প্রতীকী ছবি।
সমগ্র মনুষ্যজাতির প্রিয়তম দুটো শব্দের মধ্যে ‘ক্ষমতা’ আর ‘কেচ্ছা’ শব্দ দুটোও যে পড়ে, তা তো আমরা ইতিহাস বই পড়লেই জানতে পারি। কী ভীষণ ভিন্নধর্মী দুটো শব্দ। প্রথম শব্দটার অভিজ্ঞতা থাকলে মানুষ তা যতটা বুক বাজিয়ে প্রকাশ করে, দ্বিতীয়টার ক্ষেত্রে ঠিক উল্টো। কেচ্ছার কথা বুক ফুলিয়ে স্বীকার করে নিয়েছে, এমন প্রাণী মেলা দুষ্কর।
অথচ, এমন বিপরীত চুড়োয় দাঁড়িয়ে থাকা দুটো শব্দ শুনলেই সমস্ত দো-পেয়ের মস্তিষ্ক লকলক করে ওঠে। দুটো শব্দকে ঘিরেই যে সমস্ত আখ্যান মিথমিথিয়ে আছে, সেটা শুনতেই যখন ‘লালজ আহা লপলপা’, তখন তার অভিজ্ঞতা প্রকাণ্ড মস্তি-পূর্ণ হবেই, এ বুঝতে পারা আর এমন কী শক্ত ব্যাপার! তার পর ক্ষমতা আর কেচ্ছা— এই দুটো এক সঙ্গে মিলে গেলে তো আর কথাই নেই। মানুষ সব ফেলে আগে ওই দিকেই ছুটবে।
তা, এই ক্ষমতাবান কারা? যারা দেশটা চালায়। দেশটা কারা চালায়? না, রাজনীতিকেরা। এই বার যে সমস্ত পাঠকের বুদ্ধিদীপ্ত চোখের কথা ভেবে এই লেখা, তাঁরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গিয়েছেন যে নামবিশেষ্য ব্যবহার না করেও কোন দিকে এগোতে চাইছি? আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন একেবারে।
এর পিছনের কারণটাও যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। যাহা কিছু পাইনি, তাহাই যে সাঙ্ঘাতিক ‘উরিব্বাস’ নিয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে, এটা মনে না করাটাই বরং অস্বাভাবিক। আমরা তো আর লামা বা শক্তিমান নই যে কুণ্ডলিনী জাগিয়ে চরমতম শান্তির দেশে বিরাজমান হয়ে, ওম মণিপদ্মে হুমকি দিয়ে— ‘ঠান্ডা হয়ে বসে থাক, ওটা ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, তোর এই নোংরা ঘিনঘিনে কৌতূহলটা তোকে যতই উদ্দীপক বাতাস দিক, সেটা ঠিক নয়’ বলব। আমরা হলাম গিয়ে সাধারণ মানুষ। তাই উপরের দুটো শব্দ নিয়ে যুগ-যুগ ধরে চলে আসা একটা পরিষ্কার ধারণাও আমাদের আছে।
আরও পড়ুন: ডাকের বাক্স খালিই, আর আসে না চিঠি
‘ক্ষমতা’ মানে হল, যেটা ফলিয়ে হাসপাতালে ভিজিটিং আওয়ার্সের পরেও জমিয়ে আড্ডা নামানো যায় (আমিও নামাই)। এবং ‘কেচ্ছা’ মানে হল সেটা, যেটা কিনা বেজায় ‘উম্যাগো ছিঃ ছিঃ’! কেচ্ছা যাঁরা গায়ে মাখছেন, তাঁরাও সেটা দিব্যি জানেন। এ বার যোগদানকারীরাই যেখানে প্রথম হতে চান না, বিচারকেরাই বা সেখানে ‘ফাটাফাটি’ বলেন কী ভাবে! একটা চক্ষুলজ্জা তো আছে, না কি! কিন্তু এর পিছনেও কি কোনও কারণ আছে, বেণীমাধব? আলবাত আছে। নিশ্চয়ই আছে।
প্রথমত, সাধারণ মানুষ হওয়ার সুবাদে এই দুটো জিনিসই সাধারণত আয়ত্তের বাইরের একটা আশ্চর্য বস্তু বলেই আমরা মনে করি। আর তাই ক্লাসের মনিটর থেকে কলেজের সিআর হয়ে পাড়ার পুজো কমিটির সেক্রেটারি হওয়ার দিকে আমাদের এই সহজাত প্রবৃত্তি। আর সেটা না পারলে যারা সেটা পেরেছে, তাদের কাছাকাছি থাকার এই অপূর্ব চেষ্টা। এই সমস্ত কিছুর মাধ্যমে প্রথমটা আমরা বহু চেষ্টায় যদিও বা কিছুটা আয়ত্ত করতে পারি, দ্বিতীয়টার সাহস আমাদের নেই। থাকে না। হয় না। এ দিকে আবার যাহা কিছু গূহ্য, তাহাই চূড়ান্ত ‘উলালা’— এ বিষয়েও আমরা নিশ্চিত। ওরা পারছে, পাচ্ছে কিন্তু আমরা পাচ্ছি না, আমরা পারছি না— এ জিনিস ঈর্ষার উদ্রেক করতে বাধ্য। তাই যখন এই দুটোর সমাপতন এক সঙ্গে ঘটে, তখন আটকায় কার সাধ্যি রে ভাই! সে সব ভাবতে বসলে রাতে ঘুম উড়ে যায়— কী সেই প্রক্রিয়া, যাতে করে এমন দু’টো দারুণ পদ এসে পড়ে এক প্লেটে— ক্ষমতা এবং কেচ্ছা!
আরও পড়ুন: কেজরীওয়ালের বাড়ি থেকে তাজা কার্তুজ-সহ গ্রেফতার এক
এই বার যদি যুক্তি খাড়া করা হয়— ‘তাদের তো একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে রে ভাই!’ তখন তার উত্তর হল— ‘তো? আমি কী বলেছিলাম নাকি, যা গিয়ে ক্ষমতা কর, বিখ্যাত হ! হয়েছ যখন, যখন এত দিন লাইমলাইট, যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্ক করার সুবিধে, লাইনে দাঁড়ানো এড়িয়ে যেতে পেরেছ, কই— তখন তো ‘ব্যক্তিগত’ বলে কিছু আসেনি! এখন ধরা খেয়ে বাকিটা ব্যক্তিগতের ঢাল!’
অতএব, আজ্ঞে না। এখন তুমি থেকে শুরু করে তোমার বেডরুম সব-সব পাবলিক। বলা হয়, একটা মানুষের সঙ্গে সবচেয়ে নিষ্ঠুর যে কাজটা করা যায় সেটা হল তাকে তার মৃত্যুর ঠিক সময়টা জানিয়ে দেওয়া। ফলে, মানুষটার মনের ভিতর সারাটা ক্ষণ চলতে থাকে— এই তো আর দু’দিন! এই শেষ বার খেলাম। এই শেষ বার আঁচালাম। এই নিষ্ঠুরতাকেও যখন আমরা ক্যামেরার চালুনিতে ছেঁকে উপভোগ করার আগে সাড়ে তিন বারের বেশি ভাবিনি, সেখানে আবার কেচ্ছার খুশবু! তা-ও ক্ষমতাবান কোনও নারী-পুরুষের! একে আমি তোমাদের ক্ষমতাকে ঈর্ষা করি, তার মধ্যে কি না তুমি ‘কেচ্ছা’টাও পারো! আলতো করে ছেড়ে দেব ভেবেছ?
এ বার তবে ব্যক্তিগত ঘরদোর, কলতলা, সংসার, প্রেম সমস্ত কিছু আমার। আমাদের। আমরা গল্পগুলো টিপেটুপে দেখব, পাঁচ কানে শুনব, তার পর যাচাই করে দেখব। আমার সমস্ত রসালো কল্পনা তোমার গল্পের সঙ্গে জুড়ে মনের খোরাক মেটাব। এক বারও ভাবব না, কেচ্ছা-সুবাসিত মানুষগুলির আশেপাশের মানুষগুলোর কথা। প্রিয়জনের কথা। ব্যর্থতার কথা। হতাশার কথা। অত্ত সব আবেগপ্রবণ হয়ে ভাবতে বয়েই গ্যাছে! যখন তোমার ক্ষমতার সুবিধে নিতে তারা পিছপা হয়নি, তখন তোমাদের কেচ্ছার ভাগের দায়টাই বা তারা নেবে না কেন? এ হল গিয়ে ফুল প্যাকেজ। ক্ষমতার সুবিধা এবং কেচ্ছার দায়ভার। এখন কোনটা ‘কেচ্ছা’ কোনটা নয়, বা ‘কেচ্ছা’ শব্দটা যে কোনও অনুভূতির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া অশ্লীলতার পর্যায়ে পড়ে কি না, কোনটা শোভন আর কোনটা অশোভন— সে সব তোমরা বুদ্ধিমান-দার্শনিক লোকেরা ভাবো। আমরা হলাম গিয়ে ম্যাঙ্গো-পিপল, যাকে বলে আম-আদমি— গাছেরও খাব, আঁটিও কুড়োব।
ইন্টারনেটে ‘পলিটিক্স অ্যান্ড সেক্সুয়াল স্ক্যান্ডালস’ লিখে সার্চ দিলে চোদ্দো কোটি লিঙ্ক পাবেন। সতেরো কোটি গল্প পাবেন। বিশ্ব কাঁপানো তাবড় নাম সেথায় উপস্থিত। কেউ কেউ অপরাধীও বটে। তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু যাঁরা ধরুন সে সব কিছু না করে সকলের চোখের সামনে যা প্রাণ চেয়েছে করেছেন এবং তাঁদের এতটাই ধক যে, সেটা সকলের মুখের উপর বলেও দিয়েছেন— তাঁদেরও কি আপনি নামাতে চাইবেন মর্যাল মঞ্চে? এই আপনিই তো আবার সে দিন ‘পরকীয়া অপরাধ নয়’ বলে আদালতের ঘোষণার পরে প্রবল হুল্লোড়ে মাতলেন না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy