রুক্ষ জমি। ফাইল চিত্র
কয়েক বছর আগের কথা। উষ্ণায়নের ব্যাপারে সতর্ক না হলে জলের অভাবে ঘোর দুর্দিন সারা পৃথিবীর জন্য অপেক্ষা করছে, এমনই সাবধানবাণী শুনিয়েছিলেন পরিবেশবিদেরা। তখন অনেকেই মনে মনে হেসেছিলেন।
এ-ও কি সম্ভব! যেখানে পৃথিবীর তিন ভাগই জল! তবে সেই কথা যে এত দ্রুত বাস্তবে পরিণত হবে, তা হয়তো অনেকে স্বপ্নেও ভাবেননি। বর্তমানে পৃথিবীর দশ ভাগের এক ভাগ মানুষ বছরে অন্তত তিন মাস জলকষ্টে ভুগছেন। গবেষকেরা বলছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ৫০ শতাংশ মানুষ এই সঙ্কটের সম্মুখীন হবে। তার মধ্যে প্রথম সারিতে থাকবে এশিয়া আর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশগুলি। এখনই কাতার, ইজ়রায়েল, লেবানন, ইরান, ভারত, পাকিস্তান-সহ ১৭টি দেশ তীব্র জল-সঙ্কটের সম্মুখীন। আরও ২৭টি দেশ সেই সঙ্কটের সীমানায় দাঁড়িয়ে।
জল-সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ উষ্ণায়ন। বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য জলবায়ুর পরিবর্তন ও বৃষ্টিপাতের তারতম্যের বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল অনেক আগে থেকেই সচেতন। বিভিন্ন ‘গ্রিনহাউস’ গ্যাসের ক্ষতিকারক দিক এবং সেগুলির নির্গমন হ্রাস করার বিষয়ে শিল্পোন্নত দেশগুলিকে এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিতেও বলা হয়। কারণ, তারাই উষ্ণায়নের মূল ভাগীদার। কিন্তু দেশগুলি একে অপরের দিকে দায় ঠেলে দিয়ে দায়মুক্ত হতেই ব্যস্ত। তাতে কাজের কাজ যে বিশেষ হয়নি, ক্রমাগত জলবায়ুর খামখেয়ালিপনাই তার প্রমাণ। ফলে, সারা ইউরোপ আজ চরম উষ্ণায়নের কবলে।
আমাদের দেশও প্রবল ভাবে উষ্ণায়নে প্রভাবিত। এক দিকে আমাদের রাজ্যের একাংশে যখন বৃষ্টির ঘাটতি চলছে, তখন আসাম, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মহারাষ্ট্র ভাসছে বন্যায়। বাংলাদেশ, মায়ানমার, নেপালও বন্যার কবলে। আবার, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গ বন্যায় ভেসে গেলেও দক্ষিণবঙ্গে খরা পরিস্থিতি। ফলে, বিভিন্ন রাজ্যকে জলের অপচয় বন্ধ করতে মাথাপিছু জলের ব্যবহার বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্ত
নিতে হচ্ছে।
প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা আগেও ছিল। তবে এত প্রকট নয়। এর কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা মূলত ‘গ্রিনহাউস’ গ্যাসের প্রভাবে পরিবেশের উষ্ণতা বৃদ্ধিকেই দায়ী করছেন। উষ্ণায়নের কুপ্রভাবে বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর ক্রমপরিবর্তন ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে জলবায়ুর নিয়ন্ত্রক। এখনই ‘গ্রিনহাউস’ গ্যাস নির্গমনে রাশ টানা এবং একই সঙ্গে উৎপন্ন গ্যাস শোষণে উপযুক্ত ব্যবস্থা না করা হলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা।
পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা অতটা খারাপ না হলেও চাষের প্রয়োজনীয় জল-সহ পানীয় জলের সঙ্কট ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। অনেক নদীতে জল নেই। কুয়ো, টিউবওয়েল, এমনকি, অনেক সাব-মার্সিবল মাম্পেও জল পাওয়া যাচ্ছে না। ভরসা বলতে মূলত খাল ও বড় বড় বাঁধের সামান্য জল। অনেক পরিবারকে এক-দেড় কিলোমিটার দূর থেকে সংগ্রহ করতে হয় পানীয় জল। আর চেন্নাইয়ে যে ধরনের জলসঙ্কট শুরু হয়েছে, আগামী দিনে এ রাজ্যে যে তেমন হবে না, কে বলতে পারে!
আশার কথা, আসন্ন বিপদের প্রেক্ষিতে সচেতনতায় উদ্যোগী হচ্ছেন মানুষজন। মিছিল-মিটিং চলছে। হচ্ছে সচেতনতা শিবির। গোটা রাজ্যে গত ১২ জুলাই ‘সেভ ওয়াটার, সেভ লাইফ’ দিবস পালিত হয়েছে। ১ অগস্ট পালিত হয়েছে ‘সেভ গ্রিন, স্টে ক্লিন’ দিবসও। এ ছাড়া, ফি বছর ১৪-২০ জুলাই অরণ্য সপ্তাহে লক্ষ লক্ষ চারাগাছ রোপণ করা হয়। এ বছরে জল-সঙ্কট ও খরা পরিস্থিতিতে সেই সব কার্যক্রম আরও বেশি করে চোখে পড়েছে।
৫ জুন ‘আন্তর্জাতিক পরিবেশ দিবস’ থেকে চালু হয়েছে বৃক্ষরোপণের কর্মসূচি। বিভিন্ন ক্লাব, স্কুল, কলেজ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তরফে হাজার হাজার চারাগাছ বিলি হয়েছে, পোঁতা হয়েছে। কিন্তু শুধু গাছ লাগালেই হবে না। সেগুলি যাতে ঠিকমতো পরিচর্যায় বেড়ে উঠতে পারে, সে দিকেও নজর দেওয়া দরকার।
বন দফতর চারা বিলি করে। ১০০ দিনের কাজে চারা তৈরি করে লাগানো হয়। এক বছর পরে, সেই চারার অবস্থা সম্পর্কে রিপোর্ট তৈরি করলে জীবিত গাছের প্রকৃত হিসেব পাওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে অহেতুক বৃক্ষনিধন বন্ধ করতে হবে। বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার বিস্তীর্ণ জঙ্গলের দিকে তাকালে বোঝা যায়, কী ভাবে গাছ বিলুপ্ত হচ্ছে।
পাশাপাশি, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ ও বৃষ্টির জল ধরে রাখার জন্য ছোট বড় জলাধারগুলির যথাযথ সংস্কারের ব্যবস্থা করা দরকার। বাড়াতে হবে জলের পুনর্ব্যবহার। ‘ওয়াটার শেড’ বা জল বিভাজিকার উন্নতি ঘটিয়ে জল ধরে রাখার ব্যবস্থার উন্নতি করার সঙ্গে সঙ্গে পর্যাপ্ত বৃক্ষরোপণ এবং তার সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে উষ্ণায়নের বিপদ কমানো যেতে পারে।
মনে রাখা দরকার, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ মানুষের দেশ ভারতবর্ষে ব্যবহারযোগ্য জলের পরিমাণ মাত্র চার শতাংশ। জল সংরক্ষণের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলির মধ্যে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতার কথা ভাবছে বলে জানা গিয়েছে। একই রকম প্রতিযোগিতার কথা ভাবা যেতে পারে জেলা, ব্লক, এমনকি, পঞ্চায়েত স্তরেও। তৃণমূল স্তর থেকে এই ধরনের প্রচেষ্টা সাফল্য পেলে তা সামগ্রিক ভাবে জলসঙ্কট কাটাতে পারবে। আন্তর্জাতিক স্তরে ‘গ্রিনহাউস’ গ্যাসের নির্গমন কমাতে যেমন সহমতের ভিত্তিতে আইন করা দরকার, তেমনই জল সংরক্ষণ, জলের অপচয় বন্ধ করা, গাছ লাগিয়ে তাকে যত্নে বড় করা—প্রতিটি নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য হওয়া উচিত।
লেখক বাঁকুড়ার সাহিত্যকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy