Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

মানুষ খুঁড়ছে খাত, বাঁচাবে তো প্রযুক্তির সজারু!

খুব পুরনো কথা। নদীর তীরে বাস শঙ্কা বারো মাস। সেই আশঙ্কা নিয়েই বর্ষায় দুই মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রামের বহু এলাকায় বাসিন্দাদের বুক দুরুদুরু। ভাঙন-কথার খোঁজে দ্বিতীয় পর্বে আনন্দবাজার কাঁসাইয়ের ভাঙন নতুন কোনও ঘটনা নয়। নদীর মূলস্রোতটি ডেবরার শালডহরি গ্রাম থেকে সোজা পাঁশকুড়ার ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে।

মেদিনীপুরে কংসাবতীর ভাঙন। (ডানদিকে) অ্যানিকেতের সামনে সজারু কাঠামো। নিজস্ব চিত্র

মেদিনীপুরে কংসাবতীর ভাঙন। (ডানদিকে) অ্যানিকেতের সামনে সজারু কাঠামো। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০২:৩২
Share: Save:

সে অনেক দিন আগের কথা। কাশীজোড়া পরগনার তৃতীয় রাজা প্রতাপনারায়ণ রায় প্রতাপপুর এলাকায় গড়ে তুললেন একটি আধুনিক গ্রাম। ঐতিহাসিকরা বলেন রাজা প্রতাপনারায়ণ রায়ের নাম অনুসারে গ্রামটির নাম হয় প্রতাপপুর। বর্তমানে পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া এলাকায় পড়ে গ্রামটি। এতটাই উন্নত ছিল গ্রামটি যে সেটিকে নগর বললেও অত্যুক্তি হয় না। এলাকাটি ছিল কংসাবতীর নিম্নভাগ। ওই এলাকা দিয়ে বয়ে চলত খরস্রোতা কাঁসাই। স্থানীয়রা কাঁসাইয়ের এই অংশটিকে বেহুলা নদী বলেই ডাকত। বেহুলা নদীর তিরে প্রতাপপুর এলাকাটি ছিল নৌ পথে বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র। সে সময় প্রতাপপুর এলাকায় বেহুলা নদীতে সার দিয়ে বাঁধা থাকত পাল তোলা নৌকো। ফি বছর বন্যায় প্লাবিত হয়ে যেত গোটা এলাকা। বন্যার হাত থেকে এলাকাকে রক্ষা করতে প্রতাপপুর এলাকার অদূরে কংসাবতী নদীতে বাঁধ দেয় ব্রিটিশরা। ফলে গতিপথ বদল করে কাঁসাই। বেহুলার খাতটি ক্রমশ মজে গিয়ে তৈরি হয় জনপদে। তবে গতিপথ বদল করলেও ভাঙন বন্ধ হয়নি কাঁসাইয়ের।

কাঁসাইয়ের ভাঙন নতুন কোনও ঘটনা নয়। নদীর মূলস্রোতটি ডেবরার শালডহরি গ্রাম থেকে সোজা পাঁশকুড়ার ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে। ভারী বা অতি ভারী বৃষ্টিতে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে কংসাবতী। ১৯৯৫ সালে পাঁশকুড়ার মাইশোরা এলাকার ফকিরবাজারে বড়সড় ভাঙন দেখা দেয় কাঁসাইয়ের। প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা। সেই ভাঙনের জেরে ফকিরবাজার এলাকায় তৈরি হয় বিশাল এক দিঘি। আজও এই দিঘি সেই ভাঙনের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। এর কয়েক বছর পর গোবিন্দনগর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার গোলঘাটে কাঁসাইয়ের বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। কাঁসাইয়ের সাম্প্রতিকতম ভাঙনের কথা বলতে গেলে ২০১৩ সালে পাঁশকুড়ার গড় পুরুষোত্তমপুরের ভাঙনের কথা বলতে হয়। সেবার এমন একটি জায়গায় নদীবাঁধ ভেঙেছিল যে সেটি মেরামত করতে হিমশিম খেতে হয় ইঞ্জিনিয়ারদের। সেবার ওই একই জায়গায় মোট তিনবার বাঁধ ভাঙে মাসখানেকের মধ্যে। কাঁসাইয়ের জলে পাঁশকুড়া ও তমলুক ব্লকের বিস্তীর্ণ অংশ সেবার প্রায় মাস দুয়েক ধরে জলমগ্ন ছিল। কাঁসাইয়ের এই ইতিহাসেই আতঙ্ক লুকিয়ে। ফলে বর্ষাকালে কাঁসাই কী আচরণ করে সেদিকেই লক্ষ্য থাকে পাঁশকুড়ার বাসিন্দাদের।

মেদিনীপুরেও নদী ভাঙন একটা বড় সমস্যা। প্রায় প্রতি বছরই নদীর পাড় ভেঙে চাষযোগ্য জমি নদীগর্ভে তলিয়ে যায়। বসতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই এলাকার সমস্যাও কংসাবতী। মেদিনীপুরের পাশ দিয়ে কংসাবতী বয়ে গিয়েছে। নদীর একদিকে মেদিনীপুর, অন্যদিকে খড়্গপুর। স্থানীয়দের বক্তব্য, কংসাবতীর আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় বালি তোলা চলে। এতে নদীর পাড় দুর্বল হচ্ছে। সামান্য জলের তোড়ে পাড়ে ভাঙন ধরে। পাড় ভাঙায় গতিপথ বদলাচ্ছে কংসাবতীর। স্বভাবতই উদ্বিগ্ন নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা। যে কোনও সময়ে বড় ভাঙন দেখা দিতে পারে। আর তা হলে বেশ কিছু বসতি এলাকা নদীগর্ভে চলে যাবে। আশ্রয় হারাবেন অনেকে। নদীর পাশেই রয়েছে পালবাড়ি। এলাকার বিদায়ী কাউন্সিলর সৌমেন খানের কথায়, ‘‘গত কয়েক বছরে নদীর পাড়ে নতুন করে ভাঙন ধরছে। যেখান সেখান থেকে বালি তোলার ফলেই নদীর পাড় ভাঙছে। স্থানীয় মানুষ আশঙ্কায় রয়েছেন। ভাঙন রোধে পদক্ষেপ করা না হলে আগামী দিনে বসতি এলাকা জলের তলায় চলে যাবে।’’ স্থানীয় বাসিন্দা নারায়ণ মণ্ডল বলেন, ‘‘নদীতে জল বাড়লেই আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। নদীটা ক্রমশ যেন এগিয়ে আসছে। পাড় ভাঙতে ভাঙতে বসতির দিকে এগিয়ে আসছে। ভাঙন রোধে পদক্ষেপ করা জরুরি।’’ মহকুমাশাসক (সদর) দীননারায়ণ ঘোষের আশ্বাস, ‘‘পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করা হবে।’’ জেলার সেচ কর্মাধ্যক্ষ রমাপ্রসাদ গিরিরও আশ্বাস, ‘‘ভাঙন রোধে যে পদক্ষেপ করার তা করা হবে।’’

পদক্ষেপ তো করা হবে। কিন্তু উপায় কী? নতুন কোনও প্রযুক্তি? মহকুমাশাসক মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘প্রাকৃতিক ভাবে নদীর বাঁধের ক্ষয় রোধ করা সম্ভব। ডেবরায় কংসাবতী নদীর বাঁধে ভেটিভার (এক ধরনের ঘাস) লাগানোও হয়েছে।’’ সেচ দফতর সূত্রে খবর, এখন আরও উন্নত প্রযুক্তি এসেছে। মেদিনীপুরে অ্যানিকেতের সামনে যেমন সজারুর কাঁটার আদলে এক কাঠামো তৈরি হচ্ছে। সেচ দফতর জানাচ্ছে, এটিকে ‘কংক্রিটের পর্কুপাইন’ বলা হয়। কাঠামোটি সজারুর কাঁটার মতো দেখতে। বাঁধ বাঁচানোর নতুন প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এই কাঠামো বাঁধের সামনে ভূমিক্ষয় রোধ করবে। সেচ দফতরের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার তপন পাল বলেন, ‘‘ভূমিক্ষয় রোধ করতেই সজারুর কাঁটার মতো এই কাঠামো তৈরি হচ্ছে।’’

এক সময়ে অ্যানিকেতের অদূর থেকেও বেআইনি ভাবে বালি তোলা হচ্ছিল। বালি তোলার ফলে এলাকায় ভূমিক্ষয়ের আশঙ্কা দেখা দেয়। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেই এখানে এই নতুন প্রযুক্তির কাঠামো তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। মেদিনীপুর শহরের পাশে, মোহনপুরের কাছে কংসাবতী নদীর উপরে থাকা অ্যানিকেত বাঁধটি তৈরি হয়েছিল প্রায় দেড়শো বছর আগে। জলের স্রোত সামলানোর ক্ষমতা থাকলেও উপরের এত চাপ সামলানোর ক্ষমতা ছিল না এই অ্যানিকেতের। ফলে, এটি ভেঙে যায়। কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে। অবশ্য বিশেষ সুরাহা হয়নি। সবদিক দেখে পুরনো অ্যানিকেতের পাশে নতুন অ্যানিকেত তৈরি করা হয়। কংসাবতীর এই অ্যানিকেত থেকে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চারটি ব্লকের ৮০ হাজার একর জমিতে সেচ দেওয়া হয়। মেদিনীপুর সদর, কেশপুর, ডেবরা ব্লকে বন্যা প্রতিরোধও করা যায়। বন্যা হলে জলাধার থেকে জল ছাড়া হয়। জলাধারের ছাড়া জল নদীতে এসে মিশলে নদী ফুলেফেঁপে ওঠে। জলের তোড়ে বাঁধ ভাঙে। তখন গ্রামে হু হু করে নদীর জল ঢুকতে শুরু করে। সেচ দফতরের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘এই কাঠামো থাকার ফলে এখানে ভূমিক্ষয় হবে না। ভূমিক্ষয় না- হলে অ্যানিকেত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে না।’’

তথ্য সহায়তা: দিগন্ত মান্না, বরুণ দে, দেবমাল্য বাগচী

অন্য বিষয়গুলি:

River Bed Erosion Midnapore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy