Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

ব্যক্তি সুরক্ষার চেয়েও ভোটবাক্সের সুরক্ষা বেশি

সরকারের কাজের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা, যাঁদের হাত ধরে একটি সরকার সুগঠিত ও মজবুত হয়, তাঁরা আজ কতটা নিরাপদ? আর তাঁদের নিরাপত্তার দায়টা কার? লিখছেন সঞ্জয় মণ্ডল রাজ্যের প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে কর্মরত ডাক্তারদের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা, ভালবাসা সহ শুভকামনা রইল।

এনআরএসের মতো  ঘটনা যে এই এক বারই মাত্র সম্পন্ন হয়েছে, তা কিন্তু নয়।

এনআরএসের মতো  ঘটনা যে এই এক বারই মাত্র সম্পন্ন হয়েছে, তা কিন্তু নয়।

শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৯ ০৪:৪৩
Share: Save:

বিগত কয়েক দিন ধরে গোটা রাজ্যের মানুষ সহ দেশবাসী তথা বিশ্ব আমাদের রাজ্যে ঘটে যাওয়া যে ঘটনাটি দেখল, তা মনে হয় আগামী দিনে ভারতের ইতিহাসে এক কলঙ্কময় যুগ বলে চিহ্নত থাকবে।

এই কলঙ্ক এক জন ভারতীয় তথা এক জন পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক হিসাবে যেমন আমার, তেমনই আমাদের সকলের। এক দল গুন্ডা সুসজ্জিত হয়ে প্রথমে আক্রমণ করল কিছু জুনিয়র ডাক্তরদের উপর। তার ফলে আক্রান্তকারী ডাক্তরেরা অনেকেরাই আঘাতপ্রাপ্ত হলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই গুরুতর অবস্থায় চিকিৎসাধীন। ডাক্তারদের উপরে এই আক্রমণের ঘটনা খুবই নিন্দনীয়। একে ‘জঘন্যতম’ সংস্কৃতি বললেও হয়তো কম বলা হয়।

রাজ্যের প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে কর্মরত ডাক্তারদের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা, ভালবাসা সহ শুভকামনা রইল। যাঁরা প্রতি বার নিজেদের উপরে ঘটে চলা নানা আক্রমণের পরেও নিজেদের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।

তবে এনআরএসের মতো ঘটনা যে এই এক বারই মাত্র সম্পন্ন হয়েছে, তা কিন্তু নয়। অতীতেও বহু বার এ রকম ভাবে আক্রান্ত হতে হয়েছে জুনিয়র ডাক্তারদের। কিন্তু কোনও বারেই হুঁশ ফেরেনি আমাদের। পরিবর্তন হয়নি আমাদের মানসিকতার। ফলে, বারবারই তার প্রতিফলন ঘটেছে আমাদের সমাজে এবং আক্রান্ত হয়েছেন ডাক্তারি জীবিকা-সহ আরও অন্য জীবিকার মানুষজনেরা। যাঁরা সরকারের হয়ে কাজ করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। তবুও ঠান্ডা ঘরে বসে থাকা মানুষগুলির মনে কখনও আঁচড় কাটতে সক্ষম হননি। সেই মানুষগুলি, যাঁরা আমাদের মতোই আমজনতার এক-একটি ভোটে জিতে এসে অধিষ্ঠিত হয়েছেন রাজ সিংহাসনে। আর যখনই এই ধরনের কোনও ঘটনা ঘটেছে, তখনই এঁরা সুমিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে একরাশ সমবেদনা সহ ন্যূনতম কিছু ক্ষতিপূরণের নিদান দিয়েছেন। আর পর ক্ষণেই বিষয়টি ভুলে গিয়েছেন।

সঙ্গে ভুলে গিয়েছেন তাঁদের দেওয়া সব প্রতিশ্রুতিও। ফলে, কোনও ঘটনা ঘটার পর কিছু দিন প্রশাসনিক তৎপরতা সব ঠিকঠাক থাকলেও সময়ের অবকাশে আবার পরিকাঠামো ফিরে গিয়েছে পুরনো জায়গাতেই। তাই ডাক্তার পেটানো, সরকারি কর্মচারীদের নিগ্রহের মতো ঘটনাগুলি যেন একটা নিত্য নৈমিত্তিক অভ্যাসে এসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে।

আজকের দিনে বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের নানা আন্দোলনকে লঘু করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তা চিকিৎসকদের আন্দোলন হোক বা ডিএ-র দাবিতে আন্দোলন কিংবা ভোটের দায়িত্বে যাওয়া সরকারি কর্মীদের ক্ষোভ-আন্দোলন। সুকৌশলে সেখানে যে ভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক লোকজন সেই সব পেশার মানুষদেরকে সাধারণ মানুষের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করে তুলছে বা তোলার চেষ্টা করছে, তা ভয়ঙ্কর এক প্রবণতা। এই সমস্যা আগামী দিনে এক ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আমার মনে হয়েছে।

তবে এটাও ঠিক যে, আমরা যাঁরা বিভিন্ন সরকারি কাজের সঙ্গে যুক্ত এবং যাঁদের হাত ধরে একটি সরকার সুগঠিত-মজবুত হয় ও সরকারের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে, তাঁদের কি কখনও কোনও ভুলই হয় না? হ্যাঁ, অবশ্যই হয়। তবে এই সত্যিটা মেনে নিতে আমাদের মনে কোনও দ্বিধা কাজ করে না। আমরা তার পরেও যথাসাধ্য চেষ্টা করি সেই সব ভুলকে শুধরে আবার নতুন করে কাজ করতে।

কিন্তু বিপজ্জনক হল, সমাজের এক শ্রেণির মানুষ আছেন, যাঁরা নিজেদের ভুলগুলিকে সব সময়ে পাশে সরিয়ে রেখে এক রকমের অতিসক্রিয় হয়ে ওঠেন। এবং নতুন নতুন ঘটনার সূত্রপাত ঘটাতে অতি উদ্যমী হয়ে ওঠেন। আর সেই মুষ্টিমেয় কয়েকটি লোকের অতিসক্রিয়তার কারণে আজ গোটা রাজ্যের চিকিৎসকেরা যে শারীরিক-মানসিক হেনস্থার শিকার হলেন, তার দায়ভার কার? কে বলবেন, চিকিৎসকের চোখ নষ্ট হওয়া বা মাথার খুলি ফেটে যাওয়ার ভুলটি তাঁর দ্বারাই সম্পন্ন হয়েছে? আমার মতে, এই ভুলের দায় ওই সব অতিসক্রিয় মানুষের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই প্রশাসনরেও। কারণ কোনও সরকারই বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে যে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন করা দরকার, তা কখনও করেনি। ফলে বারবারই এর দায় এসে পড়েছে আমাদের ঘাড়ে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাঁধে— যাঁরা সরকারের হয়েই সাধারণের জন্য কাজ করেন আর জনগণের হাতে মার খান। বারবারই নিরাপত্তার অনিশ্চয়তার কারণে আক্রান্ত হতে হয়েছে সরকারি কর্মীদের। সরকারি স্কুল শিক্ষক থেকে চিকিৎসক, সরকারি করণিক থেকে সরকারি আধিকারিক কোথাও কোনও সমস্যা হলেই আমরা ‘অপরাধী’ বনে যাই।

রাজ্যের সমস্ত জনগণের মধ্যে শতকরার নিরিখে খুবই কম শতাংশেই আছি আমরা সরকারি পেশার মানুষেরা। ফলে, ভোটবাক্সের রাজনীতিতে যে আমাদের প্রভাব খুবই কম, তা আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

যেখানে ব্যক্তি সুরক্ষার চেয়ে ভোটবাক্সের সুরক্ষা বেশি গুরুত্ব লাভ করে, সেখানে এই ধরনের ঘটনা ঘটা যে কিছুমাত্র আশ্চর্যের বিষয় নয়।

লেখক উজিরপুকুরিয়া হাইস্কুলের সহ শিক্ষক

অন্য বিষয়গুলি:

Vote Bank Politics Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy