ছবি: সংগৃহীত
পার্ক সার্কাস ময়দানে যখন স্লোগান উঠছে আজাদির, ঠিক তখনই অনেকগুলো মানুষ একে অন্যকে চিনে নিচ্ছেন। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসের হাত ধরছেন। একটা অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে শুরু হওয়া অসংগঠিত আন্দোলন কী ভাবে যেন দেশের মানুষের একসঙ্গে বেড়ে ওঠার শিকড়টাকে মজবুত করছে, সেটা এই মাঠে এসে নিজের চোখে প্রত্যক্ষ না করলে নিজের দেশকে চেনা বাকি থেকে যায়। ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ শুধু কবিতায় নয়, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি আমরা। নতুন করে চিনতে শিখছি নিজেদের দেশকে। তাই এই আন্দোলন কোনও ভাবেই ব্যর্থ হতে পারে না। ফ্যাসিস্ট শাসকের ভিত যদি এই মুহূর্তে না-ও নড়ানো সম্ভব হয়, অন্তত সুদূর ভবিষ্যতে তাকে উপড়ে ফেলার মতো মাটির নীচে শিকড় যথেষ্ট পরিমাণে মজবুত হচ্ছে, এতে কোনও সন্দেহ নেই।
পার্ক সার্কাস নাকি এখন কলকাতার শাহিনবাগ। অনেকেই এই কথা বলছেন। যাঁরা এখনও শাহিনবাগ প্রত্যক্ষ করতে পারেননি, তাঁদের প্রত্যেকের অবশ্যই এক বার পার্ক সার্কাস ময়দান ঘুরে আসা উচিত। ‘ঘরের কাছে আরশিনগর, সেথা এক পড়শি বসত করে’ লালনের এই বিশ্বনাগরিক পঙ্ক্তির অর্থ অনুধাবন করতে গেলে নিঃস্ব দুই হাত নিয়ে পার্ক সার্কাস ময়দানে এসে দাঁড়াতে হয়।
কী আছে আর কী নেই সেখানে! ফতিমা বিবিদের হিজাব-নাকাবে ঢাকা মুখের মধ্যে উজ্জ্বল দুই চোখ আমাদের ভরসা দেয়। বিশ্বাস করতে শেখায়, এখানে মেয়েরা আমরা রাতভর একা থেকেও ভীষণ নিরাপদ। মায়ের ওম মাখা নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ওঁরা নিজেদের বুকে আমাদের জায়গা দিয়েছেন। সারা দিন ওঁরা নিজেরা শীতের মধ্যে না খেয়ে, না আরাম করে খোলা আকাশের নীচে হিমে ভিজে বসে থেকেছেন প্রতিবাদ জমায়তে। কিন্তু যখন শত ক্লান্তি, শত ক্ষোভের মাঝেও আত্মীয়তা দেখানোর সুযোগ এসেছে, এক ইঞ্চি সুযোগ ছাড়েনি পার্ক সার্কাসের হৃদয়। কড়া হিমের নীচে সালেম ভাই যখন আদর করে ডেকে নিয়ে গিয়ে হাতে উষ্ণ চায়ের কাপ ধরিয়ে দেন, ভাবতে ভাল লাগে আমার একটা ভাই আছে এই পৃথিবীতে। কোথায় যেন নিমেষে মিলিয়ে যায় অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাস-সংশয়। যখন একেবারে আনকোরা অপ্রস্তুত গণতন্ত্র আদায় করে নেওয়ায় ময়দানে দুম করে ঢুকে পড়ে কোনও সদ্যোজাত বিপ্লবী, তাকেও আপন করে নেন মহম্মদের আম্মি। এক ঠোঙা শুকনো মুড়ি এগিয়ে দিয়ে বলে— ‘খেয়ে নাও বেটি’! কে বলে, এই ভারতে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ায় মুসলমানের রাতের ঘুম উড়ে যাওয়া নিয়ে হিন্দুর কোনও মাথাব্যথা নেই? কে বলে, এই দেশ সংবিধানের পাঠ না নিয়ে ক্রমশ হিন্দুরাষ্ট্র হওয়ার দিকে এগোচ্ছে? পার্ক সার্কাসের রাতজাগা তারারা প্রমাণ করে দেয়, এই দেশ রক্ত, মাংস আর সংবেদনশীল মনন দিয়ে তৈরি মানুষের। যাঁরা কখনও প্রতিবেশীকে হিন্দু বা মুসলিম নামে চিহ্নিত করেননি— বেটি বা দিদা, আম্মি কিংবা ভাইয়া বলে ডাকতে শিখিয়েছেন।
গত কয়েক দিনের আন্দোলনে পার্ক সার্কাসের ময়দানে ছেলে মেয়ে তৃতীয় লিঙ্গ সবাই ভিড় জমিয়েছেন। ‘বোল রে বেহনা’র উত্তরে ‘আজাদি’ স্লোগানটি কোন ধর্মের মানুষ দিল, তা-ও আলাদা করা যায়নি। এ তো জাতীয় নাগরিক পঞ্জি, নাগরিকত্ব আইন, সংবিধান রক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের দাবির চেয়েও অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। যেখানে হিন্দু আর মুসলিম নিজেদের মধ্যে পরিচয় করে নিয়েছে। একে অন্যের ভাবাবেগ জানতে চেয়েছে, বুঝতে চেয়েছে। এই আন্দোলনের গতিপথ আরও অনেক বৃহত্তম লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছে ওরা। ওরা মানে, এক মাঠে বসে রাষ্ট্রের চোখরাঙানির বিরুদ্ধে একজোট হওয়া মানুষগুলো। যাঁদের কারও ভোটার কার্ডে নাম সালমা খাতুন, কারও নাম তিতাস দত্ত। ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড আছে। তবু ওঁরা একসঙ্গে চিৎকার করে রাতের নিস্তব্ধতা চিরে জানিয়েছেন— ‘আমরা কাগজ দেখাব না’। ‘হম কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে’। ভাষাটা হয়তো আলাদা। কিন্তু আবেগের ধর্মে কোনও ফারাক করা যায়নি।
পার্ক সার্কাস ময়দানের দিনরাতের অবস্থান আমাদের জাতীয়তাবাদ চিনতে শিখিয়েছে। ভারতের তেরঙা জাতীয় পতাকা খুদে মুসলিম মেয়েটিকে স্লোগানের সঙ্গে সঙ্গে ওড়াতে দেখে ভিন্ন ধর্মের প্রতিবেশী মানুষটি মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকেছেন। এই কি তবে দেশাত্মবোধ?
যে মানুষটা কোনও এক সময়ে মুসলমান প্রধান এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময়ে কটু আতরের গন্ধে মাথা ধরে যাওয়ার ভয়ে নাকে হাতচাপা দিতেন, তাঁর সহসা সেই সস্তা আতরের গন্ধকে ভীষণ আপন মনে হতে থাকে। ডিগ্রির পাঠ্যক্রমে গাঁতিয়ে মুখস্থ করা নজরুলের কবিতার ‘মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু মুসলমান’ লাইনখানার অর্থ আজ তাঁর যথার্থ বোধগম্য হয়, যখন ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ বেপাড়ার ভিন্ন ধর্মের সহযোদ্ধার জলতেষ্টা মেটাতে নিজের সংগ্রহে রাখা অন্তিম জলটুকু অকাতরে বিলিয়ে দেন কোনও মেহরুম দাদি।
ভরসা করতে পারি, কোনও রাজনৈতিক গুন্ডার হাতে আক্রান্ত হলে আমার বাড়ির লোকের মতোই এঁরাও আমায় আশ্রয় দেবেন। ওঁরাও আমাদের বিশ্বাস করতে চান। শত শত বছরের দমন-পীড়নের পর সংখ্যাগুরুর দাপটে ওঁরা যখন নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিলেন, নিজেদের চার পাশে তুলে দিয়েছিলেন একটা অদৃশ্য দেওয়াল, সেটা যেন এই ভাবেই একটু একটু করে ভেঙে যায়।
ভোরবেলা ক্লান্ত ময়দান ছেড়ে আসার আগে মনে হয়, এই প্রতিবাদ-জমায়েতে গিয়ে ঠিক কী পেলাম? উত্তর আসে— আমার প্রতিবেশীকে, আমার দেশকে চেনার পথে আজ আরও এক ধাপ এগোলাম। কম কী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy