গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
যে কোনও শিশু জন্মের পর প্রথম ঘণ্টাকে বলা হয় ‘গোল্ডেন আওয়ার’। গর্ভের উষ্ণতা থেকে পৃথিবীর বুকে আসার পর সে তার বাবা-মা উভয়ের সস্নেহ স্পর্শে অভিষিক্ত হবে, এর চেয়ে ভাল দিক আর কিছুই হতে পারে না। প্রসবের সময় ‘লেবার রুমে’ স্বামী বা পরিবারের নিকট আত্মীয়ের উপস্থিতি শুধু অন্তঃসত্ত্বার শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গেই জড়িত নয়, নবাগত শিশুর জন্যও ভাল। তাই সদর্থক ভাবনায় রাজ্যের নতুন ‘প্রসবসাথী’কে সাধুবাদ জানাতেই হয়।
কী এই ‘প্রসবসাথী’? নতুন নিয়মে এ বার থেকে প্রসবের সময় প্রসূতির সঙ্গে থাকতে পারবেন তাঁর মা কিংবা স্বামী। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের নতুন নির্দেশিকায় প্রসব সংক্রান্ত নিয়মের বৈপ্লবিক পরিবর্তন হতে চলেছে। এত দিন বিদেশে এবং আমাদের রাজ্যের কিছু বেসরকারি হাসপাতালে এই সুবিধা মিলত। এ বার থেকে রাজ্য সরকারের হাসপাতাল, মাতৃসদন, এমনকি, জেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতেও এই সুবিধা মিলবে। তবে ‘সিজারিয়ান ডেলিভারি’র ক্ষেত্রে এই সুবিধা মিলবে না বলেই প্রশাসনিক সূত্রে জানানো হয়েছে।
প্রসবের সময় আশা-আশঙ্কার দোলাচলে ভোগেন নতুন মায়েরা। সেই সময় শারীরিক দেখভালের মতোই মানসিক জোর প্রয়োজন হয়। মা বা মাতৃস্থানীয়া কেউ কিংবা স্বামীকে পাশে চান অন্তঃসত্ত্বা মহিলারা। এত দিন লেবার রুমে চিকিৎসক, নার্সরা ছাড়া কাউকে সঙ্গে পেতেন না প্রসূতিরা। এ বার সেই নিয়ম বদলের পালা। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর জানিয়েছে, প্রসব বেদনা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে শুরু করে প্রসবের সময়েও লেবার রুমে উপস্থিত থাকবেন অন্তঃসত্ত্বা নারীর নিকট আত্মীয়। মা কিংবা মাতৃস্থানীয়া কোনও এক জন থাকতে পারবেন সঙ্গে। তবে প্রসূতি যদি চান লেবার রুমে তাঁর স্বামীও থাকতে পারবেন।
অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রসবের সময় একটি মেয়ের কাছে সব থেকে বেশি ভরসার জায়গা তাঁর পরিবার, বিশেষ করে তাঁর মা কিংবা স্বামী। তাই লেবার রুমে মায়ের বা স্বামীর উপস্থিতি প্রসূতির মনের জোর বাড়াবে। পাশাপাশি, ‘নর্ম্যাল ডেলিভারি’র সময় প্রসূতিকে বিশেষ একটি পজিশনে রাখতে হয়, যাতে স্বাভাবিক ভাবে প্রসব করতে পারেন প্রসূতি। এর জন্য প্রসূতিকে ধরে রাখার প্রয়োজন পড়ে। লেবার রুমে থাকা সেই সঙ্গী এখন থেকে কাজটি করবেন। প্রসবের আগে প্রসূতিকে হাঁটানোর প্রয়োজন হয়। সেই সময় তাঁকে সাহায্য করবেন ‘প্রসবসাথী’। প্রসবের পরেও সদ্যোজাত ও মায়ের খেয়াল রাখবেন ওই ‘প্রসবসাথী’। তাঁদের শারীরিক কোনও অসুবিধা হলে তা দ্রুত চিকিৎসক ও নার্সদের জানাতে পারবেন তিনি। ‘প্রসবসাথী’-দের বিশেষ পরিচয়পত্র দেওয়া হবে। যা দেখিয়ে তিনি নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে বা হাসপাতালে ঢুকতে পারবেন। প্রসূতির সঙ্গেই থাকবেন তিনি।
সব মিলিয়ে ‘প্রসবসাথী’ নিঃসন্দেহে একটি মানবিক উদ্যোগ। কিন্তু এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত করতে গেলে প্রয়োজন বেশ কিছু নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও পরিকাঠামোগত উন্নয়ন। সরকারি হাসপাতাল বা মাতৃসদনগুলিতে সাধারণত একটিমাত্র প্রসবঘর বা লেবার রুম থাকে। সেখানে রোগীর চাপ বেশি হলে এক সঙ্গে একাধিক রোগীকে নিয়ে যাওয়া হয়। কোনও দিন তো জনা পনেরো প্রসূতিকে একসঙ্গে লেবার রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। এ বার যদি গর্ভবতীদের পরিবার বা স্বামীরাও সেখানে থাকেন, তা হলে নারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করা অসম্ভব হবে। এই বিষয়টি কী ভাবে সরকারি হাসপাতালে সম্ভব, তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ রয়েছে। সন্তান প্রসব করা প্রসূতির জন্য বেশ ধকলের। আর এই সময় সেখানে যদি অন্য পরিবারের সদস্য বা বিশেষত পুরুষ সদস্য সেখানে উপস্থিত থাকেন, তা হলে তা প্রসূতির মানসিক উদ্বেগ বাড়িয়ে হিতে বিপরীত ঘটাতে পারে। তাই প্রশ্ন থাকছে, পরিকাঠামোগত দিক থেকে আমরা কতটা প্রস্তুত?
পরিকাঠামোর অভাবে রাজ্যের জেলা হাসপাতাল, স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে অনেক সময় প্রসূতির তুলনায় বেডের সংখ্যা কম হয়। একই বেডে দেখা যায় একাধিক প্রসূতি একসঙ্গে রয়েছেন। এর উপর যদি ‘প্রসবসাথী’রা তাঁদের সঙ্গে থাকেন, তা হলে স্থান সঙ্কুলান হবে কী ভাবে? হাসপাতাল তখন মানসিক চাপের স্থান হয়ে যাবে না তো?
পরিকাঠামোর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল প্রশিক্ষণ। বিদেশে যেখানে প্রসূতির সঙ্গে স্বামী বা সঙ্গীকে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়, সেখানে গর্ভাবস্থার প্রতিটি ধাপে নারী-পুরুষ উভয়কেই গোটা প্রক্রিয়াটির বিষয়ে সম্যক ধারণা তৈরি করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিছু হাসপাতালে তো হবু বাবা-মায়ের জন্য রীতিমতো ক্লাসের বন্দোবস্ত থাকে, যাতে প্রসূতির সঙ্গী প্রসবকালে ও গর্ভাবস্থায় সঠিক সহায়তা করতে পারে। কিন্তু আমাদের এখানে এই বিষয়ে কোনও ভাবনা সরকারের রয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। প্রশিক্ষণের অভাবে ‘প্রসবসাথী’ কোনও ভাবে অবাঞ্ছিত বিপদ ডেকে আনবেন কি না, তা নিয়েও ভাবনার অবকাশ রয়েছে।
প্রশিক্ষণ জরুরি, কারণ রাজ্য সরকার স্বামীর পাশাপাশি প্রসূতির মা বা নিকট আত্মীয়াকেও সেখানে থাকার অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু সবার আগে পরিবারের সেই প্রবীণাকে বোঝাতে হবে যে, গর্ভাবস্থা ও প্রসবপদ্ধতি সব নারীর ক্ষেত্রে এক না-ও হতে পারে। হয়তো দেখা গেল নর্ম্যাল ডেলিভারি করাতে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবে ডেলিভারি না-হওয়ায় ‘ফরসেপ’ ব্যবহার করতে হচ্ছে। অনেক প্রবীণ মানুষের ধারণা, এতে শিশুর মাথায় চোট লাগতে পারে। অনেকের প্রসববেদনা (লেবার পেন) উঠতে সময় লাগে। তা নিয়েও জটিলতা দেখা দেয়। বা ব্যথাহীন লেবার কী ভাবে সম্ভব, তা নিয়ে ধারণা না থাকলেও জটিলতা বাড়ে। এই পরিস্থিতিতে যিনি প্রসূতির সঙ্গী হবেন, তাঁকে আগে থেকে সঠিক প্রশিক্ষণ না দেওয়া হলে গোটা প্রক্রিয়ায় সরকারের সদিচ্ছা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আদর্শ পরিকাঠামো আর যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়া লেবাররুমে পরিবারের সঙ্গীদের প্রবেশাধিকার দিলে সমস্যার আশঙ্কা কিন্তু থেকে যাচ্ছে।
(লেখক প্রসূতি বিশেষজ্ঞ। মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy