখনও অত্যন্ত অস্পষ্ট। এত দিন অবধি দেখা গিয়েছে, সরকারি নীতি হল কেবল টুকরো টুকরো অনুদান দিয়ে আসা। আগের সরকার পণ্ডিতদের জন্য শেখপুরা আর ভেসু-তে কলোনি তৈরি করেছিল, খুচরো ভিত্তিতে হাজার-চারেক ছেলেমেয়েকে চাকরি দিয়েছিল। কিন্তু সে সবই খুচরো সংস্কার, কোনও সুচিন্তিত পুনর্বাসন বা পুনর্নিয়োগ পরিকল্পনা হয়নি। গত সপ্তাহেও শোনা গিয়েছে, আরও নাকি চার হাজার চাকরির ব্যবস্থা হবে। কিন্তু তাতে কোনও ফল হবে কি? এই সব খুচরো চাকরি কিছু দিন করে ছেলেমেয়েগুলি তো আবার জম্মু বা দিল্লি ফিরে যায়। পণ্ডিত সমাজ এখনও মনে করে, কাশ্মীর উপত্যকার থেকে ভারতেই তাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। তা ছাড়া, উপত্যকায় তাদের নিরাপত্তাই বা কে নিশ্চিত করবে? কেন্দ্রীয় সরকার তো এখনও মনে করে উপত্যকার পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ নয়, সেই জন্যই তো আফস্পা-র মতো দমনমূলক আইন এখনও সেখানে লাগু।

আর বিচ্ছিন্নতাবাদীরা? এ ক্ষেত্রে কোনও অর্থপূর্ণ কথা তাঁরা এখনও পর্যন্ত বলে উঠতে পারেননি। এঁরা কাশ্মীরের নিজস্ব চরিত্রের কথা বলেন, তার ভিত্তিতে কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের দাবি জানান। কিন্তু কাশ্মীরি পণ্ডিতরা তো কাশ্মীরের সেই নিজস্ব সমাজেরই অংশ! গত পঁচিশ বছর ধরে তাঁদের জন্য কী করা যায়, সে বিষয়ে কোনও স্পষ্ট রূপরেখা কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দিয়ে উঠতে পারেননি। সরকারের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু সরকারি প্রস্তাবের বাইরে গিয়ে এই সম্প্রদায়ের জন্য আর কী করা সম্ভব, তা নিয়ে মুখ খোলেননি। এঁদের অবস্থান কেবল নেতিবাচকই থেকেছে, কোনও যুক্তিসঙ্গত বাস্তবসম্মত প্রস্তাবে পরিণত হয়নি। অথচ, কাশ্মীর পণ্ডিত সমস্যার সমাধান ছাড়া কাশ্মীরের কোনও বৃহত্তর সমাধানই অসম্ভব।

সেই ভিডিয়োটার কথায় ফিরে আসি। হয়তো এই জায়গাটা থেকেই দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্ক নতুন করে ভাবার একটা সম্ভাবনা আছে। অল্প সংখ্যায় হলেও এই ধরনের ঘটনা বুঝিয়ে দেয়, সামনে এগোনো সম্ভব। অনেক ক্ষোভ-বিক্ষোভ, বৈরিতা-সংঘাত সত্ত্বেও গত এক দশকে কাশ্মীরে দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্ক একটু ভাল হয়েছে। দুই তরফেই নাগরিক সমাজকে সেটা বুঝে এগিয়ে আসতে হবে। আস্তে আস্তে পণ্ডিতদের ফিরে আসার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। কাশ্মীরে ফিরিয়ে আনাটাই তো যথেষ্ট নয়, তাঁদের নিজেদের বাড়িতেই তাঁদের ফেরাতে হবে। কাশ্মীর উপত্যকার সংখ্যাগুরু সমাজকে বুঝতে হবে যে পণ্ডিতরা ‘জমি দখল’ করতে আসছেন না, যে বাসস্থান থেকে উৎখাত হয়েছিলেন, সেখানে ফিরে আসছেন শুধু। এই ফিরে আসার অধিকার তাঁদের আছে। কোনও সরকারের বার্তাবাহক সম্প্রদায় হিসেবে তাঁরা সেই অধিকার পাচ্ছেন না। তাঁরা সেই কাশ্মীরের অংশ, যে কাশ্মীর একটা সহনশীল সমাজ, ভ্রাতৃত্ব আর মৈত্রীর প্রতিভূ। অন্যরা কাশ্মীরের সেই রূপ জানুন না জানুন, কাশ্মীরিরা তো জানেন। সেই কাশ্মীর-এর খাতিরেই পণ্ডিতদের প্রত্যাবর্তন জরুরি। ‘যৌথ বাসস্থান’, ‘পৃথক বাসস্থান’ ইত্যাদি তর্কাতর্কি দিয়ে কাজটা কোথাও এগোবে না।

ইমেল: shujaat7867@gmail.com

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy