—ফাইল চিত্র।
মাঝেমধ্যেই যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক ধুয়ো ওঠে, তার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জীবনে হস্তক্ষেপ করার বাসনা কারও চোখ এড়ায় না। সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নীতি গ্রহণ করলে কোন জনগোষ্ঠীর ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, সে প্রসঙ্গে আগে একটি লেখায় আলোচনা করেছি (‘সবার ভালর জন্য?’, আবাপ ১২/২)। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক রাজনৈতিক বক্তব্যটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পেশ করা হয় জাতীয় স্বার্থ ও উন্নয়নের মোড়কে। দাবি করা হয়, ভারতে উন্নয়নের পথে দেশের বিপুল জনসংখ্যা এক মস্ত বাধা। প্রত্যেক দম্পতির সন্তানসংখ্যা যদি আইনত দুইয়ের বেশি না হতে দেওয়া যায়, তবে সেটা হবে উন্নয়নের পথের এই বাধা সরানোর একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। অস্বীকার করার উপায় নেই, এই অবস্থানটির সমর্থক প্রচুর, বিশেষত আর্থিক ভাবে সম্পন্ন মানুষেরা।
দেশের জনসংখ্যা আর উন্নয়নের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক কী, নেতারা সেই ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করেন না। ভারতের ক্ষেত্রে এই সম্পর্কটি কী, তা বোঝার জন্য অন্তত দু’টি প্রশ্ন করতে হবে। এক, যে দেশে টোটাল ফার্টিলিটি রেট বা টিএফআর, অর্থাৎ এক জন মহিলা তাঁর প্রজননক্ষম বয়সে গড়ে মোট যতগুলি সন্তানের জন্ম দেন, ইতিমধ্যেই ২.২৪-এ নেমে এসেছে, সেই দেশে জোর করে চাপানো ‘দুই-সন্তান নীতি’ দেশের মোট জনসংখ্যা এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারে? এবং দুই, জন্মহার হঠাৎ কমে গেলে স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদে উন্নয়নের ওপর তার কী প্রভাব পড়বে?
সন্তান নিয়ন্ত্রণের সরকারি নীতি চালু করলে ঠিক কী রকম অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে, জানার জন্য চিনের ‘এক-সন্তান নীতি’ প্রবর্তনের সময়কার রিপোর্ট পড়ে দেখতে পারেন। কিন্তু, তার চেয়েও বড় কথা হল, এই রকম একটা নীতি চালু করলে দেশের জনসংখ্যা ও তার বৃদ্ধির ওপর কী প্রভাব পড়বে? পরিবারে সন্তানসংখ্যা যদি দুই হয়, তাকে বলা হয় রিপ্লেসমেন্ট লেভেল ফার্টিলিটি— অর্থাৎ, প্রত্যেক দম্পতির পরিবর্তে তাঁদের পরের প্রজন্মে ঠিক দু’জনই থাকবে। আরও স্পষ্ট করে বললে, প্রত্যেক মহিলার পরের প্রজন্মে তাঁর এক জন মেয়ে থাকবে। প্রতিটি পরিবারে সন্তানসংখ্যা যদি ঠিক দুই করতে হয়, তা হলে দেশে টিএফআর হওয়া উচিত ২.২২ (কারণ, কিছু শিশু যে সন্তান উৎপাদনের বয়সে পৌঁছনোর আগেই মারা যাবে, তা ধরে নিতে হবে)। ২১০০ সাল নাগাদ (শিশুমৃত্যুর হার কমলে) এই টিএফআর হতে হবে ২.১১।
আমরা যদি রাতারাতি এই রিপ্লেসমেন্ট লেভেল ফার্টিলিটির হারে পৌঁছে যাই, তা হলে কী হবে? রাষ্ট্রপুঞ্জের জনসংখ্যা বিভাগ বিভিন্ন জন্মহারের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ জনসংখ্যার বিভিন্ন হিসেব কষেছে। ভারতের বর্তমান জনসংখ্যা বিপুল, কাজেই আমরা রাতারাতি রিপ্লেসমেন্ট লেভেল ফার্টিলিটিতে পৌঁছে গেলেও ২০৫০ সালে এই দেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৭০ কোটি। আর, যদি বর্তমান হারে, অর্থাৎ প্রত্যেক প্রজননক্ষম নারীর গড়ে ২.২৪ হারে সন্তানের
জন্ম হতে থাকে, তবে ২০৫০ সালে ভারতের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৭৩ কোটি। খুব একটা ফারাক নেই, দেখাই যাচ্ছে।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য যদি জোরজবরদস্তি কোনও নীতি না চাপিয়ে দেওয়া হয়, যদি সব জনগোষ্ঠীর মধ্যেই জন্মহার কমার বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তা হলেই বরং জনসংখ্যা তুলনায় কম হবে। রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসেব হল, স্বাভাবিক ভাবেই জন্মহার কমার ফলে ২০৫০ সালে ভারতের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৬৪ কোটি, আর ২১০০ সালে তা হবে ১৪৫ কোটি। অর্থাৎ, জোরজুলুম করে অবিলম্বে রিপ্লেসমেন্ট রেট ফার্টিলিটি-তে দেশকে বেঁধে দেওয়ার বদলে স্বাভাবিক ছন্দে জনসংখ্যা কমতে দিলে ২০৫০ সালে তুলনায় জনসংখ্যা কম হবে তো বটেই, ২১০০ সালে দেশের জনসংখ্যা ২০৫০-এর চেয়ে কম হবে— ভারতের জনসংখ্যা ২০৬০ সাল নাগাদ কমতে আরম্ভ করবে। কাজেই, মানবাধিকার লঙ্ঘন করে মানুষকে জন্মনিয়ন্ত্রণে বাধ্য করার বদলে স্বাভাবিক ভাবেই জনসংখ্যা কমতে দিলে লাভ।
পরের প্রশ্ন জনসংখ্যার সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক নিয়ে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে যত বেশি সংখ্যায় বাচ্চা জন্মাবে, দেশের মোট সম্পদের ওপর ততই ভাগ বাড়বে। অন্তত স্বল্পমেয়াদে তো বটেই। ভারতীয় অর্থনীতির যা অবস্থা, তাতে এমনটাও হতে পারে যে এই শিশুগুলি প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও নেট উপভোক্তাই থেকে যাবে— কারণ, তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত, ফলে উৎপাদনের সুযোগও। যে কোনও অর্থনীতিতেই নেট উপভোক্তার অনুপাত যত বাড়বে, উৎপাদনশীল বিনিয়োগের জন্য তত কম সম্পদ পড়ে থাকবে।
সমস্যা হল, গড় উপভোক্তা বলে কিছু হয় না। সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণি, এবং ভৌগোলিক অঞ্চলভেদে মানুষের উপভোগের পরিমাণ এতটাই পাল্টায় যে কোথায় কার ঘরে এই ‘বাড়তি’ বাচ্চাগুলো জন্মাচ্ছে, সেই প্রশ্নটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশবিদ্যার ক্ষেত্রে IPAT সমীকরণ একটি অতি পরিচিত তত্ত্ব— পরিবেশের ওপর জনসংখ্যা এবং তার বৃদ্ধির হার কী প্রভাব ফেলবে, এই সমীকরণ ব্যবহার করে তা হিসেব করা হয়। আমাদের আলোচনাতেও এই সমীকরণের ধারণাটি আনা যেতে পারে।
আইপ্যাট সমীকরণ বলে যে পরিবেশের ওপর জনসংখ্যার প্রভাবের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত সচ্ছলতা আর প্রযুক্তি। পরিবেশের ওপর পুনর্নবীকরণযোগ্য এবং অন্যান্য শক্তির ব্যবহারের কী প্রভাব পড়বে, তা নির্ভর করে উপভোক্তার আর্থিক সচ্ছলতার ওপর (যাঁদের হাতে পয়সা বেশি, শক্তির ব্যবহারও তাঁদের অনেক বেশি); এবং সমাজে প্রযুক্তির অগ্রগতির ওপর (পরিবেশের পক্ষে সৌরশক্তি তেলের তুলনায় অনেক কম ক্ষতিকারক)। পরিবেশের প্রশ্নে তাই সব সময়ই একটা লড়াই চলে। এক দল চায় দরিদ্র দেশগুলিতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, আর অন্য দল চায় ধনী দেশে উপভোগ নিয়ন্ত্রণ। একটা হিসেব হল, একই দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আর বাংলাদেশে দু’টি শিশু জন্মালে প্রথম জনের কার্বন ফুটপ্রিন্ট দ্বিতীয় জনের ১৬০গুণ। একই নিয়ম মেনে, দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যেও, ধনী পরিবারের উপভোগের পরিমাণ দরিদ্র পরিবারের বেশ কয়েক গুণ।
রাষ্ট্র জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নীতি গ্রহণ করলে অবধারিত ভাবে কোপ পড়ে অনগ্রসর পরিবারগুলির ওপর— কারণ, তেমন পরিবারের ওপরই জবরদস্তি করা সহজ, আর তেমন পরিবারেই সচরাচর সন্তানসংখ্যা বেশি হয়। আমার আগের লেখায় উল্লেখ করেছিলাম, গরিব, অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত, গ্রামীণ এবং সামাজিক ভাবে বিপন্ন পরিবারগুলিতে সন্তানজন্মের হার বেশি। সেই রকম পরিবারে সন্তানসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করলে দেশের মাথাপিছু গড় উপভোগের পরিমাণ খুব একটা কমবে না, কারণ এই পরিবারগুলোর উপভোগের পরিমাণ দেশে সবচেয়ে কম। কাজেই,
এই রকম পরিবারে জন্মনিয়ন্ত্রণ করে উন্নয়ন বা পরিবেশ, কোনও ক্ষেত্রেই খুব লাভ নেই। এবং, ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করলেই উন্নয়ন হবে’, এমন একবগ্গা যুক্তিও ভিত্তিহীন।
জোরজবরদস্তি সন্তানসংখ্যা বেঁধে দেওয়ার বদলে যদি সরকার এই অনগ্রসর পরিবারগুলির জন্য দারিদ্র থেকে উত্তরণের পথ তৈরি করে দেয়, তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে (বিশেষত মেয়েদের), তাতেই বরং জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার কমবে দ্রুত। জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনও একটি প্রত্যক্ষ নীতি যদি সত্যিই কার্যকর হয়, তবে তা হল, যে পরিবার জন্মনিয়ন্ত্রণ পরিষেবা চাইছে, তাকে সেটার ব্যবস্থা করে দেওয়া। এখন ভারতে মহিলাদের মধ্যে ১৪ শতাংশ এমন, যাঁরা এই মুহূর্তে সন্তানধারণ করতে চাইছেন না, কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনও পন্থাও তাঁরা ব্যবহার করছেন না। তাঁদের কাছে এই পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার কাজটা জরুরি।
শেষে আর একটা কথা মনে করিয়ে দিই— যাঁরা ভাবছেন, দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমলেই মোট সম্পদের ওপর চাপ কমবে, তাঁদের ধারণাটা ঠিক নয়। পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটলেই মানুষ অপেক্ষাকৃত কম সন্তান উৎপাদনের সিদ্ধান্ত করে থাকেন। বস্তুত, পরিবারের আয়তন ছোট রাখার সবচেয়ে বড় কারণ হল মাথাপিছু ভোগের পরিমাণ বাড়ানো। সুতরাং, মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হলে, পরিবারের আয়তন কমলে মাথাপিছু ভোগের পরিমাণ বাড়বে— এবং, তাতে দেশে মোট ভোগের পরিমাণ বাড়বে বই কমবে না।
অতএব, জোরজুলুম করে জন্মনিয়ন্ত্রণ করার নীতিকে কোনও যুক্তিতেই দাঁড় করানো যাচ্ছে না।
উন্নয়ন সমাজতত্ত্ব বিভাগ, কর্নেল ইউনিভার্সিটি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy