ক্ষোভ: বিচারপতি জোসেফ, বিচারপতি চেলমেশ্বর, বিচারপতি গগৈ ও বিচারপতি লোকুরের সাংবাদিক বৈঠক। দিল্লি, ১২ জানুয়ারি ২০১৮
নতুন বছরটা বেশ আশা জাগিয়েই শুরু হয়েছিল। জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। শীতের ছুটির পরে সবে সুপ্রিম কোর্ট খুলেছে। গত বছরের অগস্টে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদের পর থেকেই কাশ্মীরে ইন্টারনেট বন্ধ। লাগাতার ১৪৪ ধারা চলছে। তার বিরুদ্ধে একগুচ্ছ মামলা জমা পড়েছিল আদালতে। সব শুনে কেন্দ্রীয় সরকার ও জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসনকে তোপ দাগলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা। বললেন, যথেচ্ছ ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে বাক্স্বাধীনতা, ইন্টারনেট ব্যবহার, স্বাধীন ভাবে চলাফেরার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা যায় না।
এ দেশের মানুষের মনে সুপ্রিম কোর্ট এখনও সব কিছুর ঊর্ধ্বে। সংবিধানে রাষ্ট্রের ভাবনা বা নাগরিকদের মৌলিক অধিকারে কোনও আঘাত এলেই দেশের আমজনতা আদালতের মুখের দিকে তাকায়। বিশ্বাস করে, সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টই শেষ প্রহরী— দেশের নির্বাচিত সরকার আমজনতার সাংবিধানিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করলে আদালতই নাগরিক অধিকারের পক্ষে দাঁড়াবে।
সেই কারণেই নির্বাচিত সরকার ও বিচারবিভাগের মধ্যে দুর্ভেদ্য প্রাচীর থাকা প্রয়োজন। সেই প্রাচীর যথেষ্ট দুর্ভেদ্য আছে তো?
সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি থেকে প্রবীণ বিচারপতিরা কেউ কেউ এমন একটা প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্নের একটি কারণ, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের তৃতীয় প্রবীণতম বিচারপতির মুখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভূয়সী প্রশংসা। প্রধান বিচারপতি থেকে সুপ্রিম কোর্টের সমস্ত বিচারপতি ও অন্যান্য দেশের বিচারপতিদের সামনে বিচারপতি অরুণ মিশ্র প্রধানমন্ত্রীকে ‘বহুমুখী প্রতিভা’ বলে প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদী আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত দূরদ্রষ্টা। যিনি আন্তর্জাতিক মানের চিন্তাভাবনা করেন। দেশের নিজস্ব সমস্যা অনুযায়ী কাজ করেন।
চল্লিশ বছর আগের ঘটনা মনে পড়ে। ১৯৮০ সালের লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরা গাঁধীর জয়ের পরে বিচারপতি পি এন ভগবতী তাঁকে চিঠি লিখে ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর পদে ফেরার জন্য অভিনন্দন জানিয়েই থেমে যাননি। বলেছিলেন, ইন্দিরা গরিব, ক্ষুধার্ত মানুষের আশার আলো হয়ে উঠেছেন। ইন্দিরার ‘দৃঢ় প্রতিজ্ঞা’, ‘মানুষের জন্য ভালবাসা’, ‘দুর্দান্ত প্রশাসনিক ক্ষমতা’ ও ‘বিপুল অভিজ্ঞতা’-র জোরে তিনি যে দেশের হাল ধরতে পারবেন, সে বিষয়ে নিশ্চিত বলেও জানিয়েছিলেন ভগবতী।
ইতিহাস বলছে, বিচারপতি ভগবতী তার আগেই জরুরি অবস্থার সময় সরকার মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিতে পারে বলে ইন্দিরা-সরকারের যুক্তি মেনে রায় দিয়েছেন। তাতে ভিন্ন মত জানান বিচারপতি এইচ আর খন্না। পরবর্তী কালে ইন্দিরা-সরকার বিচারপতি এইচ আর খন্নাকে টপকে বিচারপতি ভগবতীকেই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করে। ইতিহাস আরও বলে, বিচারপতি ভগবতী পরে নিজের কাজের জন্যই দুঃখপ্রকাশ করে বলেছিলেন, ঘড়ির কাঁটা পিছনে ঘোরাতে পারলে তিনি বিচারপতি খন্নার সঙ্গেই একমত হতেন।
নরেন্দ্র মোদী জমানায় সরকারের সঙ্গে বিচারবিভাগের সম্পর্কটা রীতিমতো টানাপড়েন দিয়েই শুরু হয়েছিল। বিচারপতিদের হাতেই বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতার ব্যবস্থা বদলাতে মোদী সরকার জাতীয় বিচারপতি নিয়োগ কমিশন তৈরির আইন আনে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তা অসাংবিধানিক বলে খারিজ করে দেয়। প্রয়াত অরুণ জেটলি একে নির্বাচিত না হওয়া ব্যক্তিদের স্বৈরশাসন বা ‘টিরানি অব দি আন-ইলেকটেড’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। এর পরেই একের পর এক নিয়োগ নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিচারবিভাগের চাপানউতোর শুরু হয়।
সরকার অনেক সময়েই চায়— দেশের বিচারবিভাগ তার অনুগত হোক। এ জন্য বিচারপতিদের উপর চাপ তৈরির চেষ্টাও চলে। রাজনৈতিক নেতারা প্রতি পদে বোঝানোর চেষ্টা করেন, বিচারবিভাগ সরকারের সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত সংঘাতে গেলে তার ফল ভুগতে হবে। মোদী সরকারের আমলে এটা খুবই প্রকট ভাবে হচ্ছে। উত্তরাখণ্ড হাইকোর্টের বিচারপতি কে এম জোসেফ রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি অসাংবিধানিক বলে খারিজ করে দেওয়ার পরে তাঁকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের টালবাহানার কাহিনি সর্বজনবিদিত। সম্প্রতি দেখা গেল, দিল্লির হিংসার আগে উস্কানিমূলক মন্তব্যের জন্য বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়েরের নির্দেশের পরেই দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি এস মুরলীধরকে বদলি করা হল।
বিচারবিভাগের উপর মোদী সরকারের চাপ সৃষ্টির চেষ্টা প্রকাশ্যে আসে ২০১৮-র ১২ জানুয়ারি। তদানীন্তন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সাংবাদিক সম্মেলন করে চার প্রবীণ বিচারপতি অভিযোগ তুলেছিলেন, প্রধান বিচারপতির দফতরে সরকারের প্রভাব খাটানোর ইঙ্গিত স্পষ্ট। সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দুষ্যন্ত দভে প্রধান বিচারপতির দফতরে চিঠি পাঠিয়েছেন: তাঁর প্রশ্ন, সরকারের পক্ষে স্পর্শকাতর মামলা বাছাই-করা বিচারপতিদের বেঞ্চে পাঠানো হচ্ছে কেন?
গত বছর দুয়েকের মধ্যে দিল্লির আবহাওয়া কি লক্ষণীয় ভাবে বদলে গিয়েছে? প্রবীণ বিচারপতিরা অনেকেই মনে করেন, ২০১৯ সালটি ভারতের বিচারবিভাগের পক্ষে মোটেই স্মরণীয় নয়। অগস্ট মাসে ৩৭০ রদের পরে কাশ্মীরে সরকারের দমননীতি নিয়ে বারবার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েও সাধারণ নাগরিক বা বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা কোনও সুরাহা আদায় করতে পারেননি। তার থেকেও চিন্তার বিষয় হল এই অভিযোগ যে, ৩৭০ রদের সাংবিধানিক বৈধতা বা ব্যক্তি-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নিয়ে মামলার শুনানি শুরু করতেও সুপ্রিম কোর্ট অনেক দেরি করেছে। নয়া নাগরিকত্ব আইন বা সিএএ-র সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েও সুপ্রিম কোর্টে দেড়শোর কাছাকাছি মামলা জমা পড়েছে। গোটা দেশ জুড়ে এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হলেও সুপ্রিম কোর্ট এ নিয়ে দ্রুত শুনানিতে রাজি হয়নি। উল্টে বলেছে, আগে অশান্তি থামা দরকার। অযোধ্যা মামলায় বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা অন্যায় হয়েছিল বলেও এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় কার্যত সেই অন্যায়কেই স্বীকৃতি দিয়ে হিন্দুদের পক্ষে গেল কি না— তা নিয়েও প্রশ্ন শোনা গিয়েছে।
এক সময় যিনি বিচারবিভাগের সঙ্গে সংঘাতে মোদী সরকারের মুখ ছিলেন, সেই আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ এখন বিচারবিভাগের সমালোচনা হলেই বলছেন, পরিকল্পিত ভাবে আদালতের রায়কে প্রভাবিত করার চেষ্টা হচ্ছে। ঘটনা হল, বিচারবিভাগের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও আদালতের যে কোনও রায়েরই আইনি দিক নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, আদালত আইন অনুযায়ী ঠিক বিচার করেনি বলে সমালোচনা হতে পারে, সংবিধানের যথাযথ ব্যাখ্যা হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। সে কারণেই হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট, বা সুপ্রিম কোর্টের একটি বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে বৃহত্তর বেঞ্চে আর্জি জানানোর সুযোগ রয়েছে। আদালতের রায়ের সমালোচনা করার অর্থ এই নয় যে বিচারপতিদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, তেমন প্রশ্ন উঠলে, সেটা শুধু বিচারপতিদের সমস্যা নয়। গোটা প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন। বিশেষত দেশের আম নাগরিকের মনে যখন আদালতই শেষ ভরসা।
সংবাদমাধ্যম থেকে সামাজিক মাধ্যমের বিস্ফোরণের যুগে এখন বিচারপতিদেরও প্রতিটি কথা, দাঁড়ি-কমা, প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়ে চুলচেরা বিচার হচ্ছে। তাই মানুষের চোখে সরকার ও বিচারবিভাগের মধ্যে দুর্ভেদ্য প্রাচীর অক্ষত রাখার কাজও কঠিন হয়ে পড়েছে। আশার কথা হল, দেশের প্রধান বিচারপতি নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষিত রাখবেন, মানুষের এই বিশ্বাস এখনও অটুট। বিপুল ভোটে জিতেও নির্বাচিত সরকার নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে, শীর্ষ আদালত তারও ন্যায়বিচার করবে বলে মানুষের আস্থা রয়েছে। এই আস্থা এ-দেশের বিপন্ন গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি এবং মূল্যবান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy