Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ২

‘আমি ওই গাছটা হতে চেয়েছি’

‘যেন আমরা অদ্ভুত কোনও জন্তু। কেউ একটু ভাল করে কথা বলেনি কখনও। তাই যখন দেখতাম হদ্দ গরিব বাচ্চাগুলো স্কুলে যেতে পারছে না, ভাল করে খেতে পাচ্ছে না, নোংরা মেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সহ্য করতে পারতাম না। তাই কেমন একটা ঝোঁকের মাথায় শুরু করে দিলাম।’ই  ট-পাতা গলিটায় পাশাপাশি দু’জন লোক হাঁটতে পারবে না। সাপের মতো এঁকেবেঁকে যাওয়া সেই গলি দিয়ে মিনিট সাতেক ঢোকার পর ডান দিকে একটা ভাঙা কাঠের দরজা। ঠেললেই ছোট উঠোন, একপাশে টিউবকল।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৫ ০০:২০
Share: Save:

ই  ট-পাতা গলিটায় পাশাপাশি দু’জন লোক হাঁটতে পারবে না। সাপের মতো এঁকেবেঁকে যাওয়া সেই গলি দিয়ে মিনিট সাতেক ঢোকার পর ডান দিকে একটা ভাঙা কাঠের দরজা। ঠেললেই ছোট উঠোন, একপাশে টিউবকল। উঠোন ঘিরে তিন দিকে তিনটে এক তলা টালির-ছাদওয়ালা মলিন ঘর, তাতে এক চিলতে করে দালান। একটা দালানের ধার ঘেঁষে বৃদ্ধ-অসুস্থ মুন্না হিজড়ে শুয়ে আছেন, তাঁর কাঠের লাঠিটা এক ধারে রাখা। পাশে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে গুরুমা দীপা হিজড়ে। সাদা চেক কাটা লুঙ্গি, সাদা গেঞ্জি। সাদা সুতির ওড়নায় মাথায় ঘোমটা দেওয়া। ওড়নার বাকিটা ঊর্ধ্বাঙ্গে জড়ানো। দু’হাতের পাতায় গাঢ় মেহেন্দি। নিজে বলেন, তাঁর বয়স পঞ্চাশ। মুখের চামড়া এখনও টানটান, উজ্জ্বল। চেহারায় লাবণ্য আর ব্যক্তিত্ব।

দালানের উল্টো দিকে কোনাকুনি বিদ্যুত্‌হীন টালির চালের ঘরে ইটের মেঝেতে গোটা তিরিশেক খুদে বসে। বয়স দুই থেকে পাঁচ। রঙচটা দেওয়ালে লাগানো ব্ল্যাকবোর্ডে বড় বড় করে চক দিয়ে অ-আ-ক-খ লেখা। একটা ছোট লাঠি অক্ষরগুলোর উপর চেপে ধরে জোরে জোরে উচ্চারণ করছেন দিদিমণি জারিনা বিবি, সমস্বরে তা আওড়াচ্ছে পড়ুয়ারা। ঘরের দরজার বাইরে স্টোভ ধরিয়েছেন আজনুরা বিবি। খিচুড়ি হবে, সঙ্গে ডিমসেদ্ধ। পড়া শেষ হলে বাচ্চারা দুপুরের খাওয়া খেয়ে বাড়ি ফিরবে। দীপা মাঝে মাঝে স্টিলের পিকদানিটায় পিক ফেলছেন।

হাওড়ার সলপ মোড়ের কাছে বাঁকড়া কবরপাড়া এলাকার ঘিঞ্জি বস্তি এলাকাটায় প্রাক্-প্রাথমিক বিদ্যালয় বলতে এই একটি। নিজের বসতবাড়ির একাংশে ১৯৯৫ সালে এই স্কুল চালু করেন দীপা। তাঁর ও তাঁর শিষ্যাদের দৈনিক আয়ের কিছুটা করে জমিয়েই স্কুলের খরচ চলেছে। গত বছর থেকে মিড-ডে মিল দিতে শুরু করেছে স্থানীয় পঞ্চায়েত। পড়ুয়ার সংখ্যা দশ থেকে বেড়ে এখন বত্রিশ। পিছিয়ে পড়া পরিবারের শিশু সব। সোম থেকে শনি ন’টা থেকে বারোটা স্কুলে বাংলা-ইংরাজি-ছড়া-নামতা শেখে, উঠোনে খেলা করে, তার পর খেয়েদেয়ে বাড়ি যায়। পড়ুয়াদের বই, খাতা, পেনসিল, স্লেট, চক সব কিছুর দায়িত্ব এখনও দীপার দলের। স্কুলের দিদিমণি জারিনা বিবিকে অবশ্য কোনও দিন মাইনে দিতে হয়নি। এলাকায় সমাজসেবার কাজ করা গৃহবধূ জারিনা নিজের ইচ্ছায় দায়িত্ব নিয়েছেন। বিনা মাইনের কাজ বলে কোনও ফাঁকি নেই, দশ বছরে কামাই করেছেন হাতে গুনে।

সচ্ছল শিক্ষিত পরিবারের জারিনার সুযোগবঞ্চিত শ্রেণির জন্য কিছু করার তাগিদ আসতে পারে, কিন্তু দীপা, অপর্ণা, লিলি, সোম, রিনা, চন্দ্রমুখীদের তো সে দলে ফেলা যায় না। যুক্তি বলে, মানুষ কোনও জায়গা থেকে ভালবাসা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা পেলে তার প্রতিদানে কিছু করতে চায়। কিন্তু সমাজের মূলস্রোতের সব সুযোগসুবিধা থেকে হিজড়েরা এখনও শতযোজন দূরে। তাঁরা কেন একবেলা খেয়ে নিজেদের অতি কষ্টের রোজগার অনায়াসে দিয়ে দিতে যাবেন কিছু অনাত্মীয় শিশুর জন্য স্কুল চালাতে? কেন নিজেদের অসুবিধা সত্ত্বেও আস্তানার অনেকটা দিয়ে দেবেন স্কুলের জন্য?

‘আসলে নিজের বাপ-মা-ই আমাদের ফেলাছড়া করেছে। আজ পর্যন্ত কারও চোখে একটু শ্রদ্ধা দেখলাম না। শুধু গালাগাল, মস্করা। যেন আমরা অদ্ভুত কোনও জন্তু। কেউ একটু ভাল করে কথা বলেনি কখনও। তাই যখন দেখতাম পাড়ার হদ্দ গরিব বাচ্চাগুলো স্কুলে যেতে পারছে না, অক্ষরপরিচিতি হচ্ছে না, ভাল করে খেতে পারছে না, সারা দিন গলিতে নোংরা মেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এই অযত্নটা, অবহেলাটা সহ্য করতে পারতাম না। তাই কেমন একটা ঝোঁকের মাথায় শুরু করে দিলাম।’ গলা ভেঙে যাচ্ছিল দীপার।

সালকিয়ার সম্ভ্রান্ত এক বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে জন্ম দীপার। শরীরে ও মনে ‘অন্য রকম’ হওয়ায় বাড়িতে গোড়া থেকেই নির্যাতন শুরু হয়েছিল। সহ্য করতে না পেরে তেরো বছর বয়সে কবরপাড়ায় এক হিজড়ে গুরুমা শান্তিদেবীর কাছে নিজেই চলে আসেন। শুরু হয় নতুন জীবনের। শান্তি হিজড়ের শিষ্যা হিসেবে থাকতে থাকতেই সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে জুঅলজিতে অনার্স পাস করেন। তার পর পুরোদস্তুর হিজড়ে-পরম্পরা মেনে কাজ শুরু। ১৯৯৫ সালে শান্তিদেবী মারা যান। গুরুমা হন দীপা। তত দিনে একে একে ন’জন শিষ্যা হয়েছেন তাঁর। পিকদানিতে আরও এক বার পিক ফেলে দীপা বলতে থাকেন, ‘অনেকের ধারণা, হিজড়েরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাচ্চা চুরি করে আনে। ওরা জানে না যে, চুরি করার দরকার নেই। বাড়ির লোকেরাই লোকলজ্জা থেকে বাঁচতে আমাদের ডেকে বাচ্চা দিয়ে দেয়। কিংবা একটু বড় হওয়ার পর বাড়ির অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বাচ্চাগুলো একটু শান্তির জন্য নিজেরাই এর ওর কাছ থেকে খবর নিয়ে হিজড়েদের কাছে পালিয়ে আসে। এই দু’রকম ভাবেই আমি আমার শিষ্যাদের পেয়েছি। এঁদের মধ্যে দু’এক জন তো উচ্চশিক্ষিত।’’

তাঁর কথা থামিয়ে রিনা বলে ওঠেন, ‘শুধু হিজড়ে বাচ্চা হলে লোকে আমাদের দিয়ে দেয় তা নয়, সুস্থসবল ছেলে বা মেয়েকেও অভাবের তাড়নায় মানুষ করতে না পেরে আমাদের কত বার দিয়ে দিয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার মল্লিকপুরের এক বাড়ি থেকে তিন মাসের নাগমাকে আমাদের হাতে দিয়েছিল ওর মা আর দাদু। বাপটা ছিল নেশাখোর। চার-চারটে মেয়ে মানুষ করতে মা হিমশিম। ফুটফুটে মেয়ে এখন আমাদের মধ্যেই বেড়ে উঠছে। স্কুলে পড়ছে। ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছে। ওর বয়স এখন চার। হাওড়া পিলখানার দুই পরিবার এ ভাবেই দিয়েছিল রুবিনা আর রাহুলকে। রুবিনা এ বার মাধ্যমিক দেবে, রাহুল ক্লাস এইটে পড়ে। আরও শুনবেন? মাস দু’এক আগে বিডন স্ট্রিটের এক মুখার্জি পরিবারের শ্বশুর, শাশুড়ি আর বর তাঁদের বাড়ির নতুন বউকে নিয়ে এসে হাজির। বউ নাকি হিজড়ে! বাড়ি থেকে লুকিয়ে বিয়ে দিয়েছে। তাঁরা বউকে আমাদের কাছে দিয়ে দেবেনই! সেই মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে। বুঝুন! বকেঝকে, পুলিশের ভয় দেখিয়ে ফেরত পাঠানোর পরও তিন বার ঘুরে এসেছে। এই হল আপনাদের ভদ্দরলোকের সমাজ!’

দশ বছর আগে নিজের বয়স কম ছিল। কাজও তেমন জমেনি। ন’জন শিষ্যাও তখন অনেক ছোট। তাদের খরচ চালাতে হত। এই রকম অবস্থায় স্কুল শুরু করার মনের জোর কোথা থেকে পেলেন? মেঝেতে একগোছা চুড়ি নিয়ে খেলতে বসা নাগমাকে কোলে তুলে নিয়ে দীপা বলেন, ‘এক রকম লতা আছে জানেন, যা ছিঁড়ে দলা করে বড় গাছের উপর ছুড়ে ফেলে দিলে সে ওই গাছ থেকে রস টেনে নিয়ে ডালপালা ছড়ায়, তাতে ফুল হয়, আর বড় গাছটা ধীরে ধীরে মরে যেতে থাকে। আমি ওই গাছটা হতে চেয়েছি।’

স্কুলে ছাত্রছাত্রী জোটানো কিন্তু সহজ হয়নি। হিজড়েদের রোজগারের টাকায় হিজড়েদের বাড়ির ভিতর স্কুল। তথাকথিত সাধারণ পরিবার, যত গরিব বা অসহায়ই হোক, প্রথমেই ধাক্কা খাবে। দুপুরে ভাত-আলুসেদ্ধ-ডাল আর চকলেটের লোভ দেখিয়ে অনেক কষ্টে প্রথমে পাঁচ জন পড়ুয়া জোগাড় হয়েছিল। অপর্ণা বলেন, ‘চেষ্টা করেছিলাম এলাকার মানুষের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলার, নিজের পেশার প্রতি সত্‌ থাকার। সকলের বাড়ি গিয়েছি, আমি বা আমার দলের কেউ টাকার জন্য কখনও কারও উপর জুলুম করেনি। তাই মানুষও আমাদের ভরসা করেছেন। শুভ কাজে আমাদের আশীর্বাদ নিয়েছেন। সেই ভরসা ও বিশ্বাসের জন্যই প্রথমে পাঁচটা শিশুকে স্কুলে পেয়েছিলাম। ওদের দেখে আস্তে আস্তে বাকিরা আসতে লাগল। টানা ন’বছর চেয়েচিন্তে আনা চাল-আলু দিয়েই ওদের দুপুরে খাইয়েছি।”

পাশে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন আমিনা, মনসুয়ারা, তনভিররা। স্কুল ছুটি হবে, বাচ্চাদের নিয়ে যেতে এসেছেন। হিজড়েদের স্কুলে ছেলেমেয়েকে পাঠাতে সংকোচ হয় না? হেসে জানান, দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী দীপা-অপর্ণাদের সঙ্গে সুখদুঃখের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে। হয়তো দারিদ্র সখ্য তৈরিতে সাহায্য করে। তা ছাড়া, যে সুযোগ এঁরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের দিয়েছেন, অন্য কেউ তা দেয়নি। ভাল প্লে-স্কুল বা প্রি-প্রাইমারি স্কুলে বাচ্চাকে পড়ানোর সামর্থ্য তাঁদের নেই। আশেপাশে তেমন সরকারি স্কুলও অমিল। বাড়ির পরিবেশও তথৈবচ। নিজেরাই বেশির ভাগ নিরক্ষর বা নামমাত্র শিক্ষিত। অন্তত এখানে দিনে তিন-চার ঘণ্টা শিশুগুলো একটা পরিবেশ পাচ্ছে, ভাল খেতে পাচ্ছে, বইখাতা পাচ্ছে, কিছু শিখতে পারছে, অক্ষরপরিচিতি হচ্ছে। এদের মধ্যে অনেকের হয়তো এই শেখাটুকুই সারাজীবনের সম্বল হয়ে থাকবে। পরবর্তী সময়ে আর স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হবে না।

শুনে আবার কেঁদে ফেলেছিলেন দীপা, ‘পরম্পরা আঁকড়ে থাকা ছাড়া আমাদের তো গতি নেই। অন্য কোনও কাজ করতে গেলে প্রতি পদক্ষেপে যে বিদ্রুপ জুটবে, তা নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন। কিন্তু আমার স্কুলের বাচ্চাগুলো লেখাপড়া শিখে একটু মানুষ হতে পারলে বুঝব, হিজড়েরও স্বপ্ন দেখার অধিকার আছে।’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE