ফাইল চিত্র।
উল্টো স্রোতটা জাগছে এ বার পাহাড়ে ক্রমশ। রক্তচক্ষুর সামনে অনন্ত আত্মসমর্পণ আর নয়, প্রলম্বিত বন্ধ ও অচলাবস্থা আর চুপচাপ মেনে নেওয়া নয়, বুঝিয়ে দিতে শুরু করল পাহাড়ের জনমত। পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে পাহাড়ে যে বন্ধের ডাক দিয়েছিলেন বিমল গুরুঙ্গরা, তা একটানা চলছে। পাহাড়ে অচলাবস্থা ১০০ দিন পার করে ফেলেছে। তাও সব কিছু অচলই রেখে দিতে বদ্ধপরিকর বিমল গুরুঙ্গ তাঁর গোপন ডেরায় বসে আজও হুঙ্কার ছাড়ছেন। কিন্তু পাহাড়ের মেজাজটা এ বার অন্য রকম যেন। হুঙ্কারের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়িয়ে দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ খুলে ফেলার তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের নানা অংশে এ বার। সাধারণ জনগণের মধ্যে নিষ্কৃতির আকাঙ্খা ক্রমশ তীব্র। অতএব নৈরাজ্যবাদীরা শক্তি হারিয়ে ফেলছেন অত্যন্ত দ্রুত।
লড়াই-সংগ্রাম-আন্দোলন গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, লড়াই-সংগ্রাম-আন্দোলন গণতন্ত্রের প্রাণবায়ু। কিন্তু সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক বন্দোবস্ত রয়েছে যে দেশে, যে ভূখণ্ডের মানুষ আইনের শাসনে দীর্ঘ দিন ধরে অভ্যস্ত, সে ভূখণ্ডে ক্ষোভের নামে অনন্ত কাল ধরে আগুন জ্বালিয়ে রাখা কঠিন। এই সত্য আগেও অনেক বার প্রমাণিত হয়েছে। আরও এক বার প্রমাণিত হওয়ার পথে দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াঙের জনমতের হাত ধরে। গুরুঙ্গদের একবগ্গা আন্দোলনের বিরোধিতা করে বিনয় তামাঙ্গ, অনীত থাপারা আগেই ডাক দিয়েছিলেন জনজীবনে স্বাভাবিকতা ফেরানোর। অচলাবস্থা কাটিয়ে ইতিউতি সচল হওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। এ বার বণিক সংগঠনও একই পথ নিয়েছে। গুটিয়ে রাখা ব্যবসা ফের চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পাহাড়ের ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা। খুলে যাক অফিস-কাছারিও ধীরে ধীরে, চাইছেন পাহাড়বাসী। গুরুঙ্গ অবশ্য মানতে নারাজ এখনও। সুতরাং, দোকানপাট খোলার চেষ্টা হতেই ফের অশান্তির চেষ্টাও হল। ইতিউতি আগুন জ্বালানো হল রবিবারও। কিন্তু বন্ধ-বাদীদের প্রবল হতাশায় ঠেলে দিয়ে স্বাভাবিকতায় ফেরার ইচ্ছাই বড় হয়ে ধরা দিল পাহাড়ের দৃশ্যপটে।
আরও পড়ুন: হুমকিতেই রইল বন্ধ
গণতন্ত্রে জনগণই যে শেষ কথা, তা সুবিদিত সত্য। গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও জনগণই সব। সেই জনগণের ইচ্ছাটা কি, তা অভ্রান্ত ভাবে আঁচ করতে পারা সফল নেতার পক্ষে অত্যন্ত জরুরি। বিমল গুরুঙ্গ তা অভ্রান্তই আঁচ করতেন। করতেন বলেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ সুবাস ঘিসিংকে সরিয়ে পাহাড়ের রাশ নিজের হাতে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন এক দিন। কিন্তু আজ খুব জনবিচ্ছিন্ন দেখাচ্ছে গুরুঙ্গকে। গ্রেফতারি এড়াতে এমনিতেই তিনি কিছুটা বিচ্ছিন্ন জীবন কাটাচ্ছেন পাহাড়বাসীর থেকে। মানসিক ভাবেও যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন নিজের জনভিত্তির থেকে, তাও এ বার বেশ স্পষ্ট হচ্ছে। দীর্ঘ অচলাবস্থায় ক্লান্ত পাহাড় যখন স্বাভাবিকতায় ফিরতে উদ্গ্রীব, তখনও বিমল গুরুঙ্গ বন্ধ বহাল রাখার সিদ্ধান্তে অবিচল।
দাবি আদায় করার জন্য এমন দীর্ঘ অচলাবস্থা বা প্রশাসনের সঙ্গে এমন দীর্ঘ অসহযোগিতার পথ নেওয়া বেনজির নয়। এর আগেও অনেক বারই এমন হয়েছে। শুধু বাংলায় বা ভারতে নয়, গোটা পৃথিবীতেই এমন আন্দোলন হয়ে থাকে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, আন্দোলন জনগণের জন্য, জনগণ আন্দোলনের জন্য নন। বিমল গুরুঙ্গ সে কথা মনে রাখতে পারছেন না সম্ভবত। আন্দোলন তাই নৈতিকতা হারাচ্ছে এ বার, হারাচ্ছে মানসিক শক্তিও।
পৃথক গোর্খাল্যান্ড হওয়া উচিত কি না, সে প্রশ্ন অন্য। আজকের প্রশ্ন হল, পাহাড়ের মানুষের জন্য গোর্খাল্যান্ড, নাকি গোর্খাল্যান্ডের জন্য পাহাড়ের মানুষ? বিমল গুরুঙ্গের একগুঁয়েমি এই ভাবে সামনে আনল প্রশ্নটাকে। আন্দোলটা বিমল পাহাড়ের মানুষের জন্য করছেন, নাকি নিজের আন্দোলনের স্বার্থে পাহাড়ের মানুষকে ব্যবহার করতে চাইছেন? বিতর্কটা এই রকম দাঁড়াচ্ছে অনেকটা। সেখানেই উঠে আসছে রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতার প্রশ্ন।
যত দিন ধরে পাহাড় অচল করে রেখেছেন বিমল গুরুঙ্গরা, পৃথিবীর নানা প্রান্তে তার চেয়েও অনেক দীর্ঘায়িত আন্দোলনের সন্ধান মেলে ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু এমন ধারণা যদি চারিয়ে যায় যে, আন্দোলনের নেতা জনসাধারণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা নিয়ে ভাবিত নন, বরং নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই জনসাধারণের উপর চাপাতে চাইছেন নেতৃত্ব, তা হলে বিশ্বাসে ঘাটতি দেখা দেয়, কায়েমি স্বার্থ উঁকি দিতে থাকে, রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতার আভাস স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সঙ্কীর্ণতার রাজনীতি খুব বেশি দিন বশে রাখতে পারে না জনমতকে। গুরুঙ্গদের সতর্ক হতে হবে অতএব, এখনই আয়নার সামনে দাঁড়াতে হবে। না হলে ভবিষ্যৎ আরও কঠিন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy