Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
strike

শর্ট কাট

কিছু জায়গায় ধর্মঘট সফল হইয়াছে দেখিয়া নেতারা শ্লাঘা অনুভব করিয়াছেন: বাম রাজনীতি তবে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হইয়া যায় নাই! যদি না-ও হইয়া থাকে, তাঁহারা সে ব্যবস্থা পাকা করিতেছেন।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২০ ০০:৪৩
Share: Save:

বামপন্থীরা যে দাবিগুলি লইয়া দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দিয়াছিলেন, তাহার সব কয়টির সহিত না হইলেও অধিকাংশের সহিতই হয়তো অনেকে একমত হইবেন। কিন্তু, কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ কি এই ধর্মঘটের ডাকের সহিত গলা মিলাইতে পারেন? বিশেষত এই পরিস্থিতিতে, যখন অতিমারি ও অর্থনৈতিক লকডাউনের জোড়া ধাক্কায় অর্থব্যবস্থা টালমাটাল? বামপন্থীরা যাঁহাদের জন্য মাসিক অর্থসাহায্যের দাবি করিতেছেন, যে পরিবারগুলির জন্য রেশনের ব্যবস্থা করিবার কথা বলিতেছেন, এই ধর্মঘট অন্য সকলের ন্যায় তাঁহাদের স্বার্থেরও পরিপন্থী নহে কি? এই প্রশ্নের একটি হাতেগরম উত্তর সম্ভব— রাষ্ট্র যাঁহাদের এতখানি বিপন্ন করিয়াছে, মাত্র এক দিনের ধর্মঘটে তাঁহাদের বিপন্নতা আর কতটুকুই বা বাড়িবে? প্রশ্ন বিপন্নতার ভগ্নাংশ বা ত্রৈরাশিকের হিসাবের নহে, প্রশ্ন অবস্থানের। যাঁহারা সর্বাধিক বিপন্ন, রাজনৈতিক লোভে তাঁহাদের বিপন্নতা বাড়াইবার সম্ভাবনাটুকু তৈরি করাও অনৈতিক। আরও একটি কথা স্পষ্ট: বামপন্থীরা এখনও সকল শ্রমকে সমান বলিয়া মানিতে পারেন নাই। তাঁহারা মূলত সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ— ছাঁটাই বন্ধ করা হইতে পেনশন বা শ্রম কোড, কোনওটিই অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের দাবি হইতে পারে না। সংগঠিত ক্ষেত্রের, তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা, অপেক্ষাকৃত অল্পসংখ্যক শ্রমিকের সনাতন ভোটব্যাঙ্কটির দিকে চাহিয়া তাঁহারা অসংগঠিত ক্ষেত্রের বিপুলসংখ্যক ও বিপন্নতম শ্রমিকের বিপদ বাড়াইলেন, এই কথাটি বাম নেতারা বা ধর্মঘটের সমর্থকেরা ভাবিয়া দেখিয়াছেন কি? কর্মসংস্থান যোজনা বা নগদ হস্তান্তরের দাবি দিয়া রাজনীতির এই খামতি ঢাকা যাইবে না— বাম রাজনীতির ইতিহাসই তাহা ঢাকিতে দিবে না।

ধর্মঘট হইল রাজনীতির ‘শর্ট কাট’— বৃহত্তর প্রশ্নটিকে তাহার প্রাপ্য গুরুত্ব না দিয়া এক দিন জনজীবন বন্ধ করিয়া বা সেই চেষ্টায় দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়াস। রাজনীতিতে ধর্মঘটের কিছু গুরুত্ব আছে— শেষ অস্ত্র হিসাবে, সীমিত পরিসরে। দেশব্যাপী ধর্মঘটের মূল বিপদ হইল, একশত চল্লিশ কোটি মানুষের— অন্তত তাহার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের— স্বার্থ কার্যত কখনও সমানুবর্তী হয় না। বামপন্থীদের এই ধর্মঘটে কাহারও স্বার্থ রক্ষিত হইল কি না, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন— কোনও ধর্মঘটের মাধ্যমে কাহারও স্বার্থরক্ষা করা যায় কি না, তাহা ভিন্নতর প্রশ্ন— কিন্তু তাঁহাদের রাজনৈতিক দৃষ্টির অপ্রসারতা এক বিপুল জনগোষ্ঠীর স্বার্থকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করিল। কিছু জায়গায় ধর্মঘট সফল হইয়াছে দেখিয়া নেতারা শ্লাঘা অনুভব করিয়াছেন: বাম রাজনীতি তবে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হইয়া যায় নাই! যদি না-ও হইয়া থাকে, তাঁহারা সে ব্যবস্থা পাকা করিতেছেন।

তাঁহারা প্রশ্ন করিতে পারেন, প্রতিবাদ তবে কোন পথে হইবে? এই প্রশ্নের বহু উত্তর সাম্প্রতিক ভারত দেখিয়াছে। জাতীয় নাগরিকপঞ্জির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য ধর্মঘটের প্রয়োজন হয় নাই— দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষের অদম্য অবস্থান বিক্ষোভে প্রতিবাদের তীব্রতা ছিল প্রশ্নাতীত। এমনকি, বামপন্থীরাই যে কৃষক বিক্ষোভ সংগঠিত করিয়াছিলেন, তাহাও রাজনৈতিক কল্পনাশক্তিতে উজ্জ্বল ছিল। গ্রামের পর গ্রাম হইতে মানুষের স্রোত মহানগরকে লক্ষ্য করিয়া হাঁটিয়া চলিয়াছে, এবং সেই মিছিলে ক্রমেই জুড়িয়া যাইতেছেন অ-কৃষিক্ষেত্রের মানুষ— রাজনৈতিক সহমর্মিতার এমন উদাহরণ স্মরণযোগ্যই বটে। বাম নেতারা সেই রাজনীতির কথা ভাবুন। ধর্মঘটকে কেন্দ্র করিয়া তাঁহারা যে প্রশ্নগুলি উত্থাপন করিয়াছেন, সেগুলি উড়াইয়া দেওয়ার নহে। কিন্তু, রাজনৈতিক লাভ ঘরে তুলিবার তাড়নায় তাঁহারা যদি অর্থনীতির প্রশ্নটিকে অবজ্ঞা করেন, তাহাতে মানুষের ক্ষতি। বিপুল ক্ষতি। শেষ অবধি পথটি রাজনৈতিক আত্মঘাতে পৌঁছায়। সেই পরিণতির সঙ্গে অবশ্য বামপন্থীরা পরিচিত।

অন্য বিষয়গুলি:

strike Lefts
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy