মুক্তাইচণ্ডী মন্দির। ছবি: লেখক
পশ্চিম বর্ধমানের গ্রামগুলিতে যুগ যুগ ধরে বসবাস করছেন অসংখ্য জনজাতি এবং তপশিলি জাতির মানুষ। সবাই মিলে এক মিশ্র সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছেন। তাই এখানে করম পুজো, ধরম পুজো, ধৰ্ম পুজোর মতো অসংখ্য পুজো প্রথার সঙ্গে প্রচলিত অগুনতি লৌকিক দেব, দেবীর পুজো। যেমন, ওলাই চণ্ডী, মঙ্গল চণ্ডী, উরণচণ্ডী, উদ্ধার চণ্ডী, নাটাই চণ্ডী, অলকা চণ্ডী এমনকি, হাড়ি ঝি চণ্ডী অবধি আছেন। এখন অবধি প্রায় ১০৩ রকমের চণ্ডীর খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। কোথাও তিনি গ্রামদেবী, কোথাও কুলদেবী আবার কোথাও গৃহদেবী।
সাধারণত নানা রকম প্রতীকে চণ্ডী পুজো হয়— ১) খোদিত শিলা মূর্তি, ২) অ-খোদিত শিলা খণ্ড, ৩) মাটির ঢেলা, ৪) লাল ঘোড়া, ৫) বৃক্ষ পুজো, ৬) মাটির মূর্তি, ৭) ধাতু মূর্তি ইত্যাদি। আসানসোলের কাছে আছে ফুলবেরিয়া গ্রাম। গ্রামে আছে একটি নাতিউচ্চ পাহাড়। যার স্থানীয় নাম মুক্তাইচণ্ডী পাহাড়। যেখান আছে মুক্তাইচণ্ডী মন্দির। বেদ, উপনিষদ, পুরাণে কোথাও চণ্ডীদেবীর উল্লেখ নেই। তা হলে ইনি কোথা থেকে উদ্ভব হলেন ?
তখন বর্তমানের বাঙালি জাতির উদ্ভব হয়নি। সেই সময়ের প্রোটো অস্ট্রালয়েড সম্প্রদায়ের অন্যতম হচ্ছে ওরাওঁ সম্প্রদায়। আজকের বাংলার কৃষক সম্প্রদায়ের বড় অংশ এই ওরাওঁ বংশোদ্ভূত। এঁরা সম্ভবত ওড়িশা থেকে আগত এবং তখন এঁদের নাম ছিল উড্র। আজ ওঁরা হিন্দু সমাজে মিশে গিয়েছেন। এখন এরা প্রায় সবাই গৃহস্থ চাষি। তাঁদের শিকারের দেবী ছিলেন চাণ্ডী। শিকারের সময় এঁদের সঙ্গে থাকত চাণ্ডী শিলা। যখন বহিরাগত আর্যরা প্রাক-আর্য দেব, দেবীদের আর্যীকরণ শুরু করেন, তখন সৃষ্টি হয় মার্কণ্ডেয় পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ। খুব সম্ভবত ওরাওঁদের পূজিত এই চাণ্ডীদেবী পরে হয়ে যান চণ্ডীদেবী। উচ্চবর্ণের পূজিত চণ্ডীর সঙ্গে লৌকিক চণ্ডীর পুজোর অমিলই বেশি। তাই অনায়াসে মুক্তাইচণ্ডী মাতার মন্দিরে অবস্থান করেন দেবী শীতলা।
এই মন্দিরটি একটি নাতিউচ্চ টিলার উপরে অবস্থিত। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা মন্দিরটি নির্মাণ করে দিয়েছেন। তবে এখানকার চণ্ডী মূর্তিটি এবং দেবীর থানটি কিন্তু অদ্ভুত। পাহাড় কেটে তার মধ্যে প্রাচীন শিলাটি স্থাপন করা হয়েছিল কোন সে আদিম যুগে। পাহাড় কেটে করা গুহার উপরে চমৎকার ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশলে মন্দিরের ছাদটি নির্মিত। আদি শিলামূর্তিটি প্রায় ফুট দেড়েক উঁচু, তির ধনুক নিয়ে এক স্ত্রী যোদ্ধার মূর্তি। একদা মূর্তিটিতে ছয়টি ঘোড়া খোদিত ছিল, অর্থাৎ দেবী ছয় ঘোড়ায় আসীন ছিলেন। বর্তমানে মূর্তিটি মাঝখান থেকে ভেঙে গিয়েছে। ছ’টির মধ্যে এখন কেবল তিনটি ঘোড়া
দেখা যায়। তবে বর্তমানে একটি আধুনিক পাথরের মূর্তি, শিলা মূর্তির পাদদেশে স্থাপিত করা হয়েছে, দেবী চণ্ডী নাম দিয়ে।
শোনা যায়, চাণ্ডী শিলার পূজারী ছিলেন ওরাওঁদের পুরোহিত ‘পাহান’রা। অনেক পরে ব্রিটিশ জমানায় ধানবাদ জেলার অন্তর্ভুক্ত পাঁড়রা গ্রামের এক রাজবংশ এই বিস্তীর্ণ জঙ্গলভূমির রাজা হন। এঁরাই সম্ভবত তখনকার উপজাতি পাহান পুরোহিতকে সরিয়ে দিয়ে নিকটবর্তী ফুলবেরিয়া গ্রামের চক্রবর্তী উপাধির ব্রাহ্মণ সেবায়েত নিয়োগ করেন। নবকুমার চক্রবর্তী থেকে শুরু করে এখন পুজো করছেন তাঁর পঞ্চম অধস্তন পুরুষ, বর্তমানের সেবায়েত লোকনাথ চক্রবর্তী। এখানে একটি বিশাল পাথরের তৈরি বলির স্থান আছে। বলির পাথরটি এবং এর সামনে মাটিতে প্রোথিত একটি কারুকার্য করা প্রাচীন পাথরের ভগ্ন টুকরো বিস্মৃতপ্রায় ইতিহাসের দিকে আঙুল তোলে।
এখানে পুজোতে বলি হয় না, কিন্তু মানসিকের পাঁঠা বলি হয়। বলি দেন স্বয়ং পুরোহিত। নিত্যপুজো ছাড়াও, এখানকার বাৎসরিক পুজো শুরু হয় মাঘী পূর্ণিমাতে। সাত দিন ধরে চলে মুক্তাইচণ্ডী মেলা। কৃষ্ণপক্ষের চতুর্থীতে হয় হোম। প্রতি দিনই বাউল গান, কবিগানের আসর বসে। এই মন্দিরের পুরো নাম মুক্তাইচণ্ডী শক্তিপীঠ। কী জন্য একে শক্তিপীঠ বলা হয় জানতে চাইলে, একটি জনশ্রুতি শুনলাম। সতীর মৃত্যুর খবরে ক্রুদ্ধ শিব তখন সতীর দেহ নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য করছেন। সেই সময়ে নাকি সতীর নাকছাবির মুক্তোটি এখানে ছিটকে পড়ে। তাই এই জায়গাটির নাম হয়, মুক্তাইচণ্ডী শক্তিপীঠ।
মুক্তাইচণ্ডী বা চাণ্ডীদেবী আছেন। ব্রাহ্মণ পুরোহিত এবং অসংখ্য হিন্দু ভক্তরা আছেন। কিন্তু দেবীর আদি ওরাওঁ ভক্তরা আর নেই। ধারে কাছের গ্রামগুলিতে বর্তমানে নাকি এক ঘর ওরাওঁ আর বাস করেন না। ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ কী ভাবে একটি সম্প্রদায়ের দেবীকে গ্রাস করে নিতে পারে, মুক্তাইচণ্ডীর সংলগ্ন অঞ্চল তার প্রমাণ।
তথ্যসূত্র: ১) বাংলার সংস্কৃতি: লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায়। পালযুগ. গুপ্তযুগ. সেনযুগ থেকে অদ্যাবধি। নারায়ণ সামাট। ২) কৌলাল, ষষ্ঠ বর্ষ, নভেম্বর ২০১৬। বুড়ি ছুঁয়ে যাই, নবারুণ মল্লিক, ৩) বর্ধমান সীমান্তের একটি অন-আর্য দেবী: মুক্তাইচণ্ডী। অশোক দাস। ( আজকের যোধন, জুলাই-আগষ্ট, ২০০০ সংখ্যা থেকে সংগৃহীত।) ৪) আবাদভূমি, তৃতীয় বর্ষ, সপ্তম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১৬-এপ্রিল ২০১৭। ৫) সুহৃদকুমার ভৌমিক। আর্য রহস্য। ৬) আদিবাসী সমাজ ও পালপার্বণ: ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে।
দুর্গাপুরের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy