উত্তাল: বিক্ষোভকারী জনতা পাথর ছুড়ছে সেনাবাহিনীর দিকে, গুয়াহাটি, ১২ ডিসেম্বর। এএফপি
এক অদ্ভুত অজানা আতঙ্কে ভুগছেন অসম, ত্রিপুরা, মেঘালয়ের মানুষজন। মণিপুর ও অরুণাচল প্রদেশও বাদ েনই। প্রশ্নটা হল, ডি-ভোটার, এনআরসি, ডিটেনশন ক্যাম্প ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে সঙ্কট তো সে অঞ্চলে বহু বছর ধরেই। তা হলে এখন নতুন করে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দল, ছাত্র, সাধারণ নাগরিক সবাই কেন নেমে পড়ছেন রাস্তায়? কেন কাশ্মীরের মতো ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও কেন্দ্রকে পাঠাতে হল কয়েক কোম্পানি সেনা? কী নিয়ে উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন রাজ্যে এত প্রতিবাদ? কিসে তাঁরা এত ভয় পাচ্ছেন?
আসলে গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রীয় ও রাজ্য স্তরে এত রকমের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা, এত রকম স্লোগান আশ্বাস বোঝানো ইত্যাদির পরও নাগরিকত্ব আইনের মোদ্দা ব্যাপারটা কী, তা মানুষ জেনে-বুঝে ফেলেছেন। বিপদটা হয়েছে সেখানেই। বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলের মানুষেরা এই আইনের বিপদ নিজেদের পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখতে ও বুঝতে শুরু করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
নতুন নাগরিকত্ব আইনে যদিও পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ থেকে আসা সেই দেশগুলোর সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা এবং নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলা হয়েছে, ঠিক অসম চুক্তির মতো এখানেও একটা নির্দিষ্ট দিনের উল্লেখ আছে, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪। অর্থাৎ এই ‘কাট অফ ডেট’-এর মধ্যে আসা এই সম্প্রদায়ের মানুষদেরকে কেন্দ্রীয় সরকার নাগরিকত্ব পেতে সহায়তা করবে। আমাদের দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দেশগুলির পরিস্থিতি ও ইতিহাস মনে রাখলে বুঝতে অসুবিধে হয় না, কেন ও কোথায় তাঁরা বিপদের সম্ভাবনা দেখছেন।
অসমে গত ১১ তারিখে প্রথম সর্বভারতীয় মিডিয়ায় খবর প্রচার করা হয় যে, এই বিল পাশ হওয়ায় অসম উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। বহিরাগত-বিরোধী ক্ষোভ সেখানে এতটাই গভীর যে জনরোষের টার্গেট হয়ে ওঠেন অসম-এর শাসক দলের বিভিন্ন নেতা-মন্ত্রী, তাঁদের বাড়ি-গাড়ি-অফিস। এমনকি মুখ্যমন্ত্রীকেও আটকে পড়তে হয় বিমানবন্দরে। পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, এমনকি বুলেট ব্যবহারের পরেও প্রতিবাদ থামিয়ে রাখা সম্ভব না হওয়ায়, সামরিক সাহায্যের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা চলে। সেনাবাহিনী ফ্ল্যাগ মার্চ করে গুয়াহাটি, ডিব্রুগড়, তিনসুকিয়া ও জোড়হাটে, যদিও কাজের কাজ হয়নি তাতে। এক দিকে ইন্টারনেটবিহীনতা, অন্য দিকে প্রায় টানা নব্বই ঘণ্টার বেশি কার্ফু আর গাড়ি/ টায়ার পোড়ার গন্ধকে অগ্রাহ্য করে মানুষের ঢল নামতে থাকে রাস্তায়। অসমের রাজনৈতিক ঐতিহ্য অনুসারে আসু-র নেতৃত্বে ছাত্র-আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। সঙ্গে ছিলেন নাগরিক মঞ্চ, কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতি ও বাম গণতান্ত্রিক মঞ্চের বুদ্ধিজীবীরা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ধরপাকড় করা হয়, এমনকি দেখা যায় ছোট বাচ্চাকে সামরিক বা আধা-সামরিক বাহিনীর হাত থেকে টেনে নিয়ে শঙ্কিত মা বসে পড়েছেন ফুটপাতে। ইউনিভার্সিটির গার্লস হস্টেলেও ঢুকে পড়ে সামরিক বাহিনী। গুয়াহাটি, কটন, তেজপুর, ডিব্রুগড় ইত্যাদি ইউনিভার্সিটির সিমেস্টার পরীক্ষা, এমনকি অসম ও মেঘালয়ে সর্বভারতীয় নেট পরীক্ষা বাতিল করা হয়। টানা বন্ধ-এর জেরে হস্টেলগুলোতে খাবার ফুরিয়ে যায়।
অসম ছাড়া মেঘালয় ও ত্রিপুরাতেও চলে তাণ্ডব। এ সব রাজ্যেও এই আইনের বিরোধিতার কারণটা গভীরপ্রোথিত। অসমের মতোই মেঘালয়েও বাঙালি-বিরোধিতার ঐতিহ্য রয়েছে, খাসি-বাঙালি সম্পর্কের টানাপড়েন এই রাজ্যও দেখছে কয়েক দশক ধরেই। এ বারও বিভিন্ন বাঙালি এলাকায় হিংসা, ভাঙচুর, মশাল মিছিল ও সংঘর্ষ চলে। নামে সেনা, শুরু হয় কার্ফু। খাসি স্টুডেন্ট ইউনিয়ন ঘোষণা করে যে, তারা মেঘালয়ের জন্য অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোধের ‘নিজস্ব ব্যবস্থা’ করবে। প্রয়োজনে রাজ্যে ঢোকা ও বার হওয়ার ওপর নজরদারির জন্য ‘এন্ট্রি-এক্সিট পোল’ তৈরি হতে পারে। মেঘালয়ে ‘ইনার লাইন পারমিট’-এর দাবি উঠেছে। জনসাধারণের কাছে আর্জি জানানো হয়েছে যাতে ‘ন্যাসো’ বা নর্থ ইস্ট স্টুডেন্টস অর্গানাইজ়েশন-এর সঙ্গে গোটা উত্তর-পূর্বের মানুষ যেন এই আইনের বিরোধিতায় শামিল হন।
ত্রিপুরায় কংগ্রেস ও বামপন্থীরা ছাড়া যে দলটি আইন-বিরোধিতায় নেমেছিল, তারা ‘জয়েন্ট মুভমেন্ট এগেনস্ট সিএবি’। তাদের যুক্তি, ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে যেখানে আদিবাসীদের সংখ্যা ছিল ৮০ শতাংশ, বর্তমানের ত্রিপুরায় তাদের সংখ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ শতাংশ। এর ওপর নতুন আইন অনুযায়ী যদি হিন্দু বাঙালি শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়, তা হলে তাঁদের অবস্থান আরও সঙ্কটপূর্ণ হয়ে উঠবে। ত্রিপুরায় আক্রান্ত শহরগুলোর মধ্যে মনুঘাট, কাঞ্চনপুর, ধুমছড়া, ছৈলেংটা, খোয়াই এবং বিশ্রামগঞ্জে— প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে— বাংলাদেশ-বিদ্বেষ স্পষ্ট। অবাধ লুটপাট চলেছে দোকান-বাজারে, অ্যাম্বুল্যান্স আক্রান্ত হয়েছে। অসমেরও এক দিন আগে ত্রিপুরায় ইন্টারনেট-এর সঙ্গে এসএমএস পরিষেবাও বন্ধ করা হয়। মণিপুর ও অরুণাচল প্রদেশেও নাগরিকত্ব আইনের শর্তসাপেক্ষে চট্টগ্রাম থেকে আসা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চাকমাদের নাগরিকত্ব শেষ অবধি দিয়ে দেওয়া হবে কি না, বিরোধিতার মূল প্রশ্ন সেটাই।
এই আইনের আওতা থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত জায়গাগুলোকে (আদিবাসী অঞ্চল) ও ‘ইনার লাইন পারমিট’-এর বেড়াজালে থাকা রাজ্যগুলোকে। কিন্তু অসমে ডিমা হাসাও, কার্বি আংলং ও বড়োল্যান্ড ছাড়া আর কোনও অঞ্চল তো এই ‘সুরক্ষা কবচ’-এর মধ্যে নেই। ঘটনা হল, এই আইন অসম চুক্তির ৬ নম্বর ধারাকে বর্জন করছে, সরকারের দিক থেকেও বিলটি নিয়ে পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে। তাই এই সব অঞ্চলের আদি বাসিন্দাদের অধিকার, ঐতিহ্য, পরিচিতি, শান্তি-সম্প্রীতি ও সংস্কৃতি রক্ষায় বাধা হয়ে উঠতে পারে এই আইন। এখনও অবধি এই বিলকে ‘অসাংবিধানিক ও ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোর পরিপন্থী’ বলে ১২টি সংগঠন পিটিশন দাখিল করেছে বলে শোনা যাচ্ছে। লক্ষণীয়, এনআরসি নিয়ে যেখানে সবচেয়ে বেশি অশান্ত ছিল বরাক উপত্যকা, নাগরিকত্ব আইন ঘোষণার পর ঠিক ততটাই শান্ত এই অঞ্চল। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা এখানে এসে তাঁদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে দখল করে নেবে, তার ভয় আসলে এই অঞ্চলে কম, তাই কি তাঁরা চুপ?
লক্ষণীয় হল, প্রথম থেকেই সব পক্ষ বার বার বলছে যে, এই গন্ডগোলের পিছনে নাকি কোনও ‘তৃতীয় পক্ষ’-এর হাত আছে। কিন্তু এই তৃতীয় পক্ষটা আসলে ঠিক কে বা কারা, সে সম্পর্কে কিন্তু নিশ্চিত করে কোনও রাজনৈতিক দলই কিছু বলেনি। অসমে কিছু নামঘর ও শঙ্কর কলাক্ষেত্রের গেট ভাঙা হয়েছে এই তৃতীয় পক্ষের নাম দিয়ে।
এ বারের আইনে ‘ইনার লাইন পারমিট’ ভুক্ত অঞ্চল এবং ষষ্ঠ তফসিলি এলাকায় ছাড়ের ঘোষণার কথা যোগ করা হয়েছে বলে উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন রাজ্যে নতুন দাবি— ঔপনিবেশিক শাসক দ্বারা পরিকল্পিত ঊনবিংশ শতকের প্রথম ভাগে তৈরি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে, যা ছিল আসলে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে আলাদা করে রাখার এক সার্বিক প্রচেষ্টা। এখন সেই রাষ্ট্রীয় ও সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতাকেও ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যৎ দরকারে একে কাজে লাগানো যায়। একটা আতঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে যে, এ বারে সব বাংলাদেশি হিন্দুরা অনুপ্রবেশকারী হিসেবে ঢুকে পড়বে। কিন্তু ‘কাট অফ ডেট’ তো ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪, এবং ছ’বছর থাকার পর, নির্দিষ্ট প্রমাণপত্র জমা দিলে, তবেই তো কেউ নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন। তা হলে এখন যাঁরা ঢুকবেন, তাঁদের লাভ কী হবে? আসল কথা, উগ্র জাতীয়তাবাদী কার্ড উত্তর-পূর্বের রাজনীতিতে সব সময় কাজে আসে। আর এ বারে একই সঙ্গে ধর্মীয় ও ভাষিক ভিত্তিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়ানো হচ্ছে। ১৯৮৫ সালের পর গত ৩৪ বছরে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে একটু হলেও স্থিতাবস্থা এসেছিল, এই নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে আবার তা বিনষ্ট করে, বাঙালি-বিদ্বেষকে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।
দেশভাগের সময়ে ধর্মীয় পরিচিতি ও অসম আন্দোলনের সময় ভাষিক পরিচিতিকে কেন্দ্র করে অসমে সংঘর্ষের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। এ বারে দু’টি বিষয়কেই একসঙ্গে মিলিয়ে সন্দেহ ও অনিরাপত্তার পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। ‘এনআরসি’র মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে বিদেশি অনাগরিক খুঁজে বার করা হচ্ছে, ঠিক তেমনই ‘সিএএ’-র মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা হচ্ছে, কোন কোন বিদেশি অনাগরিক ধর্মের ভিত্তিতে ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য। মোদ্দা ব্যাপারটা ঠিক কী দাঁড়াল? রাষ্ট্রের নিরন্তর অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার বাইরে এখন আমরা কেউ নেই। যে কোনও সময়ে, যে কোনও প্রমাণ দাখিলের ডাক আসতে পারে আমাদের যে কোনও কারও কাছে। হায় গণতন্ত্র।
ইতিহাস বিভাগ, ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy