Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
education

ভাষাশিক্ষা ও শিশুমনে তার প্রভাব

দেখতে হবে শিশুর মনে ভাষা গ্রহণ করার ক্ষমতাও। এক সঙ্গে একাধিক ভাষা শিক্ষা তার মানসিক বিকাশে কোনও বিরূপ প্রভাব ফেলবে কি না তাও দেখা প্রয়োজন। স্বল্প মেয়াদে কয়েকটি ভাষা শেখানো হলেই তা কাজে লাগবে এরও নিশ্চয়তা নেই। লিখছেন শ্রীকান্ত বসু ও লক্ষ্মণ দাসঠাকুরাসম্প্রতি জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়া তৈরির সময়ে হিন্দিকে ‘সর্বভারতীয় সংযোগকারী ভাষা’ হিসেবে উপস্থাপিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এই সুবাদেই দেশের সব প্রান্তে হিন্দিকে অবশ্যপাঠ্য করার দাবিও উঠেছিল। কিন্তু হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত কি না সে বিষয়ে বিতর্কের স্রোতটি কেন্দ্রীভূত হলেও ভারতীর ভাষাশিক্ষা নিয়ে আলোচনা ব্রাত্যই থেকে গিয়েছিল।

শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২০ ০৩:১০
Share: Save:

ভাষা ভাব প্রকাশের মাধ্যম। মা ও পরিবারের লোকজনের মুখে শব্দ শুনতে শুনতে শিশুর মনে মাতৃভাষা সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয়। আর সেখান থেকে তৈরি হয় ভাষার প্রতি ভালবাসা। এর পরে আসে ভাষা শিক্ষার বিষয়টি। প্রথাগত বা প্রথা বহির্ভূত ভাবে ভাষাশিক্ষার আয়োজন করা হয় এবং শিশুমনে
ভাষার ব্যাকরণ-সহ অন্য বিষয়গুলি শেখানো হয়।

সম্প্রতি জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়া তৈরির সময়ে হিন্দিকে ‘সর্বভারতীয় সংযোগকারী ভাষা’ হিসেবে উপস্থাপিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এই সুবাদেই দেশের সব প্রান্তে হিন্দিকে অবশ্যপাঠ্য করার দাবিও উঠেছিল। কিন্তু হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত কি না সে বিষয়ে বিতর্কের স্রোতটি কেন্দ্রীভূত হলেও ভারতীর ভাষাশিক্ষা নিয়ে আলোচনা ব্রাত্যই থেকে গিয়েছিল।

ভাষার ভিন্নতা চিরকালই ভারতের এক প্রান্তের সঙ্গে অপর প্রান্তের সংযোগের একটা বড় সমস্যা হিসেবে গণ্য হয়েছে। দেশের বৃহত্তর অংশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য আমরা মূলত ইংরেজির উপরেই নির্ভরশীল। দিনে দিনে ইংরেজির গুরুত্ব বাড়ায় দেশের নানা প্রান্তে মাতৃভাষা ক্রমশ ‘প্রান্তবাসী’ হয়ে পড়ছে। সরকারের দাবি, এই সমস্যার ‘সমাধান’-এর চেষ্টা নাকি করা হয়েছিল জাতীয় শিক্ষানীতির ওই খসড়াতে। তবে ‘হিন্দি অবশ্যপাঠ্য কি না’ তা নিয়ে বিতর্কের সময়েই কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, এই সিদ্ধান্ত বলবৎ করা হবে না।

এই নীতিতে বলা হয়েছিল, প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষা ও ইংরেজির মতো ভাষার সঙ্গে আরও একটি ভারতীয় ভাষা পড়তে হবে। এই ভাষার তালিকায় ছিল মালয়ালম, তামিল, তেলেগু প্রভৃতি। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উচ্চ প্রাথমিক স্তরে ভারতীয় ভাষার উপরে একটি পাঠ্যক্রম চালুর সুপারিশ করা হয়েছিল। এই ভাষার তালিকায় ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সবক’টি ভাষা ছিল। তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সৃষ্টি সম্পর্কে একটি ধারণা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল। মাধ্যমিক স্তরে (নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত) পড়ুয়াদের জন্য একটি বা তার বেশি বিদেশি ভাষা বেছে নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। নতুন শিক্ষানীতিতে ভাষাশিক্ষাকে একটি ‘নিরবচ্ছিন্ন’ পাঠ্যক্রম হিসেবে দেখা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কোনও একটি ভাষা নিয়ে কাজ করলেও ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারির মতো পাঠ্যক্রমে ‘স্থানীয় ভাষা’য় শিক্ষার উপরে জোর দেওয়া হবে। এর উদ্দেশ্য এই বিষয়গুলি কোনও এলাকার বাসিন্দাদের কাছে সেই এলাকার ভাষায় উপস্থাপন করার ‘যোগ্য করে তোলা’। ভারতীয় ভাষার ভিন্নতার বিষয়টিকে মাথায় রেখে জনসংযোগের ক্ষমতা তৈরিতে এই নীতি প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছিল বলে দাবি করা হয়েছে প্রশাসনের তরফে। এই শিক্ষানীতিতে আরও বলা হয়েছিল, পূর্ব ও উত্তর ভারতের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিকস্তরে একটি দক্ষিণ ভারতীয় ভাষা অবশ্যপাঠ্য করা হবে এবং দক্ষিণ-ভারতের ক্ষেত্রে উত্তর ও পূর্ব ভারতের ভাষা অবশ্যপাঠ্য করা হবে।

বস্তুত ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে এই ‘ত্রিভাষা’ নীতি বহু কাল ধরেই অবলম্বন করা হচ্ছে। সরকারি ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্কু স্তরের পুরো সময়টা মাতৃভাষা এবং একটি দ্বিতীয় ভাষা পড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে প্রায় সবক’টি শিক্ষানীতিতে। বাংলার অধিকাংশ স্কুলের পড়ুয়ারা প্রথম ও দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা এবং ইংরেজিকে বেছে নেয়। অন্য রাজ্যেও ইংরেজির সঙ্গে মাতৃভাষা পড়ানো হয়। পড়াশোনার মাধ্যম হিসেবেও এই দু’টি ভাষাই ব্যবহৃত হয়। হিন্দিভাষী রাজ্যে গোড়া থেকেই হিন্দি ও ইংরেজি ভাষা শেখানোর কারণে পরে সরকারি স্তরের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পড়ুয়াদের অসুবিধায় পড়তে হয় না। যারা মাতৃভাষায় বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোলের মতো বিষয় পড়াশোনা করে সমস্যাটা তাঁদেরই বেশি হয়। তাঁদের ক্ষেত্রে সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য আলাদা করে ইংরেজিতে বিভিন্ন বিষয় রপ্ত করতে হয়।

এই সমস্যা আজকের নয়, এবং একা ভারতেরও নয়। ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশেও এই সমস্যা রয়েছে। এই সমস্যা মেটানোর জন্য ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশে তিনটি ভাষাকে অবশ্যপাঠ্য করার নীতি প্রণীত হয়েছে। শিক্ষাবিজ্ঞানীদের দাবি, এই নীতি প্রণয়নের ফলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভাষাজনিত সংযোগের সমস্যা অনেকটাই কমেছে। কাউন্সেলিংয়ের ফলে বাইরে যাওয়ার প্রবণতাও আগের থেকে বেড়েছে। কিন্তু ভারতের মতো দেশে যেহেতু ভাষার সংখ্যা এবং জনসংখ্যা দু’টোই বেশি ফলে সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে জাতীয় শিক্ষানীতির সব নির্দেশ মানতে গেলে বিরাট সংখ্যক শিক্ষকের দরকার পড়বে। উত্তরপ্রদেশের প্রায় দু’লক্ষ একুশ হাজার স্কুলে মালয়ালাম, তামিল, গুজরাটির মতো ভাষা শেখাতে গেলে কয়েক লক্ষ শিক্ষকের দরকার। অথচ সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, সেই রাজ্যে ৯২ হাজারেরও বেশি স্কুলে এক জনই ভাষা শিক্ষক রয়েছেন। অর্থাৎ এক জন শিক্ষককেই একাধিক ভাষা পড়াতে হচ্ছে। অন্য রাজ্যগুলিতেও একই অবস্থা। এই সমস্যা মেটাতে পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ করা দরকার। এতে কিন্তু একটা সুবিধাও রয়েছে। এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ হলে কিন্তু ভাষাশিক্ষার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। কর্মসংস্থান তৈরি হলে ভাষা শিক্ষায় পড়ুয়াও বাড়বে।
আবার বিদেশি ভাষা পড়ানোর বিষয়েও সমস্যা রয়েছে। ইংরেজি ছাড়া অন্য বিদেশি ভাষার জন্য একলপ্তে বিরাট সংখ্যক শিক্ষক পাওয়া বেশ সমস্যার। অথচ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বিদেশি ভাষা শেখানোর জন্য প্রতিটি স্কুলে কম করে তিন থেকে চার জন বিদেশি ভাষার শিক্ষক থাকা বাঞ্ছনীয়। এই বিরাট সংখ্যক শিক্ষকের জোগান না পাওয়া গেলে শিক্ষাকে কোনও ভাবেই চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

দেখতে হবে শিশুর মনে ভাষা গ্রহণ করার ক্ষমতা সম্পর্কেও। কারণ, এক সঙ্গে একাধিক ভাষা শিক্ষা তার মানসিক বিকাশে কোনও বিরূপ প্রভাব ফেলবে কি না সে সম্পর্কেও খুঁটিয়ে দেখা প্রয়োজন। আবার অল্প মেয়াদে কয়েকটি ভাষা শেখানো হলেই যে সেটি সারা জীবন কাজে লাগবে এর কোনও নিশ্চয়তা নেই। বাস্তব বলে, আমরা অনেকেই সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতে হিন্দি, সংস্কৃতের মতো ভাষা শিখেছি। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাকে সারাজীবন কাজে লাগাতে পেরেছি কত জন? ফলে বিষয়টি নিয়ে আরও সমীক্ষা এবং গবেষণার প্রয়োজন থেকেই গেল।

শ্রীকান্ত বসু, শিক্ষক, বিজয়নারায়ণ মহাবিদ্যালয় ইটাচুনা, লক্ষ্ণণ দাসঠাকুরা, অবসরপ্রান্ত প্রধান শিক্ষক, বিসিডিএন উচ্চ বিদ্যালয়

অন্য বিষয়গুলি:

Education Teaching of language
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy