ছবি: সংগৃহীত
‘বিটিং প্লাস্টিক পলিউশন’, এটিই ছিল ২০১৮ সালের পাঁচ জুন, রাষ্ট্রসঙ্ঘ আয়োজিত ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’-এর থিম। সে বারের মূল শ্লোগান ছিল, “যদি তুমি এটিকে পুনরায় ব্যবহার করতে না পার তা হলে প্রত্যাখ্যান কর।’ সে বারের পরিবেশ দিবসের মুখ্য আয়োজক ছিল ভারতবর্ষই।
প্লাস্টিক দূষণ সম্পর্কে আলোচনার আগে, তার রাসায়নিক চরিত্র সম্পর্কে জেনে নেওয়া দরকার। প্লাস্টিক হল পেট্রো-রাসায়নিক শিল্পের একটি উপজাত সামগ্রী। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, এর উৎপাদন ব্যয় অনেক কম এবং এটির জল প্রতিরোধক ক্ষমতা অনেক বেশি। এই চরিত্রের জন্যই গোটা বিশ্ব জুড়ে প্লাস্টিকের কদর। কিন্তু, পরিবেশ ও জীবজগতের ক্ষেত্রে প্লাস্টিক ভয়ঙ্কর সমস্যা সৃষ্টি করে। কারণ, প্লাস্টিকের দ্রব্য তৈরি করতে ‘বিপিএ’ (বিসফেনল-এ) রাসায়নিকটি ব্যবহার করা হয়। এই রাসায়নিকটি খুব সহজে নষ্ট করা যায় না। এটি পচনের মতো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবেশে মিশে যেতে পারে না। আবার ক্ষুদ্র আকারে প্লাস্টিক খাবারের সঙ্গে মিশে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে এবং নানা রকম রোগের সৃষ্টি করে। এ ছাড়া, প্লাস্টিকের কারণে মাটি, জল, বায়ুও দূষিত হয়। বর্ষায় শহরাঞ্চলে জল জমার অন্যতম প্রধান কারণ প্লাস্টিক। প্লাস্টিকের ব্যাগ, বোতল শহরাঞ্চলে নিকাশি নালাগুলিতে জমা হয়ে নিকাশি ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে দেয়।
সাম্প্রতিক একটি পরিসংখ্যান বলছে, আমাদের দেশে ফি-দিন প্রায় ২৬ হাজার টন প্লাস্টিকের বর্জ্য উৎপন্ন হয়। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকের প্রায় ৪৬ শতাংশ সংগ্রহ করা হয় না।
ভারতের মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি উৎপাদিত হয় শুধু দিল্লি, চেন্নাই, কলকাতা, মুম্বই ও বেঙ্গালুরুর মতো মহানগরীতেই। পরিসংখ্যান বলছে, ফি-বছর গোটা বিশ্বে প্রায় এক কোটি তিরিশ লক্ষ টন প্লাস্টিক সমুদ্রে মিশছে। যা সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে গোটা বিশ্বের বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
চলতি বছরের স্বাধীনতা দিবসের দিন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেশের জনগণ ও সরকারি দফতরগুলিকে প্লাস্টিক দ্রব্য বর্জনের জন্য পদক্ষেপ করার কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালের মধ্যে ভারতকে পুরোপুরি ‘প্লাস্টিকমুক্ত’ করার ডাক দেন। এর ফলশ্রুতি হিসেবে ২ অক্টোবর, ২০১৯ মহাত্মা গাঁধীর জন্মদিনে ‘একবার ব্যবহারযোগ্য’ প্রধান ছ’টি প্লাস্টিক দ্রব্যের সামগ্রী— প্লাস্টিক ব্যাগ, কাপ, প্লেট, প্লাস্টিক বোতল, স্ট্র, ছোট প্লাস্টিক প্যাকেট (প্রধানত শ্যাম্পু বা সসের জন্য ব্যবহৃত) বন্ধ করার কথা ঘোষণা করা হয়।
কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি, আমাদের দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্যও প্লাস্টিক বন্ধের লক্ষ্যে কাজ করছে। মহারাষ্ট্র, সিকিম, গোয়া প্লাস্টিক ও থার্মোকলের উৎপাদন, ব্যবহার ও বিক্রি বন্ধের কথা ঘোষণা করেছে। বিভিন্ন দেশেও প্লাস্টিক দ্রব্যের ব্যবহার কমানোর জন্য পদক্ষেপ করেছে। যেমন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ২০২১ সালের মধ্যে, চিনে ২০২৫ সালের মধ্যে এক বার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বর্জনের ডাক দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু এত কিছুর পরেও আমরা, অর্থাৎ সাধারণ জনগণ, কতটা সচেতন হয়েছি সেটাই ভাবার বিষয়। এই বিষয়ে দেশের বিভিন্ন বয়সী মানুষের উপরে একটি সমীক্ষা চালানো হয়। যেখানে কতগুলি প্রশ্নের মধ্যে প্রথম ছিল, আপনি প্লাস্টিক দূষণ সম্পর্কে কতটা অবহিত? এই প্রশ্নে কম-বেশি সবাই জানিয়েছেন তাঁরা বেশ ভাল ভাবেই বিষয়টি জানেন। এর পরের প্রশ্ন ছিল, প্রাণী এবং মানুষের দেহে প্লাস্টিকের ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কেও কি আপনি সচেতন? এ ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছে, কম-বেশি সকলেই প্লাস্টিকের ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এঁরা সকলেই তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের দ্রব্য ব্যবহার করেন। বাড়িতে, অফিসে, স্কুল ও কলেজ, কাজের জায়গায় এঁদের বেশিরভাগ মানুষই প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করেন। তবে সচেতনতার কারণে অনেকেই একটি বোতল কিছু দিন ব্যবহার করার পরে তা ফেলে দেন। কিন্তু বহু মানুষই সচেতনতার অভাবে একই বোতল দিনের পর দিন ব্যবহার করে যান।
সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বাড়িতেও খাবার খাওয়ার জন্যও অনেকে প্লাস্টিকের প্লেট, চামচ ইত্যাদি ব্যবহার করেন। এর পরের প্রশ্ন ছিল, সরকারের এই প্লাস্টিক বন্ধের সিদ্ধান্ত আপনি কতটা সমর্থন করেন? উত্তরে কম-বেশি সকলেই এই পদক্ষেপকে সমর্থন করলেও এটি বাস্তবে কতটা সফল হবে সে ব্যাপারে তাঁরা সন্দিহান। কারণ, অনেকের মতে শুধু প্লাস্টিকের ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করলেই হবে না, সবার আগে দরকার তার উৎপাদনে রাশ টানা। আবার উৎপাদন বন্ধ করা হলে দৈনন্দিন জীবনে নানা সমস্যা তৈরির কথাও বলেন অনেকে। এমন অনেক দ্রব্য রয়েছে যেগুলি বহন করার প্রধান মাধ্যম এই প্লাস্টিকের ব্যাগ। সেগুলির বহনের জন্য বিকল্প মাধ্যম তৈরি যে সবার আগে দরকার আলোচনায় উঠে আসে সে কথাও।
এর পরে উপস্থিত ব্যক্তিদের কাছে প্লাস্টিকের বিকল্প অথবা প্লাস্টিক দূষণ থেকে বাঁচার উপায় কী হতে পারে সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে দেখা যায়, বেশিরভাগ মানুষই এ বিষয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন। একাংশের মতে, প্লাস্টিকের বোতলের বদলে স্টিল অথবা তামার জলের বোতল ব্যবহার করা যেতে পারে। বাড়িতে গরম খাবার কোনও মতেই প্লাস্টিকের বাসনে না খাওয়ার কথাও বলেন অনেকে। আবার প্লাস্টিকের ব্যাগের পরিবর্তে পাটের বা কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করার প্রস্তাবও দেন অনেকে। এ ছাড়া বাজারে কিংবা শপিং মলে যাওয়ার সময় সঙ্গে ব্যাগ নিয়ে যাওয়ার পরামর্শও দেন কয়েক জন। কিন্তু অনেকের মতে বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের ঠিক বিকল্প এখনও সে ভাবে তৈরি হয়নি। সে দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শও দেন অনেকে।
এর পর, বিভিন্ন দোকানে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যায়, তাঁরা অনেকেই ২ অক্টোবর সরকারি ঘোষণার পরে প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু এর প্রধান কারণ হল, জরিমানার হাত থেকে বাঁচা। আবার অনেক দোকানদারের মতে, এ রকম পদক্ষেপ আগেও প্রশাসনের তরফে করা হয়েছিল। নিয়ম বলবৎ হওয়ার পরে কয়েক সপ্তাহ এ বিষয়ে কড়াকড়ি থাকলেও, কিছু দিন পরেই নজরদারি শিথিল হতে শুরু করে। তাই এ বারেও নজরদারি শিথিল হলেই ফের প্লাস্টিকের ব্যবহার রমরমিয়ে বাড়বে এমন আশঙ্কাও করছেন অনেকে। তাই সাধারণ মানুষের একাংশের প্রস্তাব, সবার আগে প্লাস্টিকের উপযুক্ত বিকল্প তৈরি করে এর উৎপাদন বন্ধ করা হোক।
তাই সব শেষে এটাই বলতে হয়, নিয়ম তৈরি করা হয় সাধারণ মানুষের ভাল হওয়ার জন্য। কিন্তু সাধারণ মানুষই তা ভেঙে থাকেন। কিন্তু সকলেরই মাথায় রাখা উচিত পরের প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে হলে দৈনন্দিন জীবনে আমাদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে।
গবেষক, ভূগোল বিভাগ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy